বাংলাদেশে ২০২০ সালে লকডাউনটি কতটা কার্যকর হয়েছে, তা নিয়ে জনগণ ও বিশেষজ্ঞ—এ দুই পক্ষেরই নানা মতামত রয়েছে। মন্তব্যগুলোয় চোখ বোলালে অনেকের কাছেই লকডাউন কার্যকর করার ব্যাপারে সরকারের ইচ্ছা এবং এর কার্যকারিতা সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের ভেতর নেতিবাচক ধারণাই যে প্রধান, তা মনে হবে। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কঠোর লকডাউন নিয়ে সরস কৌতুক এবং সন্দেহমূলক মন্তব্য এমন ধারণাকে আরও জোরালো করে।
এসব প্রতিক্রিয়া মোটামুটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ধারণারই বহিঃপ্রকাশ। আপাতদৃষ্টে যা মনে হয়, তার বাইরেও মতামত আছে এবং তা যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত ধারণা থেকে অনেকটাই ভিন্ন। এ বছরের শুরুতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) সারা দেশে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বমূলক (২৭৫০ সাধারণ জনগণ) এবং বিশেষায়িত (৫০০ জন তরুণ ও ৪০০ জন বস্তিবাসী) টেলিফোনভিত্তিক জরিপ চালিয়েছে এ বিষয়ে। জরিপে দেখা গেছে, সরকারের লকডাউন ব্যবস্থাপনা নিয়ে জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি খুব একটা নেতিবাচক নয়। বরং জনগণ লকডাউনের সাফল্য, বাধা এবং তা আরও কার্যকর করার উপায় নিয়ে গঠনমূলক কথা বলেছে।
জনসাধারণ যাতে লকডাউন সঠিকভাবে পালন করে, সে জন্য সরকারের উচিত বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যেমন কমিউনিটি গ্রুপ, যুব সংঘ, এনজিও এবং অন্যান্য নাগরিক সংঘের সাহায্য নেওয়া। এতে জনসচেতনতা বাড়বে এবং জনগণ লকডাউনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে
২০২০ সালের লকডাউন নিয়ে জনগণের ভাবনা কী ছিল? লকডাউন তখন কঠোরভাবে পালিত হয়েছিল কি? জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের অধিকাংশই (৫৭ শতাংশ) মনে করেন, তাঁদের এলাকায় লকডাউন কঠোরভাবে পালিত হয়েছে। এর বাইরে বেশির ভাগ মানুষ বলেছেন, লকডাউনে ঢিলেঢালা বা কিছুটা গা-ছাড়া ভাব ছিল। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের তুলনায় বেশি শহরের বাসিন্দা কঠোর লকডাউন হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যাঁরা শিথিল লকডাউনের কথা জানিয়েছেন, তাঁদের অধিকাংশ (৭১ শতাংশ) মনে করেন, জনসাধারণের জীবিকার প্রয়োজনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই সরকারের পক্ষ থেকে লকডাউন খুব একটা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়নি। শহরের বস্তিবাসীর মধ্যে এমন ধারণার হার আরও বেশি (৭৭ শতাংশ)।
লকডাউনের কারণে এলাকার মানুষের জীবনযাত্রায় কী কী প্রভাব পড়েছিল? এ ব্যাপারে জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় সবাই আয় কমে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন, আর মোটামুটি তিন-চতুর্থাংশ মানুষ লকডাউনে চাকরি বা কাজ হারানোর কথা উল্লেখ করেছেন। বস্তিতে বসবাসকারী যাঁরা জরিপে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই আয় কমে যাওয়ার কথা বলেছেন, আর ৮৩ শতাংশ বস্তিবাসী কাজ হারিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তরুণদের মধ্যে আয় হারানোর কথা জানিয়েছেন ৮৭ শতাংশ আর ৬৯ শতাংশ জানিয়েছেন কাজ হারানোর কথা। আয় এবং কাজ ছাড়া লকডাউনের প্রভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে ক্ষতির কথা উঠে এসেছে এ জরিপে। বিশেষত বস্তিবাসীর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মানসিক স্বাস্থ্যহানির বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। করোনা মহামারি প্রতিরোধে লকডাউন যতই প্রয়োজনীয় হোক না কেন, অধিকাংশ নাগরিকের জীবনযাপন যে এতে তীব্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
জরিপে অংশগ্রহণকারী মানুষের অধিকাংশই (৮৫ শতাংশ) লকডাউন উঠিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছেন। এর বিপরীতে মাত্র ১১ শতাংশ এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। লকডাউন উঠে যাওয়ায় জনগণের খুশি হওয়ার অর্থ এই নয় যে তারা মনে করে লকডাউনের প্রয়োজন নেই। জরিপে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের দুই-তৃতীয়াংশ প্রয়োজন অনুযায়ী শিথিল বা কঠোর লকডাউনের পক্ষে মত দিয়েছেন। মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করেন, লকডাউনের একদম প্রয়োজন নেই। লকডাউন চলাকালে আর্থিকভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন বস্তিবাসী, কিন্তু তাঁদের মধ্যেও ৫৬ শতাংশ মনে করেন, লকডাউন কঠোর হওয়া প্রয়োজন। এটা পরিষ্কার যে লকডাউন পছন্দ না করা বা না মানার মূল কারণ এই নয় যে জনগণ লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা বোঝে না।
লকডাউনের কৌশলে কী সমস্যা ছিল? জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্যের অভাবের কথা বলেছেন শতকরা ৬০ ভাগ মানুষ। প্রায় ৬৭ শতাংশ বস্তিবাসী একই কথা বলেছেন। লকডাউনের অন্যান্য সমস্যার মধ্যে উঠে এসেছে লকডাউন পরিচালনার বিভিন্ন দিক। এক–চতুর্থাংশ অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন হঠাৎ লকডাউনের ঘোষণা আসায় প্রস্তুতি নিতে না পারার কথা। লকডাউন পরিস্থিতিতে করণীয় কী, সে ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য দেওয়া হয়নি এবং বারবার লকডাউনের ঘোষণা পরিবর্তনের কথাও অনেকে বলেছেন। স্থানীয় প্রশাসনকে লকডাউন ব্যবস্থাপনার অংশ না করাকে বড় ত্রুটি হিসেবে দেখেছেন ২৯ শতাংশ বস্তিবাসী। খাপছাড়া যোগাযোগের পাশাপাশি সরকার জনগণকে লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতেও ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য নাগরিকদের। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা মনে করেন, লকডাউন যে সংক্রমণের হার কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে, তা মানুষ জানত না অথবা বিশ্বাস করত না।
মোটের ওপর এই জরিপ থেকে বোঝা যাচ্ছে, লকডাউন মানতে জনসাধারণের আপত্তি নেই। ভাইরাস সংক্রমণের ভয় থাকা সত্ত্বেও জীবিকার প্রয়োজনে তারা সেটা উপেক্ষা করেছে। যেসব কর্মকর্তা লকডাউন বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরাও এ বাস্তবতা জানতেন, তাই কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া যাঁরা লকডাউনে নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন, তাঁদের কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি।
এ জরিপে সামগ্রিক কোভিড ব্যবস্থাপনায় সরকারের সাফল্যের কথা বলেছেন শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে মানুষ সাধারণভাবে কোভিড ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে সরকারের ওপর আস্থা রাখে। এ অতিমারির সময়ে এ আস্থা সরকারের জন্য অতীব মূল্যবান। একইভাবে মানুষ সুষ্ঠু এবং সঠিক রিলিফ বিতরণের ব্যাপারে সরকারের ওপর আস্থা রাখতে চেয়েছিল। ত্রাণ সময়মতো পৌঁছেছে—জরিপে এ বিষয়ে অনেকেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও ত্রাণ পর্যাপ্ত ছিল কি না, কিংবা আসল ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছেছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল।
নীতিনির্ধারকেরা এ গবেষণার ফলাফল কীভাবে কাজে লাগাতে পারেন? আমাদের মতে নিচের বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ:
১. করোনা মহামারি ব্যবস্থাপনার সময় জনসাধারণের জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্যের ব্যাপারটি আমলে রাখতে হবে।
২. সরকারের উচিত সামাজিক নিরাপত্তা বা ত্রাণ কার্যক্রম আরও ব্যাপকভাবে পরিচালনা করা। আরও অনুদান ও খাদ্য লকডাউন চলার সময় বিতরণ করতে হবে।
৩. লকডাউনে করণীয় কী, সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে আরও স্পষ্টভাবে নির্দেশ প্রদান করতে হবে।
৪. জনসাধারণ যাতে লকডাউন সঠিকভাবে পালন করে, সে জন্য সরকারের উচিত বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান, যেমন কমিউনিটি গ্রুপ, যুব সংঘ, এনজিও এবং অন্যান্য নাগরিক সংঘের সাহায্য নেওয়া। এতে জনসচেতনতা বাড়বে এবং জনগণ লকডাউনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে।
সৈয়দা সেলিনা আজিজ ও ড. মির্জা হাসান ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে কর্মরত
অধ্যাপক নাওমি হোসেন আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অ্যাকাউন্টেবিলিটি রিসার্চ সেন্টারে কর্মরত