এপ্রিল পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে আমাদের প্রবাসী রেমিট্যান্স ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এই রেমিট্যান্স বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে ৪৫ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে গেছে। এটি প্রায় ১১ মাসের আমদানি দায়ের সমান। কয়েক দশক ধরে তো বটেই, কোভিডের সময়ও অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে করোনায় প্রবাসী শ্রমিকেরা চাকরি হারিয়ে কেউ দেশে ফেরত এসেছেন, কেউ সেখানে কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। এ সংকট ক্রমেই বাড়ছে।
ব্র্যাক, ইউএন ওমেন ও নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অন ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশনের এক যৌথ গবেষণা বলছে, গত বছরের এপ্রিল-নভেম্বর সময়কালে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের প্রায় ৭৭ শতাংশই দেশে চাকরি খুঁজেছেন। ফেরত আসা প্রবাসীদের জন্য সরকার প্রণোদনা প্যাকেজসহ নানা উদ্যোগ নিলেও তার সুফল যে মিলছে না, গবেষণা প্রতিবেদন তাও বলছে। প্রবাসীদের সহায়তার প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের তাই নতুন করে ভাবতে হবে।
প্রবাসী শ্রমিকদের বেশির ভাগ অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা রকম কাজে যুক্ত ছিলেন। করোনায় অনেক দেশেই এসব কাজের চাহিদা কমে গেছে। এ কারণে অনেক প্রবাসী শ্রমিককে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। তাঁদের অনেকেই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে শুধু ফেরত আসা শ্রমিকই নন, পুরো পরিবারই সমস্যায় পড়েছে। ফেরত আসা শ্রমিকদের পুনর্বাসনে ইতিমধ্যে ২০০ কোটি টাকা ঋণ কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। বরাদ্দ অর্থের ৫ শতাংশের কম বিতরণ হওয়াটা খুবই হতাশাজনক।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রবাসী শ্রমিকদের বড় একটি অংশ এই ঋণসুবিধা সম্পর্কে জানেনও না। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে এ ঋণ দেওয়া হচ্ছে। সারা দেশে এই ব্যাংকের শাখা মাত্র ৬৬। বিদেশফেরত শ্রমিকদের ঋণসুবিধা দিতে হলে অন্যান্য ব্যাংকের সহায়তা নিতে হবে। প্রয়োজনে সুদের হার কমাতে হবে। বিদ্যমান প্রণোদনা মূলত ব্যাংকিং চ্যানেল ও শর্তভিত্তিক ঋণ হওয়ায় অনেকেই এই সুবিধা নিতে পারছেন না। প্রণোদনার অর্থ ছাড়ে জটিলতা দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাংকের ঋণের শর্ত পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। সহায়তার পরিমাণ বাড়ানোও জরুরি।
তা ছাড়া প্রবাসী শ্রমিকেরা ঋণ নিয়ে কী করবেন? দীর্ঘদিন তাঁরা চাকরি করে এসেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের কোনো অভিজ্ঞতা তাদের নেই। ঋণসুবিধার পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের বিনিয়োগের তথ্যসহায়তা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করারও প্রয়োজন রয়েছে। স্বনিয়োজিত কাজ ছাড়া ফেরত আসা প্রবাসীদের দক্ষতা স্থানীয়ভাবে কাজে লাগানোর জন্য জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে।
কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ তাই গ্রামীণ ব্যাংক বা ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণের মতো সমবায় পদ্ধতিতে সামাজিক ব্যবসায় ঋণ দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। প্রশিক্ষণ না দিয়ে শ্রমিকদের ঋণ দিয়ে সরকার বা প্রবাসী মন্ত্রণালয় দায়িত্ব শেষ করলে বিদেশফেরত শ্রমিকেরা লাভবান হবেন না। নারী শ্রমিকদেরও আলাদা প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তাঁরা নিজেরাই ব্যবসা করতে পারেন। বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিকদের আর্থিক প্রণোদনা প্রদানে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কার উদাহরণ বিবেচনায় নেওয়া যেতে পারে। দেশগুলো নগদ আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি প্রবাসফেরতদের দক্ষ করে তুলতে নানামুখী প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান তৈরিতে বিশেষ জোর দিয়েছে। শ্রীলঙ্কা দক্ষ নার্স তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।
অনেক দিন ধরেই প্রবাসী ও বিদেশে যেতে আগ্রহী শ্রমিকদের বিশেষ বিশেষ কাজের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয়ে আসছে। ফেরত আসা প্রবাসীদের সমস্যার টেকসই সমাধানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলছেন অনেকে। ছোট ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়া গেলে ফেরত আসা দক্ষ লোকজনকে দেশের ভেতরেই চাকরি দেওয়া যেত। দেশে চলমান বৃহৎ নির্মাণ প্রকল্পেও প্রবাসফেরত সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের নিয়োজিত করা যায়। অনেকে আবার বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা ও আধুনিক জ্ঞান অর্জন করেছেন। তাঁদের সে জ্ঞান ব্যবহার করেও দেশ উপকৃত হতে পারে।
অন্যদিকে যাঁরা দেশের বাইরে আছেন, তাঁদের কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে হবে। নতুন করে যাঁরা বিদেশে যেতে আগ্রহী ও পুরোনো যাঁরা ফেরত যেতে চান, তাঁদের জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি প্রশাসনিক জটিলতা দূর করা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্যে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগে প্রীত হয়েছি। বিদেশে ফেরত যেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে অতিরিক্ত বিমান ফ্লাইটের ব্যবস্থাসহ কিছু ক্ষেত্রে ভিসা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে তাঁদের জন্য নির্ভরযোগ্য এবং সুলভ মূল্যে কোভিড টেস্টের ব্যবস্থা থাকাও দরকার। একই সঙ্গে তাঁদের টিকা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়াও প্রয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য নিজ অর্থায়নে বিদেশে গিয়ে টিকা প্রদান করছে। বাংলাদেশও এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে পারে।
সার্বিকভাবে আমাদের অভিবাসীরা স্বল্প দক্ষ ও নিম্ন উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত বলে যেকোনো ধরনের অর্থনৈতিক অভিঘাত তাঁদের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। অর্থনীতিকে চাঙা করতে তাই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত অভিবাসীদের বহির্বিশ্বের শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী শিক্ষিত ও দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা। করোনা-পরবর্তী নতুন বিশ্বের জন্য যেসব খাতে দক্ষ লোকের প্রয়োজন, সেই প্রস্তুতিও নিতে হবে এখনই।
আগেই বলা হয়েছে, ফেরত আসা প্রবাসীরা আর্থিক সংকটে থাকায় হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছেন। এমনিতেই দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি, তার ওপর করোনার কারণে অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্ম হারিয়েছেন অনেকে। অন্যদিকে গত কয়েক বছর অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজের সুযোগও বাড়েনি। সব মিলিয়ে দেশে চাকরির বাজারে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়ছে না। ফলে সহসাই কর্মসংস্থানের অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই বিদেশই ভরসা। তবে সেটি ধরতে হলে প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবলের বিকল্প নেই। দক্ষতা সৃষ্টি ও নতুন নতুন বাজার সন্ধান—যুগপৎ দুইই চালিয়ে যেতে হবে।
মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক