সব ধর্মই দরিদ্র মানুষের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনের কথা বলে। পুঁজিবাদী উদারতাও দরিদ্রদের মধ্যে উদ্বৃত্ত বিতরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। কোনো নাগরিক যাতে অভুক্ত না থাকে, কল্যাণ রাষ্ট্র সেই ব্যবস্থাও করে। কিন্তু পুঁজি তথা সম্পদ ও উৎপাদনযন্ত্রের মালিক যে পর্যন্ত না রাষ্ট্র হবে, সে পর্যন্ত বঞ্চনা বন্ধ হবে না, বৈষম্যের মাত্রা কমবে না এবং মানুষের সুখও সর্বাধিক করা যাবে না। সে জন্যই কমিউনিস্টরা পুরো ব্যবস্থাটাই পাল্টাতে চায়। কিন্তু পৃথিবীতে বহু রাজনীতিক আছেন, যাঁরা কমিউনিস্ট তত্ত্ব অনুসরণ না করেও নিজেরা অতি সাধারণ জীবনযাপন করে মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।
স্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এমন একজন রাজনীতিক। তিনি কখনো কমিউনিস্ট রাজনীতি করেননি। তিনি করেছেন উঠতি বুর্জোয়াদের দল কংগ্রেস। যদিও কংগ্রেসপ্রধান, পণ্ডিত নেহরুকে অনেকেই সমাজতন্ত্রী বলতে পছন্দ করেন। ‘আপনার মৃত্যু হলে আমরা প্রধানমন্ত্রী কাকে করব?’ মৃত্যুশয্যায় নেহরুকে এ প্রশ্ন করা হলে তিনি লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কথা বলেন। মেয়ে ইন্দিরার কথা তিনি বলেননি।
বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরও দু-একজন রাজনীতিকের জীবনের কিছু অজানা কাহিনি বলে নেওয়া ভালো। দরিদ্র পরিবারের ছেলে ছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। শৈশবে বাবা মারা যাওয়ার পর মা-ই তাঁকে অনেক কষ্টে মানুষ করেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি যখন প্রথম বাড়িতে যান, মা অবাক হয়ে দেখতে পেলেন অসংখ্য মানুষের ভিড়। সাংবাদিকেরা তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বলো কী! আমার লালু প্রধানমন্ত্রী হয়েছে! আমাকে জানায়নি তো!’ দেশের দায়িত্ব তাঁর কাছে এতই বড় যে নিজের মাকেই সুখবরটা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি লালবাহাদুর শাস্ত্রী।
নেহরুর ক্যাবিনেটে শাস্ত্রী শেষ দিকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী ছিলেন। নেহরু তাঁকে একবার আসামে পাঠাতে চাইলেন। সবকিছু বুঝে নিয়ে শাস্ত্রী বেরিয়ে গেলেন। নেহরু ভাবলেন, আসামে তো এখন অনেক শীত, কিন্তু শাস্ত্রীর তো শীত নিবারণের জন্য কোনো কোট নেই। ডেকে পাঠালেন শাস্ত্রীকে। বললেন, ‘তুমি যে আসামে যাবে, তোমার কি কোট আছে?’ শাস্ত্রী আমতা-আমতা করায় নেহরুর কাছে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হলো। তখন নেহরু তাঁকে নিজের কোটটা দিয়ে বললেন, ‘এবার যাও। আসাম থেকে ঘুরে এসো’। দীর্ঘদেহী নেহরুর কোট তাঁর গায়ে খুব বেমানান ছিল বটে; কিন্তু আর কোনো উপায় ছিল না।
মিলিটারি একাডেমিতে এক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এত দুঃখের মধ্যে, না খেয়ে..., গায়ে কাপড় নাই, কত অসুবিধার মধ্যে বাস করতেছে— তারপরও লক্ষ লক্ষ লোক দাঁড়িয়ে আছে আমাকে দেখবার জন্য... ’। তিনি প্রায় একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন, ‘...সেই দুঃখী মানুষ দিনভর পরিশ্রম করে, তাদের গায়ে কাপড় নাই, পেটে খাবার নাই, বাসস্থান নাই ...।’
কমিউনিস্ট সাহিত্যের পরিভাষায় শেখ মুজিব সাম্যবাদী ছিলেন না, কিন্তু অসহায় দরিদ্র মানুষের প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা ছিল, তা অনেক কমিউনিস্টের মধ্যেও বিরল। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ প্রদত্ত শেখ মুজিবের ভাষণের অধিকাংশ জায়গাজুড়ে দরিদ্র, ছিন্নমূল, বাস্তুহারা—এমনকি বিহার থেকে আগত বাস্তুহারা মানুষ নিয়ে তাঁর গভীর দুশ্চিন্তার কথা ছিল। তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছে ট্যাক্সের টাকা দাবি করছেন বাস্তুহারা মানুষদের জন্য একটা ব্যবস্থা করার জন্য। তিনি বলছেন, ‘ধনীরা, তোমরা এযাবৎ অনেক পেয়েছ। আর পাবে না। এখন শুধু গরিবরা পাবে। খাস ল্যান্ড গরিবদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। ধনীরা যাতে আর ধনী না হতে পারে, আর গরিবরা যাতে আরও গরিব না হয়, আমাদের সেই ব্যবস্থা করতে হবে।’
১৯৭৩ সালের জানুয়ারি মাসের ঘটনা। তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সামসুল হুদা দেখা করতে যান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। এর মাত্র দুদিন আগে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সামসুল হুদা। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পান সামসু। বঙ্গবন্ধু তখন দাঁড়িয়ে টেবিলের ওপর রাখা মুড়ি খাচ্ছেন। সামসুকে দেখে বললেন, ‘কেমন আছিস, আয়, মুড়ি নে।’ মুড়ি নিতে গেলে সামসুর হাতের আংটি দেখে বঙ্গবন্ধু অবাক হয়ে জানতে চান, ‘তোর হাতে রিং কেন রে?’ সামসু বলেন, মা-বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কিছুটা অনুযোগের সুরে বললেন, ‘এখনই বিয়ে করে ফেললি? এখনো কত কাজ বাকি।’ দু-এক কথার পর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বউমা কোথায়? বউয়ের জন্য কী কিনেছিস?’ সামসু নিচু স্বরে জবাব দিলেন, ‘কিছুই কিনিনি, আমি বেকার। হঠাৎ করে বিয়ে। এর আগে আমি মেয়েকে দেখিওনি।’ একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর কোমরে ১০ হাজার টাকা গুঁজে দেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই টাকা শুধুমাত্র বউমার জন্য, এক টাকাও তুই নিবি না।’ এরপর বঙ্গবন্ধু আরও দেড় হাজার টাকা দেন সামসুকে। বঙ্গবন্ধু তোফায়েল আহমদকে ডেকে পাঠান। তোফায়েল আহমদ এলে তাঁকে বলেন, ‘খবর শুনেছিস; সামসু বিয়ে করেছে। শোন, সামসু এখন বেকার। আমার কাছে কোনো টাকা নেই। আমাকে ১০ হাজার টাকা ধার দে।’ তোফায়েল বলেন, ‘৫ হাজারের বেশি দিতে পারব না।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তা-ই দে।’ শেষে তোফায়েলের কাছ থেকে আরও ৫ হাজার টাকা নিয়ে চলে আসেন সামসুল হুদা।
মিলিটারি একাডেমিতে এক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এত দুঃখের মধ্যে, না খেয়ে..., গায়ে কাপড় নাই, কত অসুবিধার মধ্যে বাস করতেছে— তারপরও লক্ষ লক্ষ লোক দাঁড়িয়ে আছে আমাকে দেখবার জন্য... ’। তিনি প্রায় একই কথার পুনরাবৃত্তি করেন, ‘...সেই দুঃখী মানুষ দিনভর পরিশ্রম করে, তাদের গায়ে কাপড় নাই, পেটে খাবার নাই, বাসস্থান নাই ...।’
আরেক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘আপনার মায়না দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার মায়না দেয় ওই গরিব শ্রমিক, আপনার সংসার চলে ওই টাকায়, আমি গাড়ি চড়ি ওই টাকায়। ...ওদের সম্মান করে কথা বলবেন, ওরাই মালিক। সরকারি কর্মচারীকে বলব, মনে রেখো, এ স্বাধীন দেশ, এ ব্রিটিশ কলোনি নয়, এ পাকিস্তানি কলোনি নয়। যে লোকটাকে দেখবা তাঁর চেহারাটা তোমার বাবার মতো, তোমার ভাইয়ের মতো, ওরাই সম্মান বেশি পাবে, কারণ ওরা নিজেরা কামাই করে খায়। একটা জিজ্ঞাসা করি আপনাদের কাছে— আমাদের কাছে, জিজ্ঞাসা করি কারণ, আমি তো আপনাদেরই একজন। আমাদের লেখাপড়া শিখাইছে কেডা, ডাক্তারি পাস করায় কে, ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করায় কে, বৈজ্ঞানিক করে কে? অফিসার করে কে? কার টাকায়? বাংলার দুঃখী জনগণের টাকায়, শিক্ষিত ভাইদের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, ওরা আপনাদের খরচ জুগিয়েছে শুধু আপনার সংসার দেখার জন্য নয়... । জুগিয়েছে কারণ আপনি ওদের জন্য কাজ করবেন, সেবা করবেন। বিনিময়ে তাদের আপনি কী দিয়েছেন, কী ফেরত দিচ্ছেন, কতটুকু দিচ্ছেন?... ’
এক ছবিতে দেখি, বঙ্গবন্ধু বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীকে আদর করে হাত ধরে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। বলছেন, ‘আজকে কামালের মা মুরগির ঝোল রান্না করছে। আয় একসাথে খাব’। ওই ছবি আর এই বাক্য, পুলকিত হওয়ার পরিবর্তে, ক্ষণিকের জন্য হলেও আমাদের মধ্যে হাহাকার জাগায়, কান্না সৃষ্টি করে। কারণ, এই পোড়ার দেশে অমন দৃশ্য আমরা আজ আর দেখি না, এমন মমতা আজ বড় দুর্লভ।
পাঠক! শুধু বঙ্গবন্ধুর গুণকীর্তন করার জন্যই কি এই লেখা? গরিবের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি একজন মানুষও যদি থাকে, এই লেখা তার অন্বেষণ করে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক বলে যাঁরা পরিচিত, প্রধান নেতা থেকে শুরু করে পাড়াগাঁয়ের কর্মী পর্যন্ত, সবার দিকে তাকিয়ে আমরা আজ প্রমাদ গুনি। বলি, ‘এ জগতে হায়, সেই বেশি চায়, আছে যাঁর ভূরি ভূরি/ রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’।
শুধু কি বঙ্গবন্ধুর সৈনিক? ‘কমিউনিস্টরাও’ ফিরে গেছে সুবিধাবাদের অন্বেষণে। কেউ-ই রইল না আর গরিবের পাশে! শ্রমিকের, দিনমজুরের, গৃহকর্মীর ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর পক্ষে কথা বলার একজন সাংসদ বা মন্ত্রীও আমরা খুঁজে পাই না। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে উঁচুতলার লোকদের দেখতে আজ আমাদের আকাশের দিকে তাকাতে হয় আর নিচুতলার মানুষেরা হারিয়ে যায়।
ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। [email protected]