লেখার শিরোনাম দেখে চমকে যাবেন না। কারণ, ‘এটাই সায়েন্স’। দেশের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে চতুর্থ শ্রেণির পদে (শিরোনামে উল্লিখিত) নিয়োগ হয় না বেশ অনেক বছর। ফলে এগুলো ধীরে ধীরে শূন্য হয়েছে। এরপরও যাঁরা আছেন, তাঁরা হয় কলেজে, না হয় কোনো দপ্তরে বদলি হয়ে যেতে আগ্রহী।
২০১৯ সালের জাতীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদ আছে ১৪টি। এর মধ্যে ১২টিই শূন্য। একমাত্র পিয়নকেও একটি কলেজে বদলি করে দেওয়া হয় নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে। ২৩ নভেম্বর এসএসসি পরীক্ষার শেষ দিনে পরীক্ষার প্রশ্নের ট্রাংক নামাতে গিয়ে হাতে-ঘাড়ে ব্যথা পান স্কুলের প্রধান শিক্ষক নাছিমা আক্তার। জাতীয় পর্যায়ের দু-দুবারের সেরা এই প্রধান শিক্ষক তাঁর ছাত্রছাত্রীদের কাছে মায়ের মতোই সম্মান পান। পরদিন বার্ষিক পরীক্ষার জন্য বেঞ্চ ঠিক করে আসনবিন্যাসের কাজটা শিক্ষকদেরই করতে হয়েছে। পিয়নশূন্য স্কুলে পরদিন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকেরা সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে প্রধান শিক্ষক তাদের শান্ত করেন। অন্য শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে ব্যানারে শিরোনামের কথাগুলো লিখে স্কুলের সামনে বসে পড়েন। ওই দিন কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলে এবং পরদিন কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে এই সংবাদ ছাপা হয়েছে (১২টি পদ শূন্য, ফেস্টুন টানিয়ে প্রতিবাদ প্রধান শিক্ষকের, প্রথম আলো, ২৫ নভেম্বর)। এটুকু পড়ে হয়তো পাঠক ভাবছেন বিদ্যাময়ী স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শূন্যপদের সমাধান হয়েছে? না, হয়নি।
২০৪১ সালে একটি উন্নত জাতি যারা গঠন করবে, তারা এখন আমাদের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী। যাঁরা তাদের গড়ে তুলছেন, সেই শিক্ষকদের প্রতি নজর না দিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সহজে সমাধানযোগ্য সমস্যা জিইয়ে রেখে আর যা-ই হোক উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন যে অধরাই থেকে যাবে, সেটা কে না জানে
বিদ্যালয়গুলোর ক্লাসরুম, ওয়াশরুম, অভ্যন্তরীণ ড্রেন, রাস্তা, বিশাল আঙিনা, সিঁড়ি, বারান্দা, করিডর, লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, নামাজ ঘর, অজুখানা পরিষ্কার রাখতে, ময়লা বাইরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসতে ন্যূনতম কতজন লোকের প্রয়োজন? চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ মোছা, ঘণ্টা দেওয়া, নোটিশ, চিঠি পাঠানো, ব্যাংক, ট্রেজারি—এই সব জায়গায় কতজন লোকের প্রয়োজন? স্কুলগুলোতে আয়া, পিয়ন, মালি কিংবা দারোয়ান নেই কিন্তু স্কুল পরিষ্কার রাখতে হয়, বাগানে ফুল ফোটাতে হয়। এই বিষয়গুলো যাঁদের দেখার কথা, তাঁরা কি দেখতে পান না?
স্কুলের শিক্ষককে কলেজে বদলি করা না গেলেও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কিন্তু যায়। বেশির ভাগ স্কুলের পিয়ন বা অনুরূপ কর্মচারীরা তাই কোনো অফিসে বা কলেজে বদলি হতে চেষ্টা করেন। এর অন্যতম কারণ অনেকগুলো মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুটি শিফট চালু রয়েছে। ফলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আয়া-দপ্তরি-মালিদের কাজ করতে হয়। কিন্তু কলেজে ওত খাটুনি নেই। তা ছাড়া বাড়তি আয়ের সুযোগ আছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
ডাবল শিফট মানে পরিপূর্ণ দুটি স্কুল। প্রধান শিক্ষকেরা এ জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা ডাবল শিফট ভাতা পান। স্কেল বাড়লে বা গ্রেড চেঞ্জ হলেও, এমনকি জাতীয় বেতন স্কেল পরিবর্তিত হলেও এটি একই থাকে। অথচ কারিগরি অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠানগুলোর সেকেন্ড শিফট ভাতা ৩০ শতাংশ!
সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে গ্রন্থাগার রয়েছে। তবে গ্রন্থাগারিকের কোনো পদ নেই। যদিও সব কলেজ এবং বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এই পদ রয়েছে। পাঠক জেনে অবাক হবেন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আইসিটি শিক্ষকেরও কোনো পদ নেই। যদিও সরকারিভাবে এখন দেশের কয়েক হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব রয়েছে। এ ছাড়া যেসব স্কুলে বিজ্ঞান শাখা রয়েছে, সেখানে বিজ্ঞানাগার আছে। কোনো সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্টের কোনো পদই নেই! ভাবা যায়!
সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের এত এত সমস্যার সমাধান না হওয়ার কারণ কী? ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময় শিক্ষানীতি প্রণয়নকারীরা বিষয়টি সম্যকভাবেই উপলব্ধি করেন। ব্যানবেইসের ২০২০ সালের হিসাব অনুসারে সারা দেশে কলেজ আছে ৪ হাজার ৬৯৯টি, মাধ্যমিক স্তরে স্কুলের সংখ্যা ২০ হাজার ৮৪৯টি, মাদ্রাসা ১৩ হাজার ৯০২টি ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৪ হাজার ৭৮৫টি।
এত বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা যাতে সহজ ও কার্যকর হয়, সে জন্য ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতে এ-সংক্রান্ত সুস্পষ্ট সুপারিশ করা হয়েছ। বলা হয়েছে, ‘শিক্ষা প্রশাসনে বর্তমান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে দুটি পৃথক অধিদপ্তর যথাক্রমে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর গঠন করা হবে। শিক্ষা প্রশাসনে নিয়োজিত সব সংস্থার দায়িত্ব নির্ধারণ করে তা যথাযথভাবে পালনের জন্য লোকবল ও অর্থবলের ব্যবস্থা করা হবে।...মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাপনার জন্য একটি পৃথক মাদ্রাসা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হবে।’ (জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০, পৃষ্ঠা ৬৪)।
শিক্ষানীতির আলোকে ১৩ হাজারের অধিক মাদ্রাসার জন্য ২০১৫ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার কারিগরি প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি আলাদা অধিদপ্তর আগে থেকেই বিরাজমান। কিন্তু ২০ হাজারের অধিক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য আলাদা কোনো তদারকি সংস্থা নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) একই সঙ্গে বিপুলসংখ্যক মাধ্যমিক ও কলেজ নিয়ন্ত্রণ করে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষা প্রশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও অর্থবলের সুপারিশ করা হলেও সেটিও বাস্তবায়িত হয়নি। মাউশির অধিকাংশ কর্মকর্তাই প্রেষণে আছেন। যেহেতু মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রেষণে আসার নিয়ম নেই, তাই মাউশির অধিকাংশ কর্মকর্তাই কলেজ থেকে আসেন। ফলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সমস্যাগুলো ঠিকভাবে উঠে আসে না।
২০৪১ সালে একটি উন্নত জাতি যারা গঠন করবে, তারা এখন আমাদের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী। যাঁরা তাদের গড়ে তুলছেন, সেই শিক্ষকদের প্রতি নজর না দিয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সহজে সমাধানযোগ্য সমস্যা জিইয়ে রেখে আর যা-ই হোক উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন যে অধরাই থেকে যাবে, সেটা কে না জানে।
মুনির হাসান প্রথম আলোর যুব কার্যক্রম ও অনুষ্ঠান প্রধান