ফরাসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মধ্যপন্থী প্রার্থী ইমানুয়েল ম্যাখোঁর বিজয় কেবল ফ্রান্সের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্যই সম্ভবত আশাব্যঞ্জক সংবাদ এই কারণে যে সারা পৃথিবীতে লোকরঞ্জনবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদের যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছিল, তাতে একটা বাধা তৈরি হয়েছে। এর আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেশের এবং দেশের বাইরে এতটা গুরুত্ব বহন করেছে, এমন কথা কেউ স্মরণ করতে পারবেন না। এই নির্বাচনের প্রতিক্রিয়া একাদিক্রমে ফ্রান্স এবং গোটা বিশ্বের ওপরই পড়বে।
পরাজিত ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রার্থী মারি লো পেনের পরিচয় হিসেবে তাঁকে কেবল লোকরঞ্জনবাদী বলে বর্ণনা করা যথেষ্ট নয়, তিনি এবং তাঁর দল কার্যত ইউরোপীয় ইউনিয়নের অবসানের পক্ষে এবং বিশ্বায়নের বিপরীতে ‘একলা চলো’ বা আইসোলেসানিস্ট নীতির অনুসারী। অভিবাসনবিরোধী মনোভাব ও ইসলামভীতি (বা ইসলামোফোবিয়া) প্রচার এবং বর্ণবাদী বক্তব্য ও আচরণের জন্যই এক দশকের বেশি সময় ধরে ন্যাশনাল ফ্রন্ট পরিচিত। ফলে মারি লো পেনের এই পরাজয়কে যে এই সব নীতির প্রত্যাখ্যান বলে বলা হচ্ছে, তা অতিরঞ্জন নয়। কিন্তু যে কারণে ফ্রান্সের নির্বাচন সবার মনোযোগ আকর্ষণ করেছে তা হলো গত বছর ব্রিটেনের গণভোট বা ব্রেক্সিট, সারা ইউরোপে বিশ্বায়নবিরোধী দক্ষিণপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদীদের উত্থান এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের ঘটনা পৃথিবীজুড়ে লোকরঞ্জনবাদী কর্তৃত্ববাদী আদর্শের এবং নেতাদের অপ্রতিরোধ্য বিজয়ের ইঙ্গিত বলে ধরা হচ্ছিল।
এ কথা ঠিক যে এই ধরনের লোকরঞ্জনবাদী কর্তৃত্ববাদী আদর্শের বিজয়ের সূচনা ব্রেক্সিটের মধ্য দিয়ে নয়; রাশিয়া, তুরস্ক, ভেনেজুয়েলা, ফিলিপাইনসহ অন্য অনেক দেশেই তার লক্ষণ বা তার ফল কমপক্ষে তিন-চার বছর আগেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু উদার গণতন্ত্রের অনুসারীরা, যাঁরা ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নীতি বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন এবং এই সব দেশে বিরাজমান গণতন্ত্রের দুর্বলতা (ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের ভাষায় অন্তঃসারশূন্যতা) বিষয়ে যথাযথ সমালোচনা করেন, তাঁরাও আশা করেননি যে এই সব দেশে এই ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। কেননা, তাঁরা উপলব্ধি করতে পারেন যে বিশ্বরাজনীতিতে এই সব দেশের প্রভাব হ্রাস পেলেও গ্রহণযোগ্য বিকল্প এখনো গড়ে ওঠেনি, বিরাজমান বিকল্প বৈশ্বিক শক্তিগুলো তাঁদের আদর্শিক অবস্থানের অনুকূল নয়। ফলে কেবল যাঁরা বিশ্বরাজনীতির স্থিতাবস্থার পক্ষে এবং যাঁরা বিরাজমান ব্যবস্থার সুবিধাভোগী, কেবল তাঁরাই নন, যাঁরা এই ব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতির বিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত এবং তা মোকাবিলার জন্য অনেক দিন ধরেই তাগিদ দিয়ে আসছেন, তাঁরাও এখন লোকরঞ্জনের আদর্শের মোড়কে হাজির করা দক্ষিণপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদী ও বর্ণবাদী শক্তির উত্থানের বিপরীতে যেকোনো সাফল্যকেই বিজয় বলে ধরে নিচ্ছেন।
এই নির্বাচনের ফলের কী প্রভাব পড়বে, সেই বিষয়ে কথা বলার আগে এই নির্বাচনের কয়েকটি দিক আমাদের বিবেচনায় নেওয়া দরকার। ফ্রান্সের রাজনীতি এত দিন ধরে মধ্য-বাম সমাজতন্ত্রী এবং মধ্য-ডান রিপাবলিকান দলের মধ্যেই ঘুরপাক খেয়েছে, কিন্তু এই প্রথমবার তাদের প্রার্থীরা দ্বিতীয় পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেননি। কেবল যে আদর্শিকভাবেই তা দেশের এত দিনের রাজনীতির চেহারা বদলানোর লক্ষণ তা নয়, সম্ভবত সাংগঠনিকভাবেও। ম্যাখোঁর নতুন দলের সাংগঠনিকভাবে শক্তি সামান্যই। তারপরও দেশের মানুষ তাঁকে এবং ন্যাশনাল ফ্রন্টের মারি লো পেনকেই বেছে নিয়েছিল দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোটের লড়াইয়ের জন্য। এটি রাজনীতির জন্য ইতিবাচক না নেতিবাচক, এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করে আপনি কাকে জিজ্ঞাসা করছেন; কিন্তু এটা যে দুই দলের প্রতি সুস্পষ্ট অনাস্থা, তা অস্বীকারের উপায় নেই।
যে নির্বাচন নিয়ে সারা পৃথিবী উৎসাহী, সেই নির্বাচনে ফরাসি ভোটারদের এক-চতুর্থাংশ ভোট দেননি; ১৯৬৯ সালের পরে দ্বিতীয় পর্যায়ে এত কম ভোটারের উপস্থিতি কখনোই ঘটেনি। প্রায় ১০ শতাংশ ভোটার তাঁদের ব্যালট সাদা জমা দিয়েছেন বা অন্য কারও নাম লিখে দিয়েছেন। ২০০২ সালে প্রথমবারের মতো ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেতা মারি লো পেনের পিতা জ লো পেন দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, সে সময় তাঁর পাওয়া ভোটের হার ছিল ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ (৬ দশমিক ২ মিলিয়ন); তাঁর উত্তরসূরি ও কন্যা মারি লো পেন পেয়েছেন ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ ভোট (প্রায় ১৬ মিলিয়ন)। ম্যাখোঁর বিজয়ে ফ্রান্সের দলগুলো নিঃসন্দেহে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে, কিন্তু এসব তথ্য তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক মনে হয় না। তদুপরি সামনের দিনগুলোতে তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ উপস্থিত আছে।
ছয় সপ্তাহ পর দেশের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের নির্বাচন, সেই নির্বাচনেই কার্যত নির্ধারিত হবে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের চেয়ে কম তো নয়ই, বরং অনেক ক্ষেত্রেই বেশি। ফলে আগামী ছয় সপ্তাহের মধ্যে প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ যদি তাঁর দল তৈরি করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নিদেনপক্ষে বড় ধরনের বিজয় অর্জন করতে না পারেন, তাহলে তাঁর পক্ষে দেশশাসন হবে প্রায় অসম্ভব। এর বিকল্প হচ্ছে যাঁরাই বিজয়ী হবেন, তাঁদের সঙ্গে সমঝোতা তৈরি। রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ ম্যাখোঁ সেটা পারবেন কি না, সেটাই প্রশ্নসাপেক্ষ।
অতীতে নিজের দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়া আদর্শিকভাবে বিপরীত মেরুর প্রধানমন্ত্রী নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। ১৯৯৭ থেকে ২০০২ সালে প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক এবং প্রধানমন্ত্রী লিওনেল জসপার মধ্যকার টানাপোড়েনের কথা নিশ্চয় স্মরণে থাকবে। এগুলো অন্য সময়ে যতটা বিবেচ্য ছিল, এখন তার চেয়ে বেশি, কেননা, এখন ন্যাশনাল ফ্রন্টের খড়্গ ঝুলতে থাকবে। যখন প্রায় ১০ শতাংশ বেকারত্বের হার, বৈষম্যের কারণে অভিবাসী এবং বর্ণ ও ধর্মের কারণে সংখ্যালঘুদের মধ্যে যখন ক্ষোভ-বিক্ষোভ বিরাজমান এবং যখন উগ্র জাতীয়তাবাদীরা মনে করছেন এখন বাতাস তাঁদের অনুকূলে, সেই সময়ে যেকোনো সংকটের পরিণতি নিশ্চয় আগের মতো, কেবল প্রতিষ্ঠিত দুই দলের মধ্যে ক্ষমতার হাতবদলের ঘটনার দিকে এগিয়ে যাবে মনে করার কারণ নেই। ফলে, এই নির্বাচনের ফলাফলকে ফরাসি রাজনীতির জন্য নতুন পথের সূচনা করল, প্রতিষ্ঠিত দল ও নেতারা যদি তাকে পরিচালনা করতে না পারেন, তবে তাতে লাভ হবে উগ্রপন্থীদেরই।
ম্যাখোঁর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির শেষ অধ্যায় রচিত হলে বলে যাঁরা আশা করছেন, তাঁদের আশাবাদের সঙ্গে এখনো একমত হতে পারছি না। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে এই নির্বাচনের কোনো প্রভাব নেই। অবশ্যই এই সাফল্য অন্যদের লোকরঞ্জনবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে উৎসাহী করবে, উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শক্তি জোগাবে। নেদারল্যান্ডসের নির্বাচনে ফ্রিডম পার্টির নেতা গার্ট ওয়াইলডারের পরাজয়, ব্রিটেনের স্থানীয় নির্বাচনে উগ্র দক্ষিণপন্থী ইউকিপের তাঁদের প্রত্যাশিত ফল পেতে ব্যর্থতা এবং এখন ফরাসি নির্বাচনের মধ্যে আশার ইঙ্গিত আছে।
কিন্তু বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই যে ফ্রিডম পার্টি নেদারল্যান্ডসে তৃতীয় বৃহত্তম দলে পরিণত হয়েছে, ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে এখনো উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সমর্থনে খুব বেশি ভাটা পড়েনি। ফলে এখনো ইউরোপে লোকরঞ্জনবাদের মৃত্যুসংবাদ লেখার সময় আসেনি। সেটা সম্ভব হবে যদি বিরাজমান উদার গণতন্ত্রের যেসব ত্রুটি উন্মোচিত হয়েছে, সেগুলো মোকাবিলায় আন্তরিক উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং বিশ্বায়ন এবং দেশের অভ্যন্তরের অন্যায্য ব্যবস্থা অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্য বাড়াচ্ছে, তা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আর পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে যাঁরা লোকরঞ্জনবাদী কর্তৃত্ববাদী শাসন মোকাবিলা করছেন, তাঁদের জন্য সম্ভবত ফ্রান্স নির্বাচনের বার্তা এই যে এখনো একেবারে সম্পূর্ণ আশাহত হওয়ার কারণ নেই।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।