ফাহিম সালেহ খুন: কী হয়েছিল তাঁর?
গত বছর ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন টেক মিলিওনিয়ার তুষার আত্রে অপহৃত হয়েছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রশান্ত মহাসাগরের মুখোমুখি নিজ বাড়ি তিন মাইল দূরে গাড়িতে গুলিবিদ্ধ তুষারকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে নিজ বাড়িতে খুন হয়েছিলেন কানাডিয়ান ওষুধ কোম্পানি অ্যাপোটেক্সের মালিক ব্যারি শেরমেন ও তাঁর স্ত্রী হানি। এসব হচ্ছে কাছাকাছি সময়ে খুন হওয়া মিলিওনিয়ার বা ধনবানদের গল্প। তুষার হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজনদের আটক করা হয়েছে। কিন্তু অ্যাপোটেক্সের মালিকের খুন হওয়ার কারণ জানা যায়নি। বা কেউ কেউ হয়তো জানে। এদিক থেকে ব্যতিক্রম ইতালির খুন হওয়া কাপড় ব্যবসায়ী লিবেরো গ্রাসি। চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় মাফিয়াদের হাতে খুন হন তিনি ১৯৯১ সালে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে খুন হয়েছেন অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী, ধনকুবের। খুন হওয়া এসব ধনবানদের তালিকায় যুক্ত হলো আরও একটি নাম। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ী ফাহিম সালেহ।
ফাহিমের হত্যাকারী সন্দেহে একজনকে আটক করেছে নিউইয়র্ক পুলিশ। বলা হচ্ছে, ডলার চুরির দায় এড়াতে ফাহিমের ব্যক্তিগত সহকারী টাইরেস হ্যাসপিল তাঁকে হত্যা করেন। হ্যাসপিলের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। হয়তো তাঁর সাজাও হবে। কিন্তু এরপরও গল্পের ডালপালা ছড়াবে। ফাহিমের মতো একজন মেধাবী উদ্যোক্তা মাত্র ৯০ হাজার ডলারের জন্য খুন হয়ে গেলেন। চুরি করা ডলারগুলো ফাহিম কিস্তিতে টাইরেসকে ফেরত দিতে বলেছিলেন। কিন্তু টাইরেস তাঁকে খুন করে বসলেন। ঘটনা প্রকৃতপক্ষে যদি এমনই হয়ে থাকে, তবে ভালো। কিন্তু টাইরেসের সঙ্গে অন্য কেউ যুক্ত নেই তো? টাইরেস কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিলেন কি না, তা খতিয়ে দেখছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিকিউশন।
ফাহিমের ব্যবসা নানা ধরনের উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে গেছে। এটা খুবই স্বাভাবিক। দেশেও তিনি শুরুর দিকে সফল হতে পারেননি। কিন্তু পরে অন্য দুজনের সঙ্গে পাঠাও প্রতিষ্ঠা করে সফল হয়েছিলেন। সফল একটি উদ্যোগের শেয়ার বিক্রি করে তিনি অন্যত্র বিনিয়োগে আগ্রহী হয়েছিলেন। ফাহিম কেন পাঠাও ছেড়ে গেলেন, সেটা এক বড় কৌতূহলের বিষয়। এটা আমরা জানি না। ঢাকার গণমাধ্যমেও এ–সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। ফাহিম কেন লাভজনক উদ্যোগ থেকে বিনিয়োগ সরিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ নিয়ে আগ্রহী হলেন, তার একটি সরল উত্তর হতে পারে, তিনি অন্যত্র বিনিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে তিনি পছন্দ করতেন। কিন্তু বাংলাদেশ ছাড়ার অন্য কোনো কারণ আছে কি না, সেটাও আমাদের জানা দরকার। আমরা কি ফাহিমকে ধারণ করতে পারিনি। ফাহিমকে দেখে অন্য প্রবাসী বাংলাদেশিরা আগ্রহী হতে পারতেন। ফাহিমের মতো অনাবাসী বাংলাদেশিদের আমাদের বেশি করে দরকার। নতুন নতুন উদ্যোগ নিয়ে দেশে আসতে পারতেন এই অনাবাসী বাংলাদেশিরা। নতুন নতুন উদ্যোগ মানেই নতুন নতুন কর্মসংস্থান। ফাহিম হতে পারতেন আমাদের বিল গেটস বা মার্ক জাকারবার্গ।
কিন্তু তরুণ উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহর জীবনপ্রদীপ নিভে গেল খুব অল্পতেই। অনেক কিছুই করার বাকি ছিল। অল্প বয়সেই সাড়া জাগিয়েছিলেন প্রতিভাবান এই টেক উদ্যোক্তা। অনাবাসী বাংলাদেশি প্রজন্ম এখন ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান করে নিচ্ছে বিশ্ব পরিমণ্ডলে। ফাহিম সালেহ এর বড় উদাহরণ। ফাহিমরা দেশের টানে ফিরে আসেন। কিন্তু আমরা তাঁদের ধরে রাখতে পারি না। এরপর তাঁরা ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, খুন, জখমের পাকচক্রে হারিয়ে যান। ফাহিমের পাঠাও প্রতিষ্ঠার পেছনে অবশ্যই ব্যবসায়িক কারণ ছিল। কিন্তু ফাহিমের চিন্তা ও উদ্যোগের কারণে নতুন বা বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। আমরা সবাই বলতে পছন্দ করি এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। কিন্তু বিশাল বিশাল টেক পার্ক বা ভবন নির্মাণ করা ছাড়াও তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে কীভাবে আয়ের পথ খুলতে হয়, ফাহিম তা সহ–উদ্যোক্তাদের সঙ্গে নিয়ে বাস্তবে করে দেখিয়েছেন। দেশে এই ধরনের বিনিয়োগের নতুন দ্বার উন্মোচন করেছিলেন ফাহিমসহ অন্যরা। পাঠাওয়ের মাধ্যমে যাঁরা রাইড শেয়ারিং ব্যবসায় যুক্ত হতে চাইতেন, তাঁদেরও স্বল্প বিনিয়োগ করতে হতো। অনেকেরই নতুন বা বাড়তি আয়ের পথ করে দিয়েছিল পাঠাও। সন্দেহ নেই পাঠাও সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
ফাহিমরা যখন ফিরে যাচ্ছেন, অনাবাসী ভারতীয় তখন দেশে ফিরতে চাইছেন। দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে দেশে ফেরার তাড়া যেন ক্রমেই বাড়ছে। ভারতও যথাসাধ্যভাবে তাঁদের স্বাগত জানাচ্ছে। গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিছাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমরা এখনো ভারতীয়দের থেকে এসব ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। ফাহিমের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমাদের মধ্যে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া দেখলাম না। বিশেষ করে সরকারি পর্যায়ে কোনো ধরনের নড়াচড়া চোখে পড়েনি কেবল শোক প্রকাশ করা ছাড়া। সব জায়গা থেকেই প্রতিবাদ আসা উচিত ছিল। ফাহিমের হত্যাকারীকে আটক করা হয়েছে। এখন কি প্রতিবাদের কোনো সুযোগ আছে? যতটুকু জানি তুষায় আত্রের হত্যাকাণ্ডের পর ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। বছর দশেক আগে ভারতীয় এক শিক্ষার্থীকে বর্ণবাদীরা হত্যা করলে দিল্লিতে অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশন ঘেরাও করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। এরপর ভারতীয়দের সম্পর্কে সতর্ক হয়ে যায় অস্ট্রেলিয়রা।
গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে ফাহিম যুক্তরাষ্ট্রেই থিতু হতে পারতেন। ভালো চাকরিও জুটিয়ে নেওয়া খুব করেই সম্ভব ছিল। কিন্তু তিনি তা না করে পূর্বপুরুষের ভিটায় ফিরে আসেন। এসে শেষ পর্যন্ত এমন একটি উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যাতে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল। ফাহিম যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তাঁর হয়তো বাংলাদেশি পাসপোর্ট ছিল না। কিন্তু দেশপ্রেমের জন্য পাসপোর্ট লাগে না। বুকের ভেতরে অনুভূতিটুকু থাকলেই হয়। ফাহিম সেই অনুভূতি দিয়ে সবাইকে নাড়া দিয়েছেন।
মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক