চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আজ ১৪ অক্টোবর দুই দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন। গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফর বেশ কটিই হয়েছে। কিন্তু একজন কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে বিনা দ্বিধায় বলতে পারি, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের এই সফর হবে আগের সব সফরের তুলনায় অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
স্বাধীন বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের সূচনা চীনের বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আগে থেকেই শুরু হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের প্রথমার্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে একটি সরকারি বাণিজ্য প্রতিনিধিদল ক্যান্টনের (বর্তমান গোয়াংজো) বাণিজ্য মেলায় যোগ দেয়। বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে কতটা গুরুত্ব দেবে, তারই একটা দৃষ্টান্ত ছিল ওই বাণিজ্য মেলায় যোগদানের ঘটনাটি। তারই ধারাবাহিকতায় চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই পাকিস্তান আমল থেকেই চীন এই অঞ্চলের জনগণের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব পোষণ করেছে। চৌ এন লাই, লিও শাওচি
প্রমুখ চীনা নেতারা সেই সময়েই ঢাকা সফর করেছেন। চীনা সাহায্য, আকারে যদিও তা সীমিত, তখন চীনা নেতারা চাইতেন যে তার যথাযথ একটি অংশের সুফল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাক। ষাটের দশকের প্রথমার্ধে যখন পিকিংয়ের (বর্তমান বেইজিং) পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত ছিলাম, তখন গভীর তৃপ্তির সঙ্গে তা লক্ষ করেছি। সেই দশকেরই অন্তিম দুই বছর ইসলামাবাদে পররাষ্ট্র দপ্তরে চীন বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছি। তখন আমার এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে চীনের নেতারা তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নকে সেই সময়কার পাকিস্তানি নেতাদের চাইতেও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। অবশেষে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে বেইজিংয়ে প্রথম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর চুক্তি স্বাক্ষর করা ছিল আমার পেশাগত জীবনের একটি স্মরণীয় ও তৃপ্তিদায়ক ঘটনা।
আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে, বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে চীন সফর করেন। সেই সফরে তাঁর সহযাত্রী হিসেবে, চীন সম্পর্কে এবং বাংলাদেশ–চীন সম্পর্ক উন্নয়নে, তাঁর গভীর আগ্রহ লক্ষ করেছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান হিসেবে চীন সফর করেছেন দুবার—২০১০ ও ২০১৪ সালে। আমার বিশ্বাস, তাঁর এই দুই সফর বাংলাদেশে চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের এই গুরুত্বপূর্ণ সফরটির ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১৭ থেকে ২১ মার্চ চীনে সরকারি সফর করেন। সেই সময়কার অন্য সব সহযোগিতার মধ্যে আমাদের বিবিধ অবকাঠামো ও যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়নে চীনের সহায়তা দুই দেশের বিদ্যমান মৈত্রীবন্ধন জোরালো করেছিল। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে চীন থেকে আহরিত অস্ত্রসম্ভার আমাদের প্রতিরক্ষা শক্তি দৃঢ়তর করেছিল। ২০১৪ সালের ৬ থেকে ১১ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বার চীন সফর করলেন। সফর শেষে তিনি বলেছিলেন, তাঁর বিশ্বাস, তাঁর সফর বিনিয়োগ, বাণিজ্য, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ক্ষেত্রে চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক দৃঢ়তর করবে। সেই সফরে চীন পাঁচটি প্রকল্পে ৫০০ কোটি ডলারের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে ‘স্ট্র্যাটেজিক’ সহযোগিতায় উন্নীত করার জন্য আলাপ-আলোচনা করেন। তখন আমাদের দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক অসমতা ঘোচানোর জন্য চীন বাংলাদেশ থেকে অধিকতর দ্রব্য আমদানির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের এই সফর হবে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো একজন চীনা রাষ্ট্রপ্রধানের সফর। ১৯৮৫ সালের ৮ থেকে ১১ মার্চ চীনের রাষ্ট্রপতি লিশিয়েন নিয়েন বাংলাদেশ সফর করেন। সেই সফরে পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে আমি জড়িত ছিলাম। তখন বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক দানা বাঁধছিল। কিন্তু লিশিয়েন নিয়েন যদিও প্রেসিডেন্ট ছিলেন, যথাযথ অর্থে চীনের সর্বোচ্চ নেতা তিনি। দেং শিয়াওপিং তখনো জীবিত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বর্তমান চীনের শুধু প্রেসিডেন্টই নন, তিনি সেই দেশের অবিসংবাদী নেতাও। তিনি চীন কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি এবং সেই দেশের কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের সভাপতি। ৬৩ বছর বয়সী চীনের এই নেতা ২০১২ সালে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একটি অলিখিত প্রথা অনুযায়ী চীনের নেতারা ৬৮ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন। চীনের প্রেসিডেন্ট সাধারণত পাঁচ বছরের মেয়াদে দুই দফা তাঁর দায়িত্ব পালন করেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে সি চিন পিংয়ের প্রথম মেয়াদ ২০১৭ সালে শেষ হবে। অতএব, ২০২২ সাল পর্যন্ত তাঁর চীনের প্রেসিডেন্ট ও অবিসংবাদী নেতা হিসেবে অবস্থানের আশা করাই যায়।
বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো সুদর্শন, সুকেশধারী এই নেতাকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল ২০১৪ সালের ১৫ মে। সেই সময় আমি চীন-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে চীনের ‘পুরোনো বন্ধু’ হিসেবে (৮৩ বছর বয়সে সত্যিই পুরোনো!) চীন সফর করেছিলাম। ২০১৪ সালের ১৫ মে বেইজিংয়ের ‘গ্রেট হল অব দ্য পিপল’–এ প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ১১৬টি দেশ থেকে আমন্ত্রিত চীনের ‘বন্ধুদের’ উদ্দেশে ১৫ মিনিটের একটি স্মরণীয় ভাষণ প্রদান করেন। তাঁর কথায়, ‘আমরা যতই বহুকেন্দ্রিক বিশ্ব, অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন ও তথ্যবিপ্লবের প্রয়োগের পানে ধাবিত হচ্ছি; জাতীয় স্বার্থ, ভাগ্য ও নিরাপত্তার নিরিখে পৃথিবীর দেশগুলো পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা এবং একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। তারা আজ সম্মিলিত ভাগ্যোন্নয়নে একটি সুসংঘবদ্ধ পরিবারের সদস্য।’ তাঁর কথায়, ‘চীন এই শতাব্দীর মাঝামাঝিতে একটি আধুনিক সমাজবাদী দেশে পরিণত হবে; যা বিত্তশীল, ক্ষমতাবান, গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আগুয়ান দেশ হিসেবে চীনের জাতীয় নবায়নের স্বপ্ন সার্থক করবে।...চীনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন পৃথিবীতে একটি বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি করবে।’
সি চিন পিং আরও বলেন, ‘শত শত নদ–নদী বরণ করেই সাগর বিশাল আকার ধারণ করে। চীন নিজেকে বহির্বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করবে, পারস্পরিক লাভজনক সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে এবং “সিল্ক রোডের” অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও একবিংশ শতাব্দীর জলপথ “সিল্ক রোডের” উন্নয়ন করবে, যাতে দেশগুলো তাদের উন্নয়ন সম্ভাবনা ভাগ করে নিতে পারে। অধিকতর উন্মুক্ততা নিয়ে চীন সাংস্কৃতিক দেওয়া-নেওয়া করবে, যাতে বিশ্বসভ্যতা পারস্পরিক শিক্ষালাভের ভিত্তিতে এগিয়ে যায়।’
চীনের অবিসংবাদী নেতা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের এই বলিষ্ঠ চিন্তাধারারই প্রতিফলন ঘটেছে চীনের, ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উন্নয়ন প্রস্তাবে। এই প্রস্তাব, যা ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে প্রকাশ পায়, চীন ও ইউরেশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জলে ও স্থলপথে সংযোগ (কানেকটিভিটি) ও সহযোগিতা উন্নয়নের একটি ‘স্ট্র্যাটেজি’ ও রূপরেখা। আমার জানামতে, এতে ৩০-৩২টি দেশ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পূর্বে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শুরু করে মিয়ানমার, কম্বোডিয়া নিয়ে পশ্চিমে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া, তুরস্ক, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরির মতো দেশ। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আমাদের ‘সোনার বাংলা’ অবশ্যই তার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই বিরাট ফ্রেমের মধ্যে অবস্থিত দেশগুলোর সঙ্গে চীন চাইবে বহুমাত্রিক উন্নয়নের সুদৃঢ় সম্পর্ক স্থাপন করতে। চীন আজ অর্থনৈতিক দিক থেকে পৃথিবীর দ্বিতীয় শক্তিশালী রাষ্ট্র। মানব ইতিহাসে কোনো উন্নত অথবা উন্নয়নগামী দেশের নেতা সম্মিলিত উন্নয়নের এমন ডাক কখনো দেননি। নেপোলিয়নের ‘ঘুমন্ত চীন’ এখন সত্যিকার অর্থেই জেগে উঠেছে, এবং বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশকে টেনে নিতে চাইছে। আমরা সর্বান্তকরণে কেন তাতে সাড়া দেব না।
আমি মনে করি, প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশে এই সফর আমাদের জন্য একবিংশ শতাব্দীর দ্বার অনেকটাই উন্মোচিত করে দেবে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশে এই সফরকে একটি ‘মাইলফলক’ বলে আখ্যায়িত করেছে। আমার দৃষ্টিতে এটি হবে একটি যুগান্তকারী সফর। এই সফরকে সার্থক ও ফলপ্রসূ করার জন্য রাজনৈতিক নির্দেশনায় চীন ও বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন।
বাংলাদেশের আশা যে মৌলিক অবকাঠামো, জ্বালানি, যোগাযোগ, কানেকটিভিটি, টেকনোলজি, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালন, সামুদ্রিক প্রকল্প এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির মতো ক্ষেত্রে চীনের প্রেসিডেন্ট সফরের সময়ে একগাদা সমঝোতাপত্র ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
চীনের বাংলাদেশে রপ্তানির বার্ষিক মূল্য এখন প্রায় এক হাজার কোটি মার্কিন ডলার। চীনে বাংলাদেশের বার্ষিক রপ্তানি তার এক–দশমাংশ, প্রায় ৮১ কোটি ডলার ছঁুই–ছঁুই করছে। আশা তো এই যে এই সফরের ফলে আমাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক পরিমাণ বাড়বে এবং অসমতা কমবে।
বাংলাদেশ এখন ‘গোল্ডম্যান স্যাক্স’-এর (Goldman Sachs) তালিকায় বিংশ শতাব্দীর ১১টি উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির একটি, যার প্রবৃদ্ধি এখন ৭ শতাংশের আশপাশে রয়েছে। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ বেড়ে চলেছে এবং এখন বাংলাদেশের একটি আধুনিক গভীর সমুদ্রবন্দরের একান্ত প্রয়োজন—সোনাদিয়ায় অথবা মাতারবাড়ী অথবা পায়রায়, যেখানেই হোক। সেই গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ক্ষেত্রে জাপান, চীন ও ভারত আগ্রহী রয়েছে বলে মনে হয়। এই সম্বন্ধে, জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে, সরকার একটি সিদ্ধান্ত নেবে, এই আশা রইল।
প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সফরের সময়ে স্বাক্ষরিত সমঝোতাপত্র ও চুক্তির অঙ্ক, অর্থাৎ পরিমাণ কী হবে, তা নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন তা হবে ২ হাজার কোটি ডলারের, আবার অন্যরা প্রসন্নচিত্তে তা ৫ হাজার কোটি ডলারও ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা ব্যক্ত করছেন। আমার মতে, শেষোক্ত দলের ধারণাই সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব। কলাম লেখক।