ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রথম দফা ভোটে এমানুয়েল মাখোঁ প্রথম অবস্থানে রয়েছেন। কিন্তু ডানপন্থী প্রার্থী মেরিন লঁ পেনের সফলতা ফ্রান্সের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি করেছে। ২৩ দশমিক ১ শতাংশ ভোট পেয়ে লঁ পেন দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন।
জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে কথা বলে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন মেরিন লঁ পেন। বিষয়টা মধ্যপন্থী জাতীয়তাবাদী হিসেবে তাঁর একটা ভাবমূর্তি তৈরি করেছে। কিন্তু অভিবাসনবিরোধী ও ইসলামবিরোধী মনোভাবই তাঁর প্রচারণার মূল বিষয়। এটাকে তিনি ‘ফ্রান্সের সংস্কৃতি’ রক্ষার বর্ম হিসেবে বিবেচনা করেন।
মেরিন লঁ পেনের এই জনপ্রিয়তা ফ্রান্সের রাজনীতির বিভাজনের চিত্রকেই স্পষ্ট করে তুলে ধরে। বিষয়টি এখন আর শুধু অতি ডানপন্থীদের বিষয় নেই। এ বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক চিন্তার প্রার্থীরা সেক্যুলারিজম (চার্চ ও রাষ্ট্রকে পৃথক রাখা) ইস্যুতে একজন আরেকজনকে ছাপিয়ে গেছেন। এই ইস্যুতে মাখোঁর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডরমানিন এমন অভিযোগ তুলতেও দ্বিধা করেননি—ইসলামের প্রতি ‘নরম’ মনোভাব দেখাচ্ছেন মেরিন লঁ পেন।
ইসলামকে নিয়ে ফ্রান্সের যে ভীতি, সেটার ভিত্তি রাষ্ট্র হিসেবে তার সেক্যুলার অস্তিত্ব। এখন পর্যন্ত প্রতিটা রাজনৈতিক বিবৃতি এবং সরকারি নীতিতে সেক্যুলারিজম বা ‘রাষ্ট্র ও চার্চের’ বিচ্ছিন্নতার বিষয়টি মেনে চলা হয়। কিন্তু মুসলমানদের প্রশ্নে আবার রাষ্ট্র ও ধর্মকে মিলিয়ে দেখা হয়। এই দ্বিমুখী দৃষ্টিভঙ্গি শুধু ধর্ম ও রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে না, ফ্রান্সের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও সত্যিকারের কোনো রাজনৈতিক সংলাপের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
ইসলামোফোবিয়া (ইসলামভীতি) বিষয়টি দুঃখজনকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে একটি প্রবণতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশের নেতাদের কাছে ইসলামফোবিয়া একটি স্বীকৃত শব্দ। কিন্তু ফ্রান্সের রাজনীতিকেরা যে মুসলিমবিরোধী, সে রকম কোনো কলঙ্ক নিতে রাজি নন। ইসলামফোবিয়ার পরিবর্তে তাঁরা ফ্রান্সের সংস্কৃতির রক্ষাকবচ হিসেবে ‘ইসলামো-লেফটিস্ট’ শব্দটি ব্যবহার করেন।
রাজনৈতিক ইসলামের প্রতি ভয়
প্রেসিডেন্ট সারকোজির আমলে ইসলামিক মূল্যবোধের ওপর আক্রমণ একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক প্রক্রিয়া হিসেবে স্বীকৃতি পায়। সেক্যুলারিজম রক্ষার উপায় হিসেবে তিনি তাঁর ইসলামবিরোধী নীতিকে হরহামেশা ব্যবহার করতে শুরু করেন। আইএসআইএলের একজন অনুসারীর হাতে স্যামুয়েল পাতি নামের একজন নাগরিক নিহত হওয়ার ঘটনায় মাখোঁও একই পথ অনুসরণ করতে শুরু করেন। মুসলিম নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে দমনপীড়ন শুরু করেন। একই সঙ্গে ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইসলামো-লেফটিস্ট মতাদর্শ নামের একটি বিষয় চাপিয়ে দেন। এর মধ্য দিয়ে একাডেমিক স্বাধীনতার ধারণাটি ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে।
ধর্মীয় ‘চরমপন্থা’র গতিমুখ নিম্নগামী করে দেওয়ার ক্ষেত্রে মাখোঁর এসব পদক্ষেপকে কারও কারও কাছে যৌক্তিক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে যে অপ্রীতিকর প্রশ্ন এখানে উঠছে সেটা হলো, পুরোপুরি ফ্রান্সের অধিবাসী হিসেবে কাদেরকে ধরা হবে এবং ফ্রান্সের সমাজের যথাযথ সংজ্ঞাটাই বা কী? এ প্রসঙ্গে রেজা জিয়া ইব্রাহিমি লিখেছেন, ‘সেক্যুলারিজম স্থির কোনো মূল্যবোধ নয়। গত কয়েক দশকে ক্রমবর্ধমানভাবে এটি ডানপন্থীদের যে ইসলামবিরোধিতা, সেদিকে ঝুঁকে পড়েছে।’
মুসলিমদের অনুগত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ফ্রান্সে যেসব আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, তার প্রভাব এরই মধ্যে বাস্তব জীবনে পড়তে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক কালে যে ‘ইসলামি চরমপন্থার বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদবিরোধী বিল’ পাস হয়েছে, তাতে ফ্রান্সের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ধর্মীয় সংস্থায় হস্তক্ষেপ করা এবং বিদেশি অর্থায়ন সীমিত করে দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। গত এক বছরে এই বিলের ওপর ভিত্তি করে প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে মসজিদ, বিদ্যালয়, হালাল খাবারের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি বৈষম্য বিলোপ নিয়ে কাজ করে, এমন একটি নেতৃত্বস্থানীয় সংস্থার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ভিন্ন নামে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ
যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কায়দায় বিষয়টাকে ‘সাংস্কৃতিক যুদ্ধ’ হিসেবে তত্ত্বায়ন করতে নারাজ মাখোঁ। কিন্তু তিনি সেক্যুলারিজমকে যেভাবে সামনে আনছেন, তাতে করে সাংস্কৃতিক ক্ষয় ও অভিবাসনবিরোধী মনোভাব প্রকাশ পায়। এর মধ্য দিয়ে ইউরোপীয়দের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছ বলে মনে করা হয়। ইসলামোফোবিয়া (ইসলামভীতি) বিষয়টি দুঃখজনকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে একটি প্রবণতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশের নেতাদের কাছে ইসলামফোবিয়া একটি স্বীকৃত শব্দ। কিন্তু ফ্রান্সের রাজনীতিকেরা যে মুসলিমবিরোধী, সে রকম কোনো কলঙ্ক নিতে রাজি নন। ইসলামফোবিয়ার পরিবর্তে তাঁরা ফ্রান্সের সংস্কৃতির রক্ষাকবচ হিসেবে ‘ইসলামো-লেফটিস্ট’ শব্দটি ব্যবহার করেন।
ফ্রান্সের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বৈচিত্র্য এ বিষয়ে নীরবতা দেখাচ্ছে। অভিন্নতাকেই এখন আত্মপরিচয় নিরূপণের জন্য বিবেচ্য বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। মুসলিম অভিবাসীদের জাতিগত স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। মুসলিমদের সঙ্গে যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হচ্ছে, সেটাকে সাংস্কৃতিক অধিকারহীনতা হিসেবে না দেখে ধর্মীয় পর্যালোচনার ছাঁচে ফেলে দেখা হচ্ছে। এ নীতির সমালোচনা ঠেকাতে আবার সেক্যুলার সমাজে চালু থাকা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যাঁরা এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন, তাদের হয় ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল বামপন্থী অথবা সরাসরি ইসলামপন্থীর তকমা দেওয়া হচ্ছে।
ইসলামের বিধিবিধান পালন করুক আর না–ই করুক, ফ্রান্সের মুসলমানদের রাজনৈতিক পরিসর অনেক ছোট হয়ে এসেছে। ফ্রান্সের মুসলমান নাগরিকেরা, যাঁদের অনেকেই এখন অভিবাসীদের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের সন্তান, তাঁদের এখন অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে ক্রমাগত আওয়াজ তুলতে হচ্ছে।
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, মাখোঁ ও মেরিন লঁ পেনের মধ্যে শেষ ধাপের নির্বাচনের যে প্রচারণা পর্ব, তাতে স্পষ্ট যে মুসলিমবিরোধী রাজনৈতিক মনোভাব খুব সহসাই ফ্রান্সের সমাজ থেকে যাচ্ছে না। কারণ, নির্বাচনে জেতার সহজ পথ এটাই। ভিন্ন কিছু করে খাদে পড়ার কী দায় পড়েছে প্রার্থীদের?
আলজাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মনোজ দে
ইমানুয়েল দ্য ইস্পোস্তি রিসার্চ অফিসার, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস
ক্রিস চ্যাপলিন অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসরিয়েল রিসার্চ ফেলো, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস