ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সম্প্রতি প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লেট, গ্লাস, কাপ, স্ট্র, বেলুন স্টিক, কটন বাড, চা-কফিতে চিনি বা দুধ মেশানোর দণ্ড ইত্যাদির ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ার কথা। জলাভূমি, সমুদ্র এবং উপকূল-সৈকতের দূষণ নিয়ন্ত্রণে একবার ব্যবহার উপযোগী প্লাস্টিকের ওপর এ নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপে প্রতিবছর প্রায় আড়াই কোটি টন (২৫ মিলিয়ন টন) প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে অন্তত দেড় লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য মহাদেশের নদ-নদী ও জলাশয়ে গিয়ে জমে। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের (৮ এপ্রিল ২০১৯) তথ্য বলছে, প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন পাত্র, পানি ও কোমল পানীয়র বোতল যথেচ্ছ ছুড়ে ফেলার প্রবণতা নদী-জলাশয়ে প্লাস্টিক দূষণের অন্যতম ইন্ধন।
অন্যদিকে বিশ্বের সাগর-মহাসাগরে প্রতিবছর প্রায় আশি লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য জমছে। সমুদ্রের স্রোত প্লাস্টিক বর্জ্য ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূরদূরান্তে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত জাপানিজ গবেষণা রিপোর্ট জানিয়েছে যে ফিলিপাইনের অদূরে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম মারিয়ানা ট্রেঞ্চে প্লাস্টিকের ব্যাগের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। অপর এক গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্ষুদ্রতম ভগ্নাংশ বা ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ বায়ুতাড়িত হয়ে পর্বতচূড়ায় মিলছে। বায়ুদূষণের অন্যতম ক্ষতিকর উপাদান যে ভাসমান বস্তুকণা, ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ সে তালিকায় যোগ হচ্ছে বিশ্বজুড়ে।
বাতাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরেও মাইক্রোপ্লাস্টিক ঢুকে পড়ছে। ফলে প্লাস্টিকের দূষণ কেবল ঘুরপথে নয়, সরাসরি মানুষের শরীরে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। সমুদ্র-মহাসমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ায় পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীর জীবন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। কেবল ক্ষুদ্র সামুদ্রিক প্রাণী নয়, বিশাল তিমি মাছও প্লাস্টিক দূষণে মারা পড়ছে। সামুদ্রিক প্রাণী ও মাছের শরীরে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক’ সঞ্চিত হয়ে তা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে।
একদিকে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্লাস্টিকের (পলিথিনসহ) ব্যবহার বাড়ছে। মানুষের আয় বাড়ার সঙ্গে বর্ধিত পরিমাণে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশেও প্লাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। ২০১৪ সালের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বছরে গড়ে মাথাপ্রতি প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহৃত হয় ৩ দশমিক ৫ কিলোগ্রাম। ইউরোপের গড় মাথাপ্রতি বছরে ১৩৬ কিলোগ্রাম এবং উত্তর আমেরিকায় ১৩৯ কিলোগ্রাম। তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহারের পরিমাণ কম হলেও নগরায়ণের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বাড়ছে সে পরিমাণ। কেবল প্লাস্টিক পণ্যের পরিমাণ নয়, বাংলাদেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহারবৈচিত্র্যও বাড়ছে।
নগরজীবনে আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও দীর্ঘদিনের চেনা জীবনযাপনের বৈশিষ্ট্য বদলে যাচ্ছে। বাজারঘাটে, খাবার দোকানে, সুপারশপে, পণ্যের মোড়ক ব্যবহারে প্রচুর প্লাস্টিক ব্যবহার হচ্ছে নিত্যদিন। ফলে প্লাস্টিক বর্জ্যও বাড়ছে। প্লাস্টিকের রকমারি পণ্য এবং তার প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত উপাদানেরও বিভিন্নতা রয়েছে। ফলে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও বিভিন্ন হওয়া বাঞ্ছনীয়। এখনো আমাদের দেশে বর্জ্য সংগ্রহ উৎসে বর্জ্যের ধরন বুঝে তা পৃথক করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। অন্তত পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্য যদি উৎসে আলাদা করা সম্ভব হতো, তাহলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অনেকাংশে সহজ হতে পারত। প্রতিদিন কেবল ঢাকা শহরে উৎপাদিত প্রায় ৩ হাজার ৫০০ টন বর্জ্যের মধ্যে ৩০ শতাংশ অপচনশীল। দেশের বর্জ্যের ভাগাড় এবং সড়ক-মহাসড়কের পাশে স্তূপ করে রাখা আবর্জনার মধ্যে পলিথিন ও প্লাস্টিকের আধিক্য দেখে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে অপচনশীল বর্জ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ পলিথিন ও প্লাস্টিক।
প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব জানার সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকের বিকল্প সন্ধান করা হচ্ছে। আদৌ প্লাস্টিকের উত্তম ও সহজলভ্য বিকল্প রয়েছে কি না, সে প্রশ্নও উঠছে। সুলভে সহজে পচনশীল প্লাস্টিকের উপযুক্ত বিকল্প পাওয়ার বিষয়ে অনেকের সংশয় রয়েছে। তবে একবার ব্যবহার উপযোগী ও সহজে ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের পচনশীল ও সস্তা বিকল্প পাওয়ার ব্যাপারে অনেকেই আশাবাদী। কাগজের তৈরি প্লেট, কাপ, গ্লাস, স্ট্র, বাক্স, মোড়ক এখন ব্যবহারও হচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলোতে প্রচলিত প্লাস্টিক পণ্যের বিকল্প না পেলে বিদ্যমান প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার ২০২৫ সাল নাগাদ ২৫ শতাংশ সংকুচিত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার এলাকায় ২০২৫ সালের মধ্যে বর্জ্য প্লাস্টিক বোতলের ৯০ শতাংশ সংগ্রহ করে পুনরায় ব্যবহার করার জন্য নির্ধারণ করেছে।
অপচনশীল বর্জ্য সংগ্রহ ও তার পুনরায় ব্যবহার করার ক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। নিজ দেশে শিল্পের কাঁচামাল জোগান দিতে বিদেশ থেকে প্লাস্টিকসহ অপচনশীল বর্জ্য আমদানিতে চীন ছিল শীর্ষে। ২০১৬ সালে হংকং এককভাবে চীনে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ (বিশ্বের মোট রপ্তানির প্রায় ১৯ শতাংশ) প্লাস্টিক বর্জ্য রপ্তানি করেছে। একই সময়ে চীনে যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানি করেছে ১৩ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য এবং জাপান রপ্তানি করেছে ১০ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য। ২০১৭ সালের ৩১ জানুয়ারি থেকে চীনে নতুন আইন কার্যকর হওয়ায় প্লাস্টিক বর্জ্যসহ ২৪ ধরনের কঠিন বর্জ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চীনের বাজার বর্জ্য রপ্তানির জন্য উন্মুক্ত থাকা এবং বর্জ্য রপ্তানি লাভজনক হওয়ায়, শিল্পোন্নত অনেক দেশই নিজ দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য পুনরায় ব্যবহারের অবকাঠামো তৈরির বদলে বর্জ্য সংগ্রহ ও রপ্তানির ওপর জোর দিয়ে আসছিল। থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম মিলিতভাবে ২০১৬ সালে বিশ্বের প্রায় ৫ শতাংশ প্লাস্টিক বর্জ্য চীনে রপ্তানি করেছে। এখন এই দেশগুলো বিশ্বের প্রধান প্লাস্টিক বর্জ্য আমদানিকারকে রূপান্তরিত হয়েছে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল আইনি বাধ্যবাধকতা বহাল থাকায় উদ্যোক্তাদের এ দেশগুলোতে বর্জ্য প্লাস্টিক আমদানি করে তা পুনরায় ব্যবহার করার শিল্প ও অবকাঠামো গড়তে প্রলুব্ধ করছে। এখন দেশগুলোতে চীনা বিনিয়োগকারীদের বর্জ্য পুনরায় ব্যবহার অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী করার চেষ্টা চলছে। বর্জ্য পরিশোধন ও পুনরায় ব্যবহারের স্থান বদল আপাতসমাধান দিলেও প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য হওয়া উচিত কম বর্জ্য উৎপাদন। এ জন্য প্লাস্টিক ব্যবহারকারীদের অভ্যাস বদলও গুরুত্বপূর্ণ।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক