ফ্রান্স অনেক দিন ধরেই উদারবাদী আর কট্টরবাদী রাজনীতির দোলাচলের মধ্যে রয়েছে। তা আবার প্রমাণিত হলো ১০ এপ্রিল ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। ইউরোপীয় রাজনীতিতে এটি একটি নতুন দৃষ্টান্ত। ফ্রান্সের মতো প্রাচীন গণতান্ত্রিক দেশে ঐতিহ্যবাহী ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলগুলো থেকে জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সাবেক মূলধারার দুই দলের মধ্যে রক্ষণশীল রিপাবলিক ও সামাজিক গণতন্ত্রী বা সোশ্যালিস্টরা চূড়ান্ত পর্বের নির্বাচনে যাওয়ার মতো ভোট পাননি।
পাঁচ বছর আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতো এবারও প্রথম দফার ভোটে এমানুয়েল মাখোঁ প্রথম ও কট্টর ডানপন্থী মেরিন লঁ পেন দ্বিতীয় সর্বাধিক ভোট পেয়েছেন। তবে ফ্রান্সের নির্বাচনী আইনে, তা প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য যথার্থ নয়। এবারের নির্বাচনের প্রথম পর্বে মাখোঁ পেয়েছেন ২৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ, লঁ পেন পেয়েছেন ২৩ দশমিক ১৫ শতাংশ আর বামপন্থী দলের লা ফ্রান্স জ্য-লুক মিনশঁ পেয়েছেন ২১ দশমিক ৯৫ শতাংশ ভোট। ফ্রান্সের প্রথম দফার নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে লড়েছেন ১২ জন। তাঁদের মধ্যে চারজন নারী, আটজন পুরুষ।
পরাজিত প্রগতিশীল প্রার্থীদের বেশির ভাগই দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে তাঁদের সমর্থকদের এমানুয়েল মাখোঁকে ভোট দেওয়ার জন্য বলেছেন। তবে প্রথম দফা নির্বাচনে বামপন্থী দলের নেতা লা ফ্রান্স জ্য-লুক মিনশঁ তাঁর সমর্থকদের দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে কোনোক্রমেই কট্টর ডানপন্থী মেরিন লঁ পেনকে ভোট না দিতে অনুরোধ করেছেন। তবে কোন প্রার্থীকে ভোট দিতে হবে, তা বলেননি। অন্যদিকে আরেক রক্ষণশীল দল রিকনকয়টের নেতা এরিক জেরমোঁ তাঁর সমর্থকদের দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে মেরিন লঁ পেনকে ভোট দিতে বলেছেন। এরিক জেরমোঁ এবারের নির্বাচনে ৭ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়ে চতুর্থ স্থানে রয়েছেন।
ফ্রান্সের সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের অধীনে, প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট দুই দফা নির্বাচনে পাঁচ বছরের মেয়াদে নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সাল থেকে সরাসরি জনগণের ভোটে দুই পর্বের নির্বাচনের এই প্রথা চালু হয়। প্রথম পর্বে কোনো প্রার্থী নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট না পেলে দুই সপ্তাহ পর সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় দফার (রান-অফ) অনুষ্ঠিত হয়। এখন ২৪ এপ্রিল দ্বিতীয় দফার ভোটেই চূড়ান্ত হবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য কে হবেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট।
লুক্সেমবার্গের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন অ্যাসেলবর্ন জানিয়েছেন, ‘এটা খুবই উদ্বেগজনক ইউরোপের কট্টরবাদীরা এভাবে ভোট পাচ্ছেন। এখন নির্বাচনে ফরাসি ভোটারদের লঁ পেনের বিজয় ঠেকানো উচিত।’ জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক বলেছেন, এই মুহূর্তে ইউরোপীয় ঐক্যের পক্ষের নেতাদের আরও বেশি করে প্রয়োজন।
ফরাসি জনগণ ভুল করেনি, ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, শিল্পকলা, দর্শনসহ নানা সংস্কারের ধারক ফ্রান্স তার পুরোনো ঐতিহ্যকে বিকিয়ে দিয়ে সস্তা স্লোগানসর্বস্ব কট্টর ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের মেরিন লঁ পেনকে সর্বোচ্চ ভোটে জয়যুক্ত করেনি।
বিগত বছরগুলোতে ফ্রান্সের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোতে অনিশ্চয়তা, ব্যক্তিত্বের সংকট চলছে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা, অনিয়ম, কেলেঙ্কারির অভিযোগ, বেকারত্বের হার বৃদ্ধি এবং বারবার সন্ত্রাসী হামলার মুখে সামনে চলে আসেন ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা লঁ পেন। ফ্রান্সের জনগণ সোশ্যালিস্ট ও রিপাবলিক পার্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এই সময় ২০১৬ সালে এগিয়ে আসেন দলনিরপেক্ষ মধ্যপন্থী ৪৪ বছর বয়সী সাবেক অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী এমানুয়েল মাখোঁ। তিনি গঠন করেন এন ম্যারশে বা এগিয়ে যাও আন্দোলন দলটি। গতবারের নির্বাচিত তরুণ প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে নানা আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ সংকট সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেন।
ট্রান্স আটলান্টিক বা ইউরো-আমেরিকান টানাপোড়েন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনৈক্য, ন্যাটো জোটের বিস্তৃতি রোধ বা ইউরোপীয় সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রচেষ্টা, ইউক্রেনের যুদ্ধ নিয়ে মতভেদ বা নিজ দেশে করোনাকালীন সংকট, পেনশনবিষয়ক সংস্কার, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়েছিলেন মাখোঁ।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত কট্টর ডানপন্থী মেরিন লঁ পেন এবারের নির্বাচনে বেশ সংযত হয়ে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। ২০০২ সালে ডানপন্থী ফ্রন্ট ন্যাশনালের বর্তমান প্রার্থী মেরিন লঁ পেনের বাবা জিন-মেরিন লঁ পেন, সেই সময়ের বাম সমাজতান্ত্রিক দলের ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট লিওনেল জোসপিনকে পেছনে ফেলে ফ্রান্সের রাজনীতিতে রাজনৈতিক ভূমিকম্প ঘটান। অবশ্য সেই বছর মধ্য ডানপন্থী গলিস্ট শিবিরের জ্যাক শিরাক নির্বাচনে প্রথম হয়ে পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ডানপন্থী ফ্রন্ট ন্যাশনাল সাবেক নেতা জিন-মেরিন লঁ পেন ছিলেন তাঁর মেয়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মেরিন লঁ পেনের থেকে আরও রক্ষণশীল ঘরানার রাজনীতিক। ২০১১ সালে মেয়ে মেরিন লঁ পেন ফ্রন্ট ন্যাশনাল দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হন।
ফ্রন্ট ন্যাশনাল দলের সভানেত্রী মেরিন লঁ পেন এবারের নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্তির পর তাঁর সমর্থক ও সমমনাদের উদ্দেশে বলেছেন, ২৪ এপ্রিলের দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোট, ফরাসিদের স্বার্থরক্ষার ও স্বাধীনতার জন্য ভোট। ফ্রান্সের এই ভোট শুধু আগামী ৫ বছর নয়, ৫০ বছরের জন্য। তিনি ভবিষ্যতের রাজনীতিতে অভিবাসন, নিরাপত্তা নীতি, পরিবেশ নীতি, সামাজিক নীতি ও ইউরোপীয় নীতি নিয়ে ফ্রান্সকে সব ক্ষেত্রে আবার একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করবার কথা ব্যক্ত করেছেন। তাই মেরিন লঁ পেন তাঁকে নির্বাচিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ প্রথম পর্বের নির্বাচনে সর্বাধিক ভোট পাওয়ার পর জানিয়েছেন, ‘আপনাদের বিশ্বাস আমাকে সম্মানিত করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফ্রান্স এবং ইউরোপের জন্য আমাদের অগ্রগতি ও স্বাধীনতার প্রকল্পকে এগিয়ে নিতে আপনারা আমার ওপর নির্ভর করতে পারেন।’ প্রেসিডেন্ট মাখোঁ করোনা মহামারি ও ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে বেশ দেরি করে নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছিলেন।
ফ্রান্সের নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় রাজনীতির দৃষ্টি এখন ২৪ এপ্রিল ঘিরে।
লুক্সেমবার্গের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন অ্যাসেলবর্ন জানিয়েছেন, ‘এটা খুবই উদ্বেগজনক ইউরোপের কট্টরবাদীরা এভাবে ভোট পাচ্ছেন। এখন নির্বাচনে ফরাসি ভোটারদের লঁ পেনের বিজয় ঠেকানো উচিত।’ জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক বলেছেন, এই মুহূর্তে ইউরোপীয় ঐক্যের পক্ষের নেতাদের আরও বেশি করে প্রয়োজন। ডাচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াপকে হোয়েকস্ট্রা ফরাসি জনগণকে ২৪ এপ্রিলের ভোটে বেশি করে উপস্থিতি হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি ইউক্রেনের গণতান্ত্রিক সরকারের ওপর রাশিয়ার আক্রমণের ফলে সবাইকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের অসাধারণ গুরুত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন।
২৪ এপ্রিল ফ্রান্সের দ্বিতীয় পর্বের নির্বাচনের ফলাফলেই দেখা যাবে, ভবিষ্যতে ফ্রান্স, তথা ইউরোপীয় গণতন্ত্রে কট্টরবাদী না উদারবাদী, কোন পক্ষের বিজয় হবে।
সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
[email protected]