১১ দিনের টানা সংঘর্ষের পর গাজা এখন শান্ত। কিন্তু শান্তি আসেনি। গত ১০ বছরে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চতুর্থ দফা এই যুদ্ধের পর কার কী লাভ হলো, কার কতটা ক্ষতি হলো, তার হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ একমত, সবচেয়ে লাভ হয়েছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর। পর্যাপ্ত সমর্থনের অভাবে নতুন সরকার গঠনে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি ক্ষমতা হারাতে বসেছিলেন। এই যুদ্ধ তাঁর হাতে চাঁদ এনে দিয়েছে। তিনি এখন দাবি করতে পারেন, একমাত্র তিনিই হলেন ইসরায়েলের রক্ষাকর্তা। ফলে আরও এক দফা নির্বাচন হলে তাঁর বিজয় আটকানো কঠিন হবে।
একইভাবে লাভবান হয়েছে হামাস; তারাও দাবি করতে পারে ইসরায়েলি আগ্রাসনের মুখে একমাত্র তারাই প্রতিরোধ দিয়ে গেছে। বোমায় ঝাঁজরা হলেও যুদ্ধে তারাই জয়ী হয়েছে। তবে বড় রকমের ক্ষতি হলো ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ও তার প্রধান মাহমুদ আব্বাসের। এই যুদ্ধ আবারও প্রমাণ করল তিনি ঠুঁটো জগন্নাথ ভিন্ন অন্য কিছু নন।
ফিলিস্তিনিদের যদি নিরাপত্তার সমানাধিকার থাকে, তাহলে তো ইসরায়েলি হামলা ঠেকাতে তাদেরও আয়রন ডোমের মতো প্রযুক্তি দরকার। যুক্তরাষ্ট্র কি তা দেবে
হামাস ও ইসরায়েলের ক্ষমতার সমীকরণে বড় ধরনের পরিবর্তন না হলেও এই যুদ্ধের ফলে রাজনৈতিক মানচিত্রে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় না। গত ১০ বছরে ফিলিস্তিন প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক বিবেচনা থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিল। ট্রাম্প প্রশাসনের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কে নতুন যে মেরুকরণ ঘটেছে, তাতে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে মোকাবিলার বদলে তার সঙ্গে সহাবস্থানের রণকৌশল বেছে নিয়েছে। সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ ইসরায়েল নয়, ইরান। তাকে ঠেকাতে আরবরা গাঁট বেঁধেছে ইসরায়েলের সঙ্গে, ফলে কার্পেটের নিচে চলে গেছে ফিলিস্তিন প্রশ্নটি। এই ১১ দিনের যুদ্ধ বিশ্বকে মনে করিয়ে দিল ফিলিস্তিন সমস্যার কোনো সমাধান এখনো হয়নি।
এর চেয়েও বড় পরিবর্তন ফিলিস্তিন প্রশ্নে মার্কিন অবস্থান। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে ও বাইরে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রগতিশীল অংশের চাপে বাইডেন প্রশাসন ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন প্রশ্নে অধিক ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ অবস্থান গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স পত্রিকায় নিবন্ধ লিখে চলতি মার্কিন নীতির সমালোচনা করেছেন। আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-করতেজ কংগ্রেসের অধিবেশনে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের ব্যবহার দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী ‘অ্যাপারথেইড’ ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন। এমনকি ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক হিসেবে পরিচিত ডেমোক্রেটিক সিনেটর মেনেনদেজ ইসরায়েলের বোমাবাজির ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি গ্রহণযোগ্য নয় বলে বিবৃতি দিয়েছেন। ইসরায়েলের কাছে নতুন অস্ত্র বিক্রিতে আপত্তি জানিয়ে মার্কিন কংগ্রেসে নতুন প্রস্তাব উঠেছে। এসবই অভাবিত ব্যাপার।
নিউইয়র্ক টাইমস এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, শুধু মিশ্র বর্ণের ডেমোক্রেটিক সমর্থকদের মধ্যেই নয়, আমেরিকার ইহুদি তরুণদের মধ্যেও ফিলিস্তিন প্রশ্নে মনোভাবে পরিবর্তন এসেছে। তারা এখন আর এক কথায় কোনো প্রতিবাদ ছাড়াই সব ব্যাপারে ইসরায়েলকে সমর্থন করতে প্রস্তুত নয়। টাইমস-এর মতে, তরুণ মার্কিন ইহুদিরা এখন ‘আত্মপরিচয়ের সংকটে’ পড়েছে। তারা সবাই ইসরায়েলের প্রতি অনুগত, কিন্তু ফিলিস্তিনের মানুষকে যে বঞ্চনার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, সেটা তাদের পক্ষে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
এ কথার অর্থ এই নয় যে বাইডেন প্রশাসন বা মার্কিন রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্ট রাতারাতি ইসরায়েলের মাথায় ছাতা ধরে রাখার নীতি বদলাতে যাচ্ছে। অনেকেই হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার পেছনে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ‘নীরব কূটনীতি’র প্রশংসা করেছেন। যুদ্ধ শুরুর পর তাঁর প্রথম মন্তব্য ছিল, ‘আমরা ইসরায়েলের পাশে আছি।’ হামাসের ‘সন্ত্রাসী’ হামলার জবাবে নিজেদের আত্মরক্ষার পুরো অধিকার তার (অর্থাৎ ইসরায়েলের) রয়েছে। সব মার্কিন প্রশাসন সব সময় এ ভাষাতেই ইসরায়েলের সাফাই গেয়ে থাকে। কিন্তু এবার অবস্থা কিছুটা ভিন্ন। তাঁর এই একপেশে কথার কঠোর সমালোচনা করেন তাঁর দলের সদস্যরা।
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সদস্য রশিদা তালিব সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেন, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে, গাজার ফিলিস্তিনিদের কি সেই অধিকার নেই? গাজার শিশুদের কী হবে, সে প্রশ্ন তোলেন আরেক মুসলিম কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমর। নিজ দলের ভেতর থেকে প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়ে বাইডেনকে সুর বদলাতে হয়। যুদ্ধের ১১ দিনে তিনি নেতানিয়াহুকে মোট ছয়বার ফোন করে সামলে চলার পরামর্শ দেন। ১০ দিনের মাথায় প্রথমবারের মতো যুদ্ধবিরতির দাবি তোলেন। বাইডেনের অপ্রত্যক্ষ সমর্থনে হোক বা না হোক, এই সময়ের মধ্যে নেতানিয়াহু তাঁর রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্য উভয়ই হাসিল করে নেন। নিরাপত্তা পরিষদে চার-চারবার যুদ্ধবিরতির দাবি উঠেছে, ‘পেছনের দরজা দিয়ে পরিচালিত কূটনীতির’ কথা বলে বাইডেন প্রশাসন সেখানেও তার বিরোধিতা করে। সেটিও ইসরায়েলের পক্ষে যায়।
তবে সবকিছু যে আগের মতো নয়, তা বোঝা গেল যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর বাইডেন প্রথম যে বিবৃতি দেন, তাতে। সেখানে তিনি প্রথমবারের মতো ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের ‘সমান’ নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে, এ কথা বলেন। আমেরিকা কখনোই ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মানুষের ‘সমান’ অধিকার রয়েছে, এ কথা বলেনি। বলার প্রশ্নই ওঠেনি। এবার কিন্তু বাইডেনকে সে কথা বলতে হলো। এ বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি উভয়ই নিরাপদে ও পূর্ণ নিরাপত্তায় বাস করার সমান দাবিদার। তারা সমান মাত্রায় স্বাধীনতা, সমৃদ্ধি ও গণতন্ত্র ভোগের দাবিদার।’ এক দিন পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী টনি ব্লিনকেনও এক টিভি সাক্ষাৎকারে এই দুই পক্ষের সমানাধিকারের কথাটি উল্লেখ করেন।
আমেরিকা যখন ইসরায়েল ও অধিকৃত ফিলিস্তিন প্রশ্নে ‘সমান’ অধিকারের কথা বলে, তখন সেটি পরিহাস ভিন্ন আর কিছু মনে হয় না। ফিলিস্তিন সাত দশক ধরে ইসরায়েলের সামরিক আগ্রাসনের শিকার। ১৫ বছর ধরে গাজায় চলছে ইসরায়েলের পূর্ণ অবরোধ। পশ্চিম তীর বা গাজায় প্রতিটি মানুষকে ইসরায়েলের সামরিক প্রহরাধীনে থাকতে হয়, তার অনুমতি ছাড়া এক পা নড়ার ক্ষমতা নেই কারও; এমনকি মাহমুদ আব্বাসেরও। আমেরিকার সামরিক ও রাজনৈতিক মদদেই তো সম্ভব হয়েছে এই নিপীড়ন।
সবাই জানে, ইসরায়েল এই অঞ্চলে সবচেয়ে শক্তিশালী ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্রতিবছর প্রায় চার বিলিয়ন ডলারের সামরিক সাহায্য জুগিয়ে থাকে। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনিদের জন্য আমেরিকার রয়েছে বছরে মোট ২৩৫ মিলিয়ন ডলারের অনুদান। সমানাধিকার অনুপাতটি এখান থেকেই হিসাব করা সম্ভব। বাইডেন বলেছেন, ‘আয়রন ডোম’ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কারণে ইসরায়েল হামাসের রকেট হামলা ঠেকাতে সম্ভব হয়। এ কাজ করতে গিয়ে তার যে পরিমাণ ব্যাটারি ব্যয় হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তা পুষিয়ে দেবে। ফিলিস্তিনিদের যদি নিরাপত্তার সমানাধিকার থাকে, তাহলে তো ইসরায়েলি হামলা ঠেকাতে তাদেরও আয়রন ডোমের মতো প্রযুক্তি দরকার। যুক্তরাষ্ট্র কি তা দেবে?
● হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক