প্রাইমারি স্কুলে যে সংস্কার জরুরি
১৯৬০-এর দশকে আমাদের স্কুলজীবন কেটেছে। সেকালে ৯৮ ভাগ প্রাইমারি স্কুলের কোনো ভবনই ছিল না। মনে আছে, যশোর জেলায় আমাদের ডিহি ইউনিয়নে যে ছয়টি প্রাইমারি স্কুল ছিল, তার মধ্যে আমাদের শালকোনা-শিববাস প্রাইমারি স্কুল, ডিহি ও কাশিপুর প্রাইমারি স্কুলের ইটের দেয়াল আর টিনের চাল ছিল। মেঝে কাঁচা। দুটো স্কুল ছিল কোনোরকমে বাঁশের খুঁটির ওপর গোলপাতা বা খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘরে। খুঁটিতে একটা ব্ল্যাকবোর্ড ঝুলত। খান কয়েক বেঞ্চ, একটি বা দুটি চেয়ার। আর কিছু ছিল না। মডেল প্রাইমারি স্কুল হলেও টেংরালি স্কুলে ছিল টালির চাল, ঘরটাও ছোট। আলাদা কক্ষ ছিল না। অল্প কিছু বেঞ্চ ছিল, গোটা তিনেক ছোট টেবিল ও চেয়ার। কোনো আলমারি ছিল না। স্কুলের খাতাপত্র বলতে একটা শিক্ষক হাজিরা ও আলাদা পাঁচটা ছাত্র হাজিরা। স্কুলের পাশে কারও বাড়িতে খড়ের চালে একটা কাঠের ছোট্ট তাকে তা রাখা হতো। মানি অর্ডারে শিক্ষকের বেতন আসত নিয়মিত। মাসে ১৫ টাকা। এ জন্য স্কুল থেকে একটা রিটার্ন পাঠাতে হতো থানা–জেলা শিক্ষা অফিসে। অধিকাংশ শিক্ষক নন-মেট্রিক, তবে গুরু ট্রেনিং করা। সেকালে মেট্রিক পাস শিক্ষক ছিলেন খুবই সম্মানের অধিকারী।
সাধারণত স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে ধান-পাট সংগ্রহ করে মেটানো হতো স্কুলের অন্যান্য খরচ। যেমন চক, পেনসিল কেনার খরচ। ফুলের বাগান করত ছাত্ররাই। স্কুল ঝাড়ু দিত পড়ুয়া মেয়েরা। ছেলেরা খেলার মাঠ পরিষ্কার করত। ফুল–বাগানের বেড়া তৈরি করত কারও ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে এনে। এসব কাজ মুজুরি করা হতো না। কোনো স্যানিটেশন–ব্যবস্থা তো ছিল কল্পনার বাইরে। শুধু আমাদের স্কুলে একটা নলকূপ বসানো হয় মধ্য ষাটের দিকে। স্কুলের ছেলেমেয়েরা পাশের বাড়ি গিয়ে কুয়ো থেকে বালতিতে করে পানি তুলে খেয়ে আসত।
আমাদের প্রাইমারি স্কুলে একটা কাঠের আলমারি ছিল, স্কুলের হাজিরা খাতা তাতে রাখা হতো। আমরা যখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি, তখন নূরল ইসলাম দেওয়ান নামে একজন শিক্ষক আসেন। গল্প–উপন্যাস পড়তে তিনি খুব ভালোবাসতেন। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস তাঁর হাতেই প্রথম দেখি। কোথা থেকে তিনি চমৎকার ছবিওয়ালা কিছু বুকলেট আনতেন। তাতে সুন্দর সুন্দর ছবি। মনে আছে, তাঁর কাছেই প্রথম বিজ্ঞানী আইজাক নিউটনের ছবি দেখেছিলাম। অমন পরিপাটি চুলের সুপুরুষের ছবি আগে কখনো দেখিনি।
আমাদের স্কুলের আলমারিতে আরও কিছু বই দেখেছি। ‘জাতকের গল্প’, ‘সিন্দাবাদের কাহিনি’, ‘আরব্য রজনী’—এ রকম বই। ছিল হাসির গল্প, ভূতের গল্প। একটা বই দেখেছি, নাম ভুলে গেছি, লাল, নীল, সবুজ, হলুদ পাতায় ছাপা। তাতে কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী, কাণ্ডারি হুঁশিয়ার ইত্যাদি কবিতা, কিছু গান, নাটিকা ছিল। আরেকটা বইয়ে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতা আর কিছু গল্প। ছিল ‘সিরাজউদ্দৌলাহ’ নাটক। আমাদের গ্রামের দুই উৎসাহী তরুণ আবদুল মান্নান ও মনছুর আলী এসব বই থেকে আমাদের কবিতা আবৃত্তি, গান ও নাটকে অভিনয় শেখাতেন। হেড স্যার লুৎফর রহমান তাঁদের খুব তারিফ করতেন।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু একযোগে সব প্রাইমারি স্কুল (প্রায় ১৮ হাজার) সরকারি করে দেন। কিন্তু দেশে তখন ভীষণ খাদ্যাভাব। অবকাঠামো উন্নয়নের মতো আর্থিক সামর্থ্য ছিল না। গরিব মানুষ ছেলেদের স্কুলে না পাঠিয়ে খেতখামারে কাজে পাঠাত। ইচ্ছে থাকলেও ছেলেকে স্কুলে পাঠানোর সামর্থ্য ছিল খুব কম লোকের। কিছু বাড়ির মেয়েরা দুই এক বছর স্কুলে যেত। থ্রি-ফোরে ওঠার বয়স হলেই বিয়ে দিয়ে বাবা-মা নিশ্চিন্ত হতে চাইতেন।
গত পঞ্চাশ বছরে অনেক বদলে গেছে দেশ। এখন গ্রামে গ্রামে স্কুল। সকাল হতেই ছেলেমেয়েরা সার বেঁধে স্কুলে যায়। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ সাইকেলে, কেউ ভ্যান–নছিমনে চেপে। বছরের পয়লা দিনে নতুন বই পাচ্ছে। এখন তাদের খাতাপত্র, জামা–জুতো, দুপুরে খাবার দেওয়ার আয়োজন চলছে। ২০১৫ সালের মধ্যে শতভাগ শিশুকে স্কুলে আনার জন্য জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। আমরা ২০১৩ সালেই ৯৭ ভাগ শিশুকে স্কুলে আনতে পেরেছি। শেখ হাসিনা ২০১৩-১৬ সালে ২৬ হাজারের বেশি প্রাইমারি স্কুল সরকারি আওতায় এনেছেন।
গ্রামে এখন আমাদের যুগের মতো ভাঙা স্কুলঘর প্রায় নেই। পাকা ভবন হয়েছে। শতভাগ প্রাইমারি শিক্ষকের চাকরি এখন সরকারি। বেতন, পেনশনের ব্যবস্থা হয়েছে। স্কুলপ্রতি শিক্ষকের সংখ্যাও বেড়েছে। অনার্স, এমনকি মাস্টার ডিগ্রিধারী প্রচুর শিক্ষক এখন প্রাইমারি স্কুলে। তাঁদের সি-ইন-এড, কারও কারও বিএড, এমএড ট্রেনিং আছে। অনেক গ্র্যাজুয়েট শিক্ষক ডিপ-ইন-এড ট্রেনিং লাভ করেছেন। ক্লাস্টার পদ্ধতি চালু হয়েছে এক দশক আগেই। ব্যবস্থা আছে সঞ্জীবনী প্রশিক্ষণের। বলা যায়, চোখে পড়ার মতো উন্নতি ঘটেছে।
কিন্তু কমতি কি নেই? আছে, বিস্তর খামতি আছে। এখন সেগুলো ধীরে ধীরে মেটাতে হবে। আজকের আলোচনা আমরা প্রাইমারি স্কুলের অবকাঠামোগত উন্নয়নে সীমাবদ্ধ রাখছি।
আমরা লক্ষ করেছি, অবকাঠামো বা ভবন উন্নয়নে অপব্যয়, দুর্নীতি, স্বেচ্চাচারিতার বিস্তার ঘটছে। আমাদের দেশে জমির সংকট প্রকট। শিশুদের খেলাধুলার মাঠের সংকট বাড়ছে। কিন্তু একই স্কুলে পুরোনো ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করে (বা না করে) আরেকটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রতিবারই ভবনের নকশা বদল করে নতুন ধরনের একজাতীয় ভবন তৈরি করা হচ্ছে। এতে জায়গা নষ্ট হচ্ছে, সৌন্দর্যহানি ঘটছে, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে।
প্রি-প্রাইমারিসহ এখানে মোট ছয় ক্লাস পড়ানো হয়। কিন্তু ভবনগুলো তিন রুমের। ভবন নির্মাণে ভৌগোলিক পরিবেশ বিবেচনা করা হয় কম ক্ষেত্রেই। প্রাকৃতিক আলো–বাতাস পাওয়ার সহজ বিষয় বিবেচনায় রাখা হয় না। ভবনগুলোয় বায়ু চলাচলের উপায় কম। জানালা-দরজা প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের জন্য যথেষ্ট খোলামেলা নয়। শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বসার ঘর, লাইব্রেরি ব্যবস্থা নেই, নেই আইসিটি পাঠের উপযোগী রুমের ব্যবস্থা। প্রাইমারি স্কুলের জন্য কমপক্ষে ছয়টা ক্লাসরুম ছাড়াও স্বতন্ত্র শিক্ষক কক্ষ, লাইব্রেরি ও আইসিটি রুম নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।
সুতরাং প্রাইমারি স্কুলগৃহ নির্মাণে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। নকশা পরিবর্তন, জমি অপচয় রোধ, একতলার জায়গায় দুই বা তিনতলা স্কুলগৃহ নির্মাণ, স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, আইসিটির জন্য উপযুক্ত আসবাব, খেলার সামগ্রী সরবরাহ ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা আশু প্রয়োজন। পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে ২০৩৫ সালের মধ্যে এসব সুবিধা নিশ্চিত করা যায়। এভাবে আমরা ২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত দেশের স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে পারব।
আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
amirulkhan7@gmail. com