মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির বাইরের চেহারা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে। এর সঙ্গে আরব-ইসরায়েল সংঘাত নিরসনে তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। এই সন্দেহ থেকে একটি জরুরি প্রশ্ন উঠে আসছে: যুক্তরাষ্ট্র যে কূটনৈতিক শূন্যতা রেখে যাচ্ছে, তা কি কেউ পূরণ করতে পারবে?
এটি ঠিক, বাইডেন তাঁর পূর্বসূরির রেখে যাওয়া কিছু নীতির উল্টো পথে হাঁটছেন। তিনি ক্ষমতা গ্রহণের এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনি নেতাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনর্বহাল করা এবং ফিলিস্তিনিদের ত্রাণ দেওয়া আবার শুরু করার ঘোষণা দিয়েছেন। বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের দুই–রাষ্ট্র সমাধান করার বিষয়েও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে বাইডেনের কথা বলার বিষয়ে অনীহা দেখা যাচ্ছে। এই অনীহা বাইডেনের প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন নয়।
অনেক আগে থেকেই স্পষ্ট, আমেরিকান নেতারা দুই–রাষ্ট্র সমাধান ইস্যুতে বুলি আউড়েই দায়িত্ব শেষ করেন। ইউরোপের পক্ষে সেটি সম্ভব হয় না। এর কারণ, মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ইউরোপের ভৌগোলিক সান্নিধ্য রয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা হলে তার আঁচ তাদের গায়েও এসে পড়ে। এ কারণেই গত বছর অনুষ্ঠিত মিউনিখ প্রতিরক্ষা সম্মেলনে হাজির হয়ে সম্মেলনের এক ফাঁকে ফ্রান্স ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মিসর এবং জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার বিষয়ে আলোচনা করেন। কথিত এই মিউনিখ গ্রুপ এখন ফিলিস্তিনের শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করার জন্য কাজ করছে।
মিউনিখ গ্রুপে মিসরের যোগ দেওয়া প্রমাণ করে, তারা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে আগ্রহী। এই চলতি মাসেও মিসর আরব দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছে। সেখানে অংশগ্রহণকারীরা জোর দিয়ে বলেছেন, দুই–রাষ্ট্র সমাধানে না পৌঁছানো পর্যন্ত ফিলিস্তিন ইস্যু তাঁদের কাছে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হিসেবে জারি থাকবে। ঠিক একই সপ্তাহে মিসর ফিলিস্তিনের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সংলাপের আয়োজন করে। এই গ্রীষ্মে ফিলিস্তিনের আইনসভা ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। নির্বাচন যাতে সফলভাবে হয়, তার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য মিসর এই সংলাপের আয়োজন করে। কিন্তু দুই–রাষ্ট্র সমাধানে আগে ফিলিস্তিনকে ইউরোপের স্বীকৃতি দিতে হবে।
২০১৪ সালে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাবে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে সদস্য দেশগুলো অকুণ্ঠ সমর্থন দেয়। ইইউভুক্ত দেশগুলোর নিজ নিজ পার্লামেন্টেও একই প্রস্তাব পাস হয়। কিন্তু এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা না থাকায় তা কাগুজে নথি হয়ে আছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব পাস করার পরও জার্মানি ও ফ্রান্সের মতো ইউরোপীয় দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দানের ঘোষণা দেয়নি। এটি দুই–রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে বড় বাধা হয়ে আছে।
চার বছর আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘শান্তি পরিকল্পনা’র জের ধরে ইসরায়েল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডভুক্ত পশ্চিম তীরের এক-তৃতীয়াংশ দখল করে ফেলেছে। এটি দুই–রাষ্ট্র সমাধানের আশাকে একেবারে ফিকে করে ফেলেছে। জর্ডান নদী এবং ভূমধ্যসাগরের মধ্যবর্তী এলাকায় ইহুদি বসতি এতটাই বেড়েছে যে এটি দেখলে ‘এক-রাষ্ট্র সমাধান’ই এই অঞ্চলের নিয়তি বলে মনে হবে।
আগামী মাসে ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে যিনিই জিতুন এবং সরকারপ্রধান হোন, তাতে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরায়েল সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে না। দেশটির সব প্রধানমন্ত্রী ফিলিস্তিনিকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে আছেন। এরপরও জার্মানির ম্যার্কেল এবং ফ্রান্সের এমানুয়েল মাখোঁ যদি নিজেরা ফিলিস্তিনকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা না করে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের জন্য বাইডেনের প্রতিশ্রুতি পূরণের আশায় বসে থাকেন, তাহলে তা হয়তো তাঁরা তাঁদের জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারবেন না।
ইউরোপের নেতাদের বুঝতে হবে, ইউরোপ ফিলিস্তিনে সাহায্য তহবিল সরবরাহ করে সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। এর কারণ, এই সাহায্য তহবিলের সুবিধা নস্যাৎ করতে ইসরায়েল কোনো ধরনের ইতস্তত করবে না। গত চার বছরে ইহুদি দখলদারির কারণে বাস্তুচ্যুত হয়ে যারা পশ্চিম তীরের একটি শরণার্থীশিবিরে বিদেশি সহায়তায় ঘরবাড়ি তুলেছিল, সেখানকার অন্তত ৭০টি ভবন ইসরায়েল গত নভেম্বরে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ইউরোপের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো জোরালো নিন্দা আসেনি।
এখন ইউরোপ যদি সত্যি সত্যি দুই–রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান চায়, তাহলে ইউরোপকে ইসরায়েলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সাহস দেখাতে হবে। তাদের আন্তর্জাতিক আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। তাদের ন্যায্যতা মানতে বাধ্য করতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
দাউদ কাত্তাব মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক ও প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক