ফিরিয়ে দাও জাহালমের তিনটি বছর
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাজ কেউ দুর্নীতি করলে তাকে বিচারের জন্য সোপর্দ করা। সে জন্য দুদক সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে, তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তার নামে মামলা করতে পারে; এমনকি সেই মামলায় যাতে দুর্নীতিবাজের বিচার হয়, সে বিষয় আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়াও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। তবে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ছাড়া দুদকের মামলায় চূড়ান্ত বিচারে দণ্ডিত হয়েছে, এ রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই।
টাঙ্গাইলের জাহালম একজন পাটকলশ্রমিক। গরিব মানুষ। যিনি কোনো দিন ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেননি, তাঁর আর্থিক যে অবস্থা, তাতে হয়তো তাঁর নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে কি না, সে বিষয়েও সন্দেহ আছে। তারপরও দুদক তাঁকে ভয়ংকর ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করে ৩৩টি মামলা দিয়েছে। আর সেই মামলায় তাঁকে তিন বছর বিনা বিচারে জেলে আটকও থাকতে হয়েছে। সোনালি ব্যাংক থেকে সাড়ে ১৮ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলেন আবু সালেক নামের এক লোক। কিন্তু দুদক সালেকের স্থলে জাহালমকে জেলে ঢুকিয়ে বলেছে, তুমিই অপরাধী।
জাহালম যতই বলেছেন, ‘আমি সালেক না, আমি কোনো ব্যাংক থেকে ঋণ নিইনি।’ কিন্তু দুদক ও পুলিশ জোর দিয়ে বলেছে, ‘না, তুমিই সালেক, তোমাকেই জেল খাটতে হবে। শাস্তি পেতে হবে।’
দুদক বড় বড় দুর্নীতিবাজকে ধরতে পারে না, কিন্তু জাহালমের মতো নিরীহ মানুষকে জেল খাটাতে পারে। এই না হলে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন!
জাহালমকে হয়তো আরও দীর্ঘদিন জেল খাটতে হতো। গত ২৮ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি সেদিন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। শুনানি নিয়ে আদালত জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করেন।
একই সঙ্গে নিরীহ জাহালমের গ্রেপ্তারের ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্রসচিবের প্রতিনিধি ও আইনসচিবের প্রতিনিধিকে ৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় সশরীরে আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এরই ধারাবাহিকতায় নির্ধারিত দিন দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি হিসেবে দুদকের মহাপরিচালক (তদন্ত), মামলার বাদী আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, স্বরাষ্ট্রসচিবের (সুরক্ষা) প্রতিনিধি যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেন এবং আইনসচিবের প্রতিনিধি সৈয়দ মুশফিকুল ইসলাম আদালতে হাজির হন।
আদালত দুদকের আইনজীবী ও প্রতিনিধিকে জিজ্ঞাসা করেন, যে তদন্ত কর্মকর্তারা জাহালমের নামে ভুলভাবে অভিযোগপত্র দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দুদক কী ব্যবস্থা নিয়েছে?
এরপর আদালত বলেন, ‘আপনারা অভ্যন্তরীণভাবে ব্যবস্থা নিলে আমাদের হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজন হবে না। আর সেটি না হলে আমরাই ব্যবস্থা নেব। জাহালমের ঘটনায় দুদক বা ব্যাংককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’ শুনানিতে দুদকের আইনজীবী স্বীকার করেন, জাহালম ঋণগ্রহীতা নন। তিনি পাটকলের একজন শ্রমিক। বিষয়টি গত ডিসেম্বরে যখন তাঁদের নজরে আসে, তখনই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে দুদক। কিন্তু বাস্তবে সেই গুরুত্বের কোনো লক্ষণ নেই। গত ২৪ মে মানবাধিকার কমিশন জাহালম যে সালেক নন, সেটি জানিয়ে দুদককে চিঠি লেখে। এরপরও আট মাস চলে গেছে।
প্রথম আলোয় আসাদুজ্জামানের এই প্রতিবেদন ছাপা না হলে হয়তো জাহালম এখনো কারাগারে থাকতেন। এ জন্য প্রথম আলো ও আসাদুজ্জামান ধন্যবাদ পেতে পারেন। আসাদুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এফ রহমান হলে ২০১০ সালে নিহত ছাত্র আবু বকর সিদ্দিককে নিয়েও এ রকম একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন। যাতে দেখা যায়, আবু বকর সিদ্দিক খুন হয়েছেন। কিন্তু তাঁকে কেউ খুন করেননি। মামলার সব আসামি বেকসুর খালাস পেয়ে গেছেন।
হাইকোর্ট বলেছেন, একমুহূর্তও আর জাহালমের কারাগারে থাকা উচিত নয়। এরপর গতকাল রাতেই তাঁকে কাশিমপুরে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।
কারাগার থেকে ভাই শাহানূরের সঙ্গে আজ সোমবার ভোররাত চারটায় গ্রামের বাড়িতে আসেন জাহালম। এ সময় তাঁদের মা মনোয়ারা বেগম ছেলেকে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। জাহালমের কপালে চুমু দিয়ে চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘কার মাথায় বাড়ি দিছিলাম যে আমার এত বড় সর্বনাশ করেছিল!’
মনোয়ারা যখন জড়িয়ে ধরে বিলাপ করছিলেন, তখন জাহালমকে জড়িয়ে ধরেছেন বোন শাহানা ও তাসলিমা। তাঁরাও তখন চিৎকার করে বিলাপ করছিলেন। মনোয়ারা বারবার বলতে থাকেন, ‘আমার সোনার ব্যাটা বিনা দোষে তিন তিনটা বছর জেল খাটল। আমার সোনার ব্যাটা আজ বাড়ি ফিরল।’ জাহালমকে কাছে পেয়ে মা মনোয়ারা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানষে আমার সর্বনাশ করেছে, আল্লাহ তাগো বিচার করো।’
এর আগে জেল থেকে বের হয়ে কাশিমপুর কারাফটকে সাংবাদিকদের জাহালম বলেন, ‘কখনো বিশ্বাস করতে পারিনি ছাড়া পাব।’ বিনা দোষে জেল খাটতে হলো। এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেন জাহালম। সে সময় হাইকোর্টকে ধন্যবাদ জানান জাহালম। একই সঙ্গে তিনি প্রথম আলো ও মানবাধিকার কমিশনকেও ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
জাহালম বিনা দোষে ১ হাজার ৯২ দিন কারাগারে ছিলেন। তিনি এখন মুক্ত মানুষ। কিন্তু তাঁর জীবন থেকে যে তিনটি বছর ঝরে গেল, তার ক্ষতিপূরণ কে দেব?
আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক প্রথম আলোর কলামে লিখেছেন, দুদককেই এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আমরাও মনে করি, যেহেতু মামলাটি দুদক তদন্ত করেছে, তারাই সালেককে জাহালম বানিয়ে জেল খাটিয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এটি নিছক কাগজপত্রের ভুল নয়; ইচ্ছেকৃত ভুল। এর সঙ্গে প্রকৃত আসামি ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে কি না, তাও ক্ষতিয়ে দেখতে হবে। যারা নির্দোষ জাহালমকে বিনা অপরাধে জলে খাটিয়েছে, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
জাহালমের ঘটনায় অগ্রদূত পরিচালিত ‘সবার উপরে’ চলচ্চিত্রের অভিনেতা ছবি বিশ্বাসের সেই বিখ্যাত সংলাপই মনে পড়ে, ‘ফিরিয়ে দাও আমার ১২টি বছর।’ জাহালমের জীবনের ১ হাজার ৯২দিন ফিরিয়ে দিন।
একটি পত্রিকায় দেখলাম, জাহালমকে ফাঁসিয়েছেন দুদকের যে নয় কর্মকর্তা, তাঁদের আটজনেরই পদোন্নতি হয়েছে। এখানে দেখা যাচ্ছে, সরষের ভেতরেই ভূত আছে। এই ভূত তাড়ানোর জন্য দুদকেই একটি শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন।
জাহালমের জীবনের তিনটি বছর কে ফিরিয়ে দেবে?
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]