প্রশ্নফাঁস: একটি জাতীয় শিল্পের আত্মপ্রকাশ
প্রশ্নফাঁস যেহেতু বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে, যেহেতু এর জন্য কেউ দায়ী নয়, সেহেতু একে এখন মেনে নিলেই হয়! মেনে নেওয়ার জন্য প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে একে জাতীয় ঐতিহ্য ঘোষণা করা। এই সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে উদীয়মান ও সম্ভাবনাময় শিল্পের নাম প্রশ্নপত্র ফাঁস শিল্প। এই শিল্প অতি আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর, জনপ্রিয় ও অপ্রতিরোধ্য। বাংলাদেশ সরকার দাবি করে, তারা এ শিল্প বিকাশের বিরোধী। কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয় হলো, কোনো গবেষণা এবং সরকারের সদিচ্ছা ও পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই কোনো শিল্পের এ রকম বিকাশ রীতিমতো ঈর্ষণীয়! অবশ্য সদিচ্ছার অভাবই-বা বলি কী করে, সরকারের অনিচ্ছায় গুমের খবর ফাঁস হয় না, সেখানে প্রশ্নফাঁস হয় কী করে? এত বড় অবদানে সরকারের কৃতিত্ব অস্বীকার করা বড়ই অকৃতজ্ঞতা হয়ে যাবে।
বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত নানা ধরনের গবেষণা ইনস্টিটিউটের সংখ্যা নেহাত কম নয়। যেমন: প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, রেশম গবেষণা ইনস্টিটিউট, চাল, ধান, ইক্ষু, চা, আম, রেশম, তুলা—এ রকম কতই-না ইনস্টিটিউট! এই গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ তাদের অভিনব গবেষণালব্ধ জ্ঞান দিয়ে দেশকে সমৃদ্ধ করার বেলায় কতটা ভূমিকা রেখেছেন, তা বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের কাছে ততটা স্পষ্ট নয়। কিন্তু সরকারি সব উদাসীনতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এবং কোনো গবেষণালব্ধ জ্ঞান ছাড়াই প্রশ্নফাঁসের যে বিস্ময়কর শিল্প ও সংস্কৃতি বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে, তা তাবৎ দুনিয়াকে তাক লাগানোর মতো।
প্রশ্নপত্র ফাঁস ইতিমধ্যেই যে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, এ বিষয়ে কারও আর কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। এটা সত্য যে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার ইতিহাস বাংলাদেশে বেশ পুরোনো। তবে ২০১২ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কোনো পাবলিক পরীক্ষা ফাঁস হওয়ার অভিযোগ ছাড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে হয় না। এ প্রক্রিয়া এতটাই শৈল্পিক যে তা মানছে না শিক্ষার্থীর বয়স, শ্রেণি, পরীক্ষার ধরন, ঋতুর বৈচিত্র্য ইত্যাদি! এটি এতটাই অনিবার্য যে একে রোধ করতে পারছে না রাস্তার যানজট, কিংবা ইন্টারনেটের স্পিডজট। সরকারি ঘোষণায় ইন্টারনেটের স্পিড হাঁসফাঁস করে; কিন্তু এরপরও প্রশ্নপত্র দায়িত্বের সঙ্গে উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যায়। সরকারি তৎপরতায় যদিও-বা জেএমবির ভয়ংকর জঙ্গি ধরা পড়ে, কিন্তু পুরস্কার ঘোষণার পরও ধরা পড়ে না প্রশ্ন ফাঁসকারী অপরাধী। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা শুরু হওয়ার আধা ঘণ্টা আগে উপস্থিত হয়ে পরীক্ষার হলকে মশা-মাছিমুক্ত করতে পারে, কিন্তু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রশ্নফাঁসমুক্ত করতে পারে না পরীক্ষার হলগুলোকে। পরীক্ষার আগে কোচিং সেন্টারের দরজায় তালা ঝোলে কিন্তু সিলগালা করা প্রশ্নপত্র বাইরে বেরিয়ে এসে নির্লজ্জের মতো হাসতে থাকে। পরীক্ষা কেন্দ্রের ২০০ মিটারের মধ্যে মুঠোফোনের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হলেও আলাদিনের প্রদীপের জাদুর দৈত্য নাকি ঠিকই পরীক্ষার হলে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র নিয়ে হাজির হয়ে যায়!
এবার বাসভর্তি ফাঁস প্রশ্নপত্র নাকি ঢুকে পড়েছে পরীক্ষাকেন্দ্রে। আর কী বাকি রইল! এ বয়সেই একদিকে প্রশ্নফাঁস ব্যবসায় হাতেখড়ি আর অন্যদিকে হাজতবাসের অভিজ্ঞতা তাদের বাস্তব দুনিয়ার ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করার জন্য আরও বেশি যোগ্য করে তুলছে। এটি কি কেউ তলিয়ে দেখেছে! ভীতসন্ত্রস্ত ক্রন্দনরত ১১ জন পরীক্ষার্থীকে আসামিদের জন্য নির্ধারিত কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে পর্দার অন্তরালে নিশ্চিন্তে ঘুমান সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা গ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তাব্যক্তিরা এবং প্রশ্নফাঁসের মূল কুশীলবেরা। সরকারিভাবেই তো প্রশ্নফাঁসের জন্য তাঁদের দায়মুক্তি দিয়ে রাখা যখন হয়েছে, তখন কেন তাঁদের এই মহান অবদান জাতীয়ভাবে স্বীকার করা হবে না?
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বশীল সচিব মহোদয় স্বীকার করে নিয়েছেন যে বর্তমান প্রক্রিয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো বেশ কঠিন; অনেক কর্মকর্তার ভাষায় যা অসম্ভব। এই যখন বাস্তবতা, তখন শুধু শুধু প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানোর জন্য পণ্ডশ্রমের কোনো মানেই হয় না; বরং প্রশ্নপত্র ফাঁস শিল্প বিকাশে এখন প্রয়োজন আরও খোলামেলা সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সহযোগিতা ও বিনিয়োগ। তাই বিষয়টিকে অবিলম্বে ক্রমবিকাশমান শিল্পের স্বীকৃতি প্রদান করার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি। অনতিবিলম্বে ‘প্রশ্নফাঁস বিকাশ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট’ স্থাপন করা জরুরি। এত দিনের সৃজনশীল প্রশ্নপত্র উদ্ভাবন ও বিকাশের অভিজ্ঞতাকে এবার প্রশ্নফাঁস শিল্পের সৃজনশীলতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। দ্রুত ও ব্যয়সাশ্রয়ী পন্থায় ফাঁস হওয়া সঠিক প্রশ্নপত্র কীভাবে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব, তা নিয়ে গবেষণা করা অত্যন্ত জরুরি।
আরও একটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আর তা হলো যেসব অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দেওয়া নিয়ে বিবেকের দংশনে ভুগছেন, তাঁদের এই মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন মূল্যবোধের বিলুপ্তিবিষয়ক উন্নত প্রশিক্ষণ। ইতিমধ্যে তাঁদের কেউ কেউ চাঁদা দিয়ে ফাঁসকৃত প্রশ্ন কেনার তহবিল গঠন করেছেন। সেসব ফাঁসের প্রশ্নের উত্তর তড়িঘড়ি করে খোঁজার জন্য একদল শিক্ষকও অপেক্ষায় থাকবেন। প্রশ্নফাঁসের বিষয়টিকে শুধু প্রশ্নপত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে উত্তরপত্রের মধ্যেও কীভাবে বিস্তৃত করা যায়, তার পথ এঁরাই দেখাচ্ছেন। শুধু ফাঁসকৃত আসল প্রশ্নপত্র শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিলেই চলবে না, তাদের উত্তর লেখার পরিশ্রম থেকেও মুক্তি দিতে হবে। শিক্ষকদের পরীক্ষার হল টহলের ক্লান্তিকর দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিকে কীভাবে আরও নিবিড়ভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে, সে চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। পুরো প্রক্রিয়া পরিচালনা ও সমন্বয়ের জন্য সরকার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসবিষয়ক অধিদপ্তর’ গঠনের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বাইরেও শিল্পটির বাণিজ্যিক বিকাশ, বিপণন আর বাজারজাতকরণে এগিয়ে আসতে হবে দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে। যেহেতু প্রক্রিয়াটির সঙ্গে শুধু শিক্ষার্থীই নয়, সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন তাদের মা-বাবাসহ পরিবার ও সমাজের অনেকেই, তাই তাঁদের কথাও মাথায় রাখতে হবে। প্রশ্নের বাণিজ্যিকীকরণ তাঁরা বিবেচনা করতে পারেন নানান প্যাকেজ, যেমন: পিয়ার প্যাকেজ, প্যারেন্টস প্যাকেজ, ফ্যামিলি প্যাকেজ, কমিউনিটি প্যাকেজ ইত্যাদি। তাঁরা দিতে পারেন ‘প্রশ্নপত্র কিনলে উত্তরপত্র ফ্রি’-জাতীয় অফারগুলো। ইতিমধ্যেই ফাঁস প্রশ্নের আদান-প্রদানের মূল্য পরিশোধের মাধ্যম হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং রীতিমতো ফুলেফেঁপে উঠেছে। ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলোও আনতে পারে আজীবন শিক্ষার্থীদের এমনকি তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ফাঁস প্রশ্ন নিশ্চিতকরণের নানা স্কিম। বাংলা সিনেমার পরিচালকেরা ‘পরীক্ষার্থী কেন আসামি?’ বা এ ধরনের টাইটেলে সিনেমা নির্মাণের কথা ভাবতে পারেন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে প্রশ্নপত্র ফাঁস শিল্পের বিকাশে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সমন্বিতভাবে এ বিষয়গুলোর প্রতি যত্নবান হলে প্রশ্নফাঁস শিল্পে বিশ্বদরবারে অচিরেই বাংলাদেশ হবে এক নম্বর। আসুন, আমরা প্রশ্নফাঁস শিল্পের বিকাশে যার যার অবস্থান থেকে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করি।
নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক।
[email protected]