ফরাসি প্রতিবিপ্লব ও মাখোঁর ‘মুসলিম’ সমস্যা

তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁর বক্তব্যের কড়া জবাব দিয়েছেন। এ থেকে নিজ নিজ দেশে লাভবান হচ্ছেন দুজনই।এএফপি

১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের মন্ত্র ছিল সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা। ফ্রান্সে ভ্রাতৃত্ব শব্দ উচ্চারিত হলে এশিয়া–আফ্রিকার মুক্তিকামী জাতিগুলো থেকে প্রতিধ্বনি শোনা যেত...তৃত্ব তৃত্ব তৃত্ব। এখন আর তেমনটা শোনা যায় না। এখন শোনা যায় ঘৃণার বাণী।

প্যারিসে একটা দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। এক ফরাসি স্কুলশিক্ষক এবং এক চেচেন পরিচয়ধারী যুবকের লাশ পাওয়া গেছে। ফরাসি পুলিশ বলছে, স্কুলশিক্ষককে গলা কেটে হত্যা করেছে ওই চেচেন যুবক। চেচেন যুবককে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ গুলি করে হত্যা করায় তার ভাষ্য আর পাওয়ার উপায় নেই। খেয়াল করার বিষয় আমেরিকার টুইন টাওয়ার, ফ্রান্সে ২০১৫ সালে ট্রাক চাপিয়ে হত্যা, শার্লি এবদো অ্যাটাক এবং এবারের শিক্ষক হত্যা—সবগুলোতেই হামলাকারীরা ঘটনাস্থলেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন। ফলে তাদের জবানবন্দি পাওয়ার সুযোগ নেই। যাহোক, চেচেন যুবকটি মুসলিম। আর স্যমুয়েল প্যাটি নামের ওই স্কুলশিক্ষক অবাধ বাক্‌স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তিনি তাঁর স্কুলের কোমলমতি শিশুদের কড়া ইসলামবিদ্বেষী রম্য পত্রিকা শার্লি এবদোয় ছাপা ইসলামের মহানবীর জন্য অবমাননাকর কিছু ছবি ক্লাসরুমে দেখিয়েছিলেন। এ নিয়ে মুসলিম বাচ্চাদের অভিভাবকেরা আপত্তি জানিয়েছিল।

চেচেন যুবক এই গল্পের ভেতর কীভাবে ঢুকে গেল তা স্পষ্ট না। কিন্তু তাকেই পাওয়া গেছে ফরাসি ওই স্কুলশিক্ষকের হত্যাকারী হিসেবে। ফরাসি গণমাধ্যমে ঘটনাটিকে একজন ব্যক্তির হত্যাকাণ্ডের ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখা হচ্ছে না। একে দেখা হচ্ছে মুসলমানদের অপরাধ হিসেবে। এ ঘটনায় ফরাসি সমাজে তুমুল আলোড়ন জেগেছে। প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ নিহত শিক্ষককে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছেন এবং ‘ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদ’ (Islamic separatism)–এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। সংসদে ‘ইসলামি বিচ্ছিন্নতাবাদ’ বিরোধী নতুন আইনের বিল এনেছেন এবং ফরাসি ‘ইসলামের’ সংস্কারের প্রতিজ্ঞা জানিয়েছেন।

কোনো ঘটনাই আকাশ থেকে পড়ে না। এর আগের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি দেখা যাক।  

ফ্রান্সে ইহুদীবিদ্বেষ এখন রূপ নিচ্ছে ইসলামবিদ্বেষে। এ থেকে ফায়দা ওঠাচ্ছেন রাজনীতিবিদেরা। ফরাসি প্রেসিডেন্টের উক্তির বিরুদ্ধে তুরস্কের বিক্ষোভ
এএফপি

প্রেসিডেন্ট মাখোঁর ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা

গত সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্সের একটি খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান—আইপিএসওএস, জাতীয়ভাবে চালানো একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে। নষ্টের গোড়া ওই জরিপের ফল। তাতে দেখা যায়, ৭৮ ভাগ ফরাসি মনে করে প্রেসিডেন্ট মাখোঁর আমলে ফ্রান্স পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ২৭ ভাগ এতই হতাশ, তারা মনে করে, এই অধঃপতন আর ঠেকানো যাবে না। আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর বেশি দিন নেই। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মাখোঁ তিনটি গুরুতর জায়গায় শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ। করোনা মহামারি মোকাবিলা, (প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতোই তাঁর সরকার মাস্ক পরা জরুরি নয় বলে অপরাধমূলক অবহেলার দায়ে অভিযুক্ত), মাখোঁর ভুল অর্থনৈতিক নীতির জন্য ফরাসি অর্থনীতির ঐতিহাসিক মন্দা এবং ট্রাম্পের মতোই ফরাসি সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ধনিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষা। এসবের পুরস্কার হলো ফ্রান্সের ইতিহাসের সবচেয়ে অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্টের খেতাব।

২০১৫ সালের প্যারিসে হামলার এক দিন আগে ফরাসি জরিপ সংস্থা আইএফওপির (IFOP) একটি জরিপের ফল প্রকাশিত হয় প্রখ্যাত লা ফিগারো পত্রিকায়। ওই জরিপে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আবশ্যকীয় সংস্কার বাস্তবায়নে ফরাসিরা অগণতান্ত্রিক ধরনের সরকার মেনে নেবে কি না? ৬৭ শতাংশ অনির্বাচিত টেকনোক্র্যাটদের পক্ষে বলেছে। ৪০ শতাংশের পছন্দ অনির্বাচিত কর্তৃত্ববাদী সরকার। শার্লি এবদোর একটি সন্ত্রাসী ঘটনা ফরাসি জনমতকে কতটা বদলে দিয়েছিল, এই জরিপ তার ইঙ্গিত দেয়। বলা বাহুল্য, ফ্রান্সে এখনো অনেকগুলো নাগরিক অধিকার সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাতে স্থগিত রয়েছে। জঙ্গি হামলাকারীরা যে উদ্দেশ্যেই কাজ করুক, তারা আখেরে তাদের ঘোষিত শত্রুদের পক্ষেই অঘোষিতভাবে কাজ করে। কারণ তাতে লাভবান হয় অগণতান্ত্রিক শাসকেরা।

আগামী নির্বাচনে ভরাডুবির আশঙ্কায় মাখোঁর দরকার ছিল জনগণের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরানো। এ লক্ষ্যে পয়লা অক্টোবরে তিনি ফরাসি মুসলিমদের নিশানা করে বিচ্ছিন্নতাবাদবিরোধী বিল আনলেন।

ফ্রান্সের একচোখা ‘ইসলাম’ দর্শন

মুসলমানরা ফ্রান্সের মূল সংখ্যালঘু ধর্মীয় জনগোষ্ঠী। জনসংখ্যায় তারা প্রায় ৭০ লাখ এবং শতকরা হিসাবে জনগণের সাড়ে ৭ শতাংশ। এরা মূলত ফ্রান্সের সাবেক উপনিবেশ আলজেরিয়া, মরক্কো ইত্যাদি উত্তর আফ্রিকীয় দেশ থেকে আসা। ঔপনিবেশিক আমলে একসময় ফরাসি ভূখণ্ডে এসে পৌঁছানো আলজেরীয়দের ফ্রান্সের নাগরিক হিসবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর বড় অংশ তারাই। ফ্রান্স যদি তাদের দেশ লুণ্ঠন না করত, তাহলে তাদের ফ্রান্সে আসার প্রয়োজন হতো না। তা ছাড়া শ্রমশক্তির ঘাটতি মেটাতে ফ্রান্সেরও তাদের দরকার ছিল। এত কিছুর পরও শত শত বছর সহাবস্থান করেও ফরাসি রাষ্ট্র তার মুসলিম নাগরিকদের সমান ভাবতে পারেনি।

ফরাসি মুসলমানদের বড় অংশই দরিদ্র বস্তিবাসী, তাদের ৩০ শতাংশই বেকার। মুসলিমবিদ্বেষী মনোভাবের কারণে তাঁরা বেসরকারি চাকরি পান না তেমন, আর সরকারও অনুদার। বিদ্যালয়গুলোতে মুসলিম শিশুরা কোনো ধর্মীয় পোশাক বা চিহ্ন বহন করতে পারে না। ফ্রান্সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঘটা ইহুদি গণহত্যা তথা হলোকস্ট নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও ইসলামের মহানবীকে নিয়ে যা–তা বলা বা আঁকা অনুমোদিত। ফরাসি সেক্যুলারিজম যদি সত্যিই নিরপেক্ষ হতো, তাহলে সাবেক প্রেসিডেন্ট সারকোজির পুত্রের সঙ্গে ধনী ইহুদি–কন্যার বিয়ে নিয়ে ওই শার্লি এবদো পত্রিকায় রম্য রচনা লেখার দায়ে চাকরি চলে যেত না এক লেখকের। ফ্রান্সে ধর্ম ও রাষ্ট্রের দূরত্ব কঠোরভাবে মান্য করা হয়। অথচ ২০১৩ সালে টাউন হলের মতো পাবলিক জায়গায় যিশুখ্রিষ্টের জন্মদৃশ্যের মঞ্চায়ন ঘটিয়েও আইনের বাইরে থেকে যান মার্সেই শহরের মেয়র।

ফরাসি সেক্যুলারিজমের সংখ্যালঘু সমস্যা ঐতিহাসিক। উনিশ শতক থেকে বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত ফ্রান্স তার সেক্যুলারিজমকে দেখতে পেয়েছে ইহুদি সংখ্যালঘুদের বিপরীতে। ফরাসি ইহুদিরা একসময় বৈষম্য আর বঞ্চনার শিকার হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে উপনিবেশ থেকে আসা মুসলমানেরা হয়ে ওঠে নতুন সংখ্যালঘু। ভিন্ন চিন্তা, বিশ্বাস বা পোশাকের মানুষের প্রতি সম্মান রাখা বাক্‌স্বাধীনতার চেয়ে কি কম গুরুত্বপূর্ণ? বাক্‌স্বাধীনতা যদি মানি, তাহলে ধর্ম পালনের স্বাধীনতাও মানতে হয়। ফরাসিদের কাছে সেটা আরও বেশি করে চাওয়া হয় এ কারণে যে, তারাই তো সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার জন্য বিপ্লব করেছিল, রক্তক্ষয় করেছিল।

ফরাসি বিপ্লব ও ইসলামের মৈত্রী

আরও আকর্ষণীয় বিষয় হলো এই ফরাসি মুসলমানদের সাম্যের মর্যাদা দিয়েছিল খোদ ফরাসি বিপ্লবের একটা সিদ্ধান্ত। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের জাতীয় পরিষদে মুসলমানদের পূর্ণ নাগরিক মর্যাদা দেওয়া হয়। ওই ডিক্রির বলে ফরাসি মুসলমানরা পূর্ণ নাগরিক হিসেবে সামরিক ও প্রশাসনিক সব পদে বসতে এবং নির্বাচনে দাঁড়াতে পারত। ফরাসি বিপ্লবের নেতা রোবসপিয়ের ইসলামের সাম্যের দ্বারা উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন। সে সময় শিল্পীর আঁকা এক ছবিতে এক বিপ্লবী নেতাকে ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তালমুদ ও ইসলামের কোরআন ধরে থাকতে দেখা যায়। ফরাসি বিপ্লবে মুসলমানরাও জড়িত ছিল। বিপ্লবীরাও বিপ্লবের আহ্বান আরবিতে প্রকাশ করে।গুজরাটের নওয়াবের পুত্র আহমেদ খান ১৭৯৪ সালে প্যারিসে গিয়ে বিপ্লবে সংহতি জানান এবং ভারতের স্বাধীনতার প্রেরণা পান। ফিরে এসে তিনি ফরাসি বিপ্লবের ঘোষণা ফারসিতে অনুবাদ করেন। ফরাসি বিপ্লব ৯০ দিনও টিকতে পারত না যদি উত্তর আফ্রিকার মুসলিম শাসক মোহাম্মদ ঘেইস জাহাজভর্তি করে গম না পাঠাতেন। সে সময় দক্ষিণ ফ্রান্সে দুর্ভিক্ষ চলছিল। রাজতান্ত্রিক ইউরোপ যখন বিপ্লব ধ্বংসের জন্য লড়ছে, তখন একমাত্র মুসলিম দুনিয়াই ছিল ফ্রান্সের পক্ষে। ১৭৯৫ সালে বিপ্লবী কমিটি ইসলামের ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তধর্মীয় চুক্তি আরবি থেকে ফরাসিতে অনুবাদ করার ঘোষণা দেয়। নেপোলিয়ন তরুণ বয়সের নায়ক ছিল খোরাসানে বোরকাই নামে মুখ ঢাকা এক রাজপুত্র।

২০০৫ সালের প্যারিসের গরিবদের অভ্যুত্থান, যাকে বলা হয় ‘প্যারিস রায়ট’ এবং ২০১৯ সালের ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন ছিল বামঘেঁষা। তাদের বিভক্ত করতে তৈরি করা হলো ‘মুসলিম সমস্যা’।
এএফপি

দরিদ্র ও বেকারদের বিক্ষোভ এড়াতে ‘মুসলিম জুজু’ আবিষ্কার

বিপ্লবী ফ্রান্স যদি ইসলামবান্ধব থাকে তাহলে আজকের ফ্রান্সকে বলতে হবে প্রতিবিপ্লবী। শার্লি এবদো পত্রিকার ইসলামবিদ্বেষী লাগাতার কার্টুন প্রকাশ, মূলধারার পত্রিকায় মুসলমানবিরোধী প্রচারণা, টেলিভিশনের টক শোতে অসত্য প্রচারণা, ভুয়া সংবাদ ইত্যাদির মাধ্যমে ফরাসি জনতাকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাতিয়ে তোলা হয়। ২০১৬ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ফ্রান্সে পুলিশ অভিযানের সময় মুসলমানদের ওপর অতিরিক্ত দুর্ব্যবহার ও নিপীড়নের অভিযোগ করে। ২০১৬ সালের নভেম্বরের সন্ত্রাসী হামলার পর ৩৫ শ মুসলিম বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদবিরোধী মামলা হয় মাত্র ৬টি।

আজকের ফ্রান্সে যে জঙ্গিবাদ বনাম ইসলামবিদ্বেষ দেখা যাচ্ছে, তা এমন ছিল না। ফ্রান্সের লড়াই ছিল পুঁজিবাদ বনাম জনতার। ২০০৫ সালের প্যারিসের গরিবদের অভ্যুত্থান, যাকে বলা হয় ‘প্যারিস রায়ট’ এবং ২০১৯ সালের ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলন ছিল বামঘেঁষা। ডানেরা তো বসে থাকবে না। ফরাসি এলিট মহল নিজেদের শক্তি বাড়াতে ইসলামোফোবিয়ার জাল ছড়াল। তৈরি করা হলো ‘মুসলিম সমস্যা’। এদেরই প্রতিনিধি হিসেবে উঠে এলেন উগ্র জাতীয়তাবাদী বর্ণবাদী ল প্যেঁন। গরিব, অভিবাসী, তরুণদের জোটকে ছত্রভঙ্গ করতে অনেকটাই সফল হয়েছে এই মেকি ‘মুসলিম সমস্যা’। ফরাসি ডানপন্থীরা এ পথেই তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দেখছে। তারা দেখতে পাচ্ছে না যে রাষ্ট্রের মদদে ইসলামবিদ্বেষের সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোতে সামরিক হামলার পরিস্থিতিই জঙ্গিবাদের জন্মদাতা।

এই হাওয়াতেই পাল তুলে দিয়েছেন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ব্যর্থ এমানুয়েল মাখোঁ। জনগণের আসল সমস্যা থেকে দৃষ্টি সরাতে তিনি নিয়ে আসছিলেন ‘ইসলামি বিচ্ছিন্নতার’ তত্ত্ব এবং মুসলিমবিরোধী আইন। যেই মুসলিম এনজিও এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো এর সমালোচনায় নামল, অমনি তিনি পেয়ে গেলেন মোক্ষম জঙ্গি হামলার উদাহরণ। হামলার সুযোগে তিনি অনেক মুসলিম প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলেন, পুলিশের লাগাম ছেড়ে দিলেন। এক জরিপে দেখা গেছে, ফরাসি পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর ৫০ শতাংশই বিগত স্থানীয় নির্বাচনে ডানপন্থীদের ভোট দিয়েছে। ফ্রান্সে যে ইহুদিবিদ্বেষ তথা অ্যান্টিসেমেটিজমের ভাইরাস ছিল, সেটারই জায়গা নিচ্ছে ইসলামবিদ্বেষ। যে ফ্রান্স ইহুদিদের তাড়িয়ে সেক্যুলার হয়েছিল, তাদের সেই সেক্যুলারিজম এখন খামাখাই মুসলমানদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

মুসলমানরাও বিশ্বমানবতার নেতা হতে পারে

কিন্তু ব্যক্তির দায়ে কোনো জনগোষ্ঠীকে দোষ দেওয়া যেমন চলে না, তেমনি মাখোঁরাই ফ্রান্স নন, ইউরোপ নন। শার্লি এবদোয় হামলার পর ৪০টি দেশের রাষ্ট্রনেতা প্যারিসে র‌্যালি করে উচ্চারণ করেছেন, ‘আমিও শার্লি এবদো।’ কিন্তু নিউজিল্যান্ডের মসজিদে গুলি করে ৫০ জন মুসলিম হত্যার পরে কিন্তু দুনিয়াজুড়ে সেই সংহতি দেখা যায়নি, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা ছাড়া কেউ কেউ প্রতীকীভাবেও বলেননি ‘আমি মুসলমানদের সঙ্গে আছি’।

দুনিয়ার সবাইকে শত্রু ভেবে মুসলমানরাও চলতে পারবে না। অমুসলিমদের হৃদয়ে যেমন মুসলমানদের জায়গা থাকতে হবে, তেমনি মুসলমানদের হৃদয়ে অমুসলিম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা দরকার। যেকোনো জঙ্গি হামলাকে নিঃশর্তভাবে নিন্দা জানালেই চলবে না, নিজেদের সমাজকেও এই প্রবণতা থেকে মুক্ত রাখতে কাজ করে যেতে হবে। মনে রাখা জরুরি, কোনো মুসলিমের দ্বারা ঘটানো নাশকতার প্রধান শিকার হয় মুসলিম সংখ্যালঘুরাই। তেমনি সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণার রাজনীতি শেষ পর্যন্ত সংখ্যাগুরুকে অন্ধকার সুড়ঙ্গের দিকে দীর্ঘকালের জন্য টেনে নিয়ে যায়। হিটলারের ইহুদিবিদ্বেষের ফল জার্মানির জন্য বিপর্যয়কর হয়েছিল। ভারতে মুসলিমবিদ্বেষের ঢেউ সাধারণ ভারতীয়দের জীবনকে পিছিয়ে দিচ্ছে, গণতন্ত্রকে নিয়ে গেছে খাদের কিনারে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর চিন্তার স্বাধীনতা এক নয়। মত ব্যক্তির এবং তা অহং বা ইগোর মসলামাখা হতে পারে। চিন্তা নৈর্ব্যক্তিক, যৌথ এবং নিরপেক্ষ যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। চিন্তার যোগ্যতা এবং স্বাধীনতা ছাড়া মুসলিমরা দুনিয়ায় তাদের অধিকার কায়েম করতে পারবে না। ধর্মবিদ্বেষ মতপ্রকাশের নামে ঘৃণার বিকার, কিন্তু চিন্তার স্বাধীনতা আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। বাক্‌স্বাধীনতা মানুষের জীবন ও বিশ্বাসের চেয়ে বড় হতে পারে কি না, তা নিয়েও চিন্তকেরা ভাবছেন। বাক্‌স্বাধীনতার উদ্দেশ্য যদি অশ্রদ্ধা ও ঘৃণার বাজার বসানো হয়, তাহলে সেটা কানার হাটবাজার হয়ে উঠতে বাধ্য।

যে ফ্রান্স মানবতার দিশারি ছিল, সেই ফ্রান্স বিপ্লবী। ফরাসি ডানপন্থীরা এবং তাদের প্রেসিডেন্ট মাখোঁ বিদ্বেষের রাজনীতি করে ফ্রান্সকেই প্রতিবিপ্লবী করে তুলছেন। মাখোঁ ভুলে গেছেন তিনি শুধু একটি দেশের প্রেসিডেন্ট নন, তিনি ইউরোপেরও নেতা। ইউরোপের মুসলিমবিদ্বেষের জ্বালামুখ খুলে দিয়ে তিনি রাষ্ট্রনায়কোচিত কাজ করেননি। কিন্তু ফরাসি প্রতিবিপ্লবের উসকানিতে নিজেদেরও প্রতিবিপ্লবী হতে দেওয়া কাজের কথা না। প্রতিটি মৃত্যুই মানুষের মৃত্যু, প্রতিটি শিশুই মানবতার শিশু। প্রতিটি দেশই মানুষের দেশ। মানুষের বিশ্বাস ও পরিচয়ের মর্যাদা ছাড়া মানবিক পৃথিবী আশা করা যায় না।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।

[email protected]

আরও পড়ুন