‘বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলতে হবে’!
১৯৬৮ সাল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলছে। কুর্মিটোলায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের দুর্ভেদ্য দুর্গের এক কক্ষে ট্রাইব্যুনাল বসানো হয়েছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ কথাগুলো বলেছিলেন।
পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান বুঝতে পারেননি যে তাঁর পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জানতেন আইয়ুবের দিন শেষ। পাকিস্তানি শাসকেরা ভেবেছিলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিবরণী প্রতিদিন পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করা হলে দেশবাসী মুজিববিরোধী হয়ে পড়বে, বাঙালির স্বাধিকারের আন্দোলন ভেঙে পড়বে। কিন্তু ঘটনা হয়েছে ঠিক উল্টো। মামলার একেক দিনের খবর পড়ে বাঙালি আরও ফুঁসে উঠতে থাকে।
সেই সময় দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে মামলার প্রতিবেদন লিখতেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর খুব প্রিয়। ট্রাইব্যুনালকক্ষে ঢুকেই তিনি ডাক দিলেন, ‘ফয়েজ, ফয়েজ, এই ফয়েজ!’ ফয়েজ ভাই বললেন, ‘মুজিব ভাই, কথা বলা মানা...বের করে দেবে।’ তখনই বঙ্গবন্ধুর সেই অবিস্মরণীয় গর্জন। বুঝিয়ে দিলেন তিনি সামরিক ফরমান মানার মানুষ নন। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ চলবে না! (বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউট, ঢাকা, ২০১৩, পৃষ্ঠা ৫১)।
বঙ্গবন্ধু কোনো দিন পাকিস্তানিদের কাছে মাথা নত করেননি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে যেদিন গভীর রাতে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেদিনও তিনি ছিলেন অনমনীয়। তাঁকে জেলগেটের ছোট দরজা দিয়ে বের হতে বললে তিনি রাজি হননি। পুরো দরজা না খুললে তিনি বের হবেন না, কারণ শেখ মুজিব মাথা নিচু করতে জানেন না। ছোট গেট দিয়ে বের হতে হলে মাথা নিচু করতে হয়। এটা যে তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, সেটা তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা হয়ে ওঠে সমগ্র বাঙালি জাতির প্রাণের দাবি। পাকিস্তানি শাসন-শোষণ-লুণ্ঠনে দেশবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় বাংলাদেশ (পূর্ব বাংলা) পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে ছয় দফার অপরিহার্যতা আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থাকা যে কত অনিরাপদ, তা সেদিনই বাঙালি হাড়ে হাড়ে টের পায়। বাঙালির স্বাধীন সত্তার প্রয়োজনীয়তা সেদিন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছয় দফার মূল কথাই ছিল আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন। আমরা যেন নিজেদের পরিচয়ে যথাযোগ্য মানমর্যাদা নিয়ে থাকতে পারি। যেন পশ্চিম পাকিস্তানিদের অপকর্মের জন্য আমাদের পূর্ব বাংলার নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়। পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী যেন বাঙালির সম্পদ কেড়ে নিতে না পারে। এসব দাবির পেছনে সমগ্র বাংলাদেশ ও বাঙালি এক হয়ে সেদিন দাঁড়িয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল মূলত বাঙালির স্বার্থের পক্ষে বঙ্গবন্ধুর আপসহীন, অনড় অবস্থানের জন্য।
সেদিন যদি বঙ্গবন্ধুর মতো বিচক্ষণ, সাহসী, নিবেদিতপ্রাণ নেতা নিজের জীবন তুচ্ছ করে নেতৃত্ব না দিতেন, তাহলে
আজও আমরা পাঞ্জাবি শাসক-শোষকদের জাঁতাকলে পিষ্ট হতাম। আল কায়েদা-তালেবানদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র হয়ে আমাদের থাকতে হতো।
পাকিস্তানের সেনা শাসকেরা বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে মারতে পারেনি। ঐতিহাসিক ৭ জুন ছয় দফা দিবসের সমাবেশ বন্ধ করতে পারেনি। পাকিস্তানি সেনারা সেদিন পল্টন ময়দান দখল করে ভেবেছিল ছয় দফার আন্দোলন ধুলায় মিশিয়ে দেবে, কিন্তু পারেনি। বরং লাখ লাখ মানুষ সেদিন পল্টন ময়দানের চারপাশে জমা হয়ে সেনাদের ঘেরাও করে ফেলেছিল। পাকিস্তানিরা বুঝতে পারেনি কোন আগুনে ওরা হাত দিচ্ছে। মাত্র তিন বছরের মাথায় উনসত্তরের মহান গণ-অভ্যুত্থান বঙ্গবন্ধুকে ক্যান্টনমেন্টের কারাগার থেকে ছিনিয়ে আনল। ‘ফিল্ড মার্শাল’ আইয়ুব খান নিজেই নিজের কবর রচনা করলেন।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল। ভারত ছিল আমাদের পাশে। এক কোটি শরণার্থীকে প্রতিবেশী ভারত আশ্রয় না দিলে আমাদের টিকে থাকা দায় ছিল। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছ থেকে ট্রেনিং ও অস্ত্র পেয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সক্রিয় সমর্থন আমরা পেয়েছিলাম। একসময় বিশ্ববাসী আমাদের পাশে দাঁড়ায়। অবশেষে গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা আমরা ছিনিয়ে আনি।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের জল্লাদখানায় বন্দী করে রেখেও ভুট্টো তাঁকে মারতে পারেননি। বরং বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর তিনি মহান নেতা বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হন। এ কথা তিনি টাইম ম্যাগাজিনের সংবাদদাতা ড্যান কগিনকে জানান। এর পটভূমি তৈরির জন্য তিনি ১৯৭২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের শুরুতে করাচিতে লাখ খানেক সমর্থকের এক সমাবেশের আয়োজন করে ভাষণের ব্যবস্থা করেন। একপর্যায়ে তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘আপনারা কি চান মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হোক?’ ভুট্টোর বাগ্মিতায় সায় দিয়ে সমবেত লোকজন গতানুগতিক ধারায় সমর্থন জানায়। ভুট্টো বললেন, ‘তোমরা আমার মাথা থেকে একটা বড় বোঝা নামালে।’ (টাইম ম্যাগাজিন, জানুয়ারি ১৭, ১৯৭২)। এর পরপরই বঙ্গবন্ধু লন্ডন হয়ে ঢাকার পথে রওনা হন। তাঁকে মুক্তি না দিয়ে ভুট্টোর কোনো পথ ছিল না।
দেশে ফিরে কোটি বাঙালির ভালোবাসায় সিক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু। বিধ্বস্ত বাংলাদেশের হাল ধরলেন তিনি।
আমরা তখন ছাত্র। ছাত্র ইউনিয়ন করি। মণি সিংহ, মোহাম্মদ ফরহাদের নেতৃত্বাধীন সিপিবির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছি। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমাদের উচ্চ মূল্যায়ন ছিল। আমরা সব সময় তাঁর নেতৃত্বের প্রতি আস্থাবান ছিলাম। দল–মতনির্বিশেষে সব মানুষের নেতা হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ত্রয়োদশ জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেই সম্মেলন হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু সেদিন আমাদের সংগঠনের সম্মেলনে এসেছিলেন, কারণ তাঁর কাছে দেশ ছিল দলের ঊর্ধ্বে। নুরুল ইসলাম নাহিদ, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, নূহ-উল-আলম লেনিনসহ আমরা কয়েকজন সেদিন এক মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন হয়। বঙ্গবন্ধু তরুণদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
বঙ্গবন্ধু কাউকে দূরের মনে করতে পারতেন না। সবাইকে আপন করে নেওয়ার এক অসাধারণ গুণ তাঁর ছিল। আমাদের মতো তরুণদের তিনি কাছে টেনে নিয়েছিলেন। তিনি কখনো নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি চাইতেন না। কারণ, তিনি গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মাটি থেকে উঠে এসেছিলেন। ইতিহাসে এ রকম নেতার অভ্যুদয় বিরল।
স্বাধীনতার পর দেশের সামনে ছিল অনেক সমস্যা। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশে বিশৃঙ্খলা, অস্থিতিশীলতা, দুর্ভিক্ষসহ নানা সমস্যা প্রকট হয়ে ওঠে। ষড়যন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর কাছে সব খবরই আসত। কিন্তু কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে, এটা তিনি বিশ্বাস করতে চাইতেন না। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে তাঁকে বিভিন্ন সময়ে সতর্ক করা হলেও তিনি ছিলেন অনমনীয়।
দেশ ও দেশের মানুষের ওপর বঙ্গবন্ধুর অগাধ আস্থা ছিল। সেটাই হয়েছিল তাঁর কাল। অবারিত দ্বার পেয়ে তাঁর চরম শত্রুরা কাপুরুষোচিত হামলা চালাল।
আমরা ভেবেছিলাম, বাংলাদেশের মাটিতে আর কখনো সেনা শাসন আসতে পারবে না। যেখানে আইয়ুব-ইয়াহিয়া টিকতে পারেননি, সেখানে আবার কোন বাঙালি আসবে সামরিক উর্দি পরে? সে রকম কোনো শাসন বাঙালি কোনো দিন মেনে নেবে না, এটা ছিল আমাদের একধরনের বিশ্বাস। কিন্তু আমাদের সেই ধারণা খুব শিগগিরই ভুল প্রমাণিত হলো। কর্মরত ও সাবেক কিছু মেজর রাতের আঁধারে ট্যাংক নিয়ে আক্রমণ করল, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করল। শুরু হলো সামরিক শাসনের এক কালো অধ্যায়।
বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ৪০ বছর পর এই স্বাধীন বাংলার মাটিতে আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনা করছেন। তাঁকেও হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছিল। গ্রেনেড হামলায় তাঁকে ও তাঁর দলকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে পা রেখেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মা ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনাসহ অনেক বড় বড় সাফল্য আজ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলতর করে তুলছে।
কিন্তু এখনো সামনে অনেক সমস্যা। এগিয়ে যেতে হলে পেছনে তাকাতে হবে। অতীতের ভুলত্রুটিগুলো কাটিয়ে ওঠা আজ সবচেয়ে বড় কাজ।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
[email protected]