প্রথম আলোর পথচলা

গণিতচর্চায় একটা নতুন উৎসাহ তৈরি করেছে প্রথম আলো
গণিতচর্চায় একটা নতুন উৎসাহ তৈরি করেছে প্রথম আলো

প্রথম আলোর বয়স কুড়ি বছর হলো। কুড়ি বছরে বুড়ি না হলেও পত্রিকাটি এখন অনেক পরিণত, অনেক পরিব্যাপ্ত। এই যে কুড়ি বছরে ‘বুড়ি’ হওয়ার কথাটি বললাম। এটি অত্যন্ত অগ্রহণযোগ্য একটি পুরুষভাষা। প্রথম আলোর উদার–প্রাগ্রসর দৃষ্টিতে এটি বর্জনীয়। কিন্তু মাঝেমধ্যে এ রকম অনেক শব্দ–পদ এর প্রতিবেদনে, নানা পাতার লেখালেখিতে ঢুকে পড়ে। এর কারণ, সমাজের প্রচলিত বয়ানের বাইরে পত্রিকাটি এখনো যেতে পারেনি। তবে চেষ্টা করছে যে তাতে সন্দেহ নেই।

প্রথম আলোর কুড়ি বছরের পথচলা মসৃণ ছিল না; একে নানা সংকটের খানাখন্দ, বিপর্যয়ের ভাঙা সেতু অতিক্রম করতে হয়েছে। এর প্রধান কারণ এর সত্য প্রকাশের সাহস। আমাদের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো একে আপদ ভেবেছে। রাষ্ট্র একে দয়ালু চোখে দেখেনি। সত্য প্রকাশে সব সময় পত্রিকাটি যে অভিন্ন একটি অবস্থান বজায় রেখেছে, তা নয়—সত্য যদি বড় বিজ্ঞাপনদাতার বিরুদ্ধে যায়, তা প্রকাশে কোনো কোনো সময় এর দ্বিধা দেখেছি। কিন্তু যত দিন গেছে, ওই দ্বিধা ঝেড়ে পত্রিকাটি জেগে ওঠার চেষ্টা করছে। তবে বিশ্বের বড় বড় সব কাগজের মতো বড় বিজ্ঞাপনদাতার সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক বজায় রেখে চলাটা প্রথম আলোর পক্ষে খুব সহজ হবে না। এই বিপদটি এর আগামীর চলার পথের মাঝখানে প্রভাবশালীর তোলা দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে যেতে পারে।

প্রথম আলোর দুটি স্লোগান বেশ মনোযোগ পেয়েছে: যা কিছু ভালো তার সঙ্গে প্রথম আলো এবং বদলে যাও, বদলে দাও। প্রথমটি প্রায়োগিক এবং দ্বিতীয়টি তাত্ত্বিক। প্রথমটির প্রমাণ তার কাজে। অন্যদিকে পত্রিকাটি সংবাদের প্রচলিত সংজ্ঞা ও কাঠামো বদলাতে চেষ্টা করেছে, পাঠকের পছন্দ ও অভিরুচি বদলানোরও। আরও বড় অর্থে পাঠক যেভাবে নিজেকে দেখে, সমাজ–রাজনীতি–দেশ ও বিশ্বকে দেখে, তাতে একটা পরিবর্তন পত্রিকাটি চেয়েছে। সফল অনেকটাই হয়েছে। একই সঙ্গে পাঠককেও বদলে যেতে, সক্রিয় চিন্তার মানুষ হিসেবে নিজেকে সমাজের কাজে লাগাতে পত্রিকাটি উৎসাহ জুগিয়েছে।

সংবাদ বলতে দুঃসংবাদকে প্রাধান্য দেয় দুনিয়ার সব সংবাদমাধ্যম। প্রথম আলোর শিরোনামগুলোতেও দুঃসংবাদ থাকে, ভালোর চেয়ে মন্দ বেশি থাকে; কারণ, আমাদের রাজনৈতিক সামাজিক বাস্তবতায়, প্রতিদিনের জীবনে তা-ই তো বেশি দেখা যায়। কিন্তু পাশাপাশি কোনো কোনো সময় অনেক বেশি এবং বাড়তি মনোযোগ দিয়ে ভালোকেও প্রকাশ করে প্রথম আলো। কলসিন্দুরের ফুটবলপাগল কিশোরীদের থেকে শুরু করে অদম্য মেধাবীদের চোখে না পড়ার মতো অস্তিত্বকে বড় দাগে পত্রিকাটি তুলে ধরেছে। প্রতিদিন, কুড়ি বছর ধরে তারা এ কাজটি করে যাচ্ছে।

গণিতচর্চা, বিজ্ঞানচর্চায় একটা নতুন উৎসাহ তৈরি করেছে পত্রিকাটি। পরিবেশের প্রশ্নে এর অবস্থান পরিষ্কার। খাদ্যে ভেজাল ও রাসায়নিক দূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন লড়েছে প্রথম আলো; প্রতিবন্ধীদের ও ভিন্নভাবে সক্ষম শিশুদের পক্ষে এর কণ্ঠটি সরব। যারা নদী নষ্ট করে, দখল করে, যারা বন খেয়ে ফেলে—তাদের কোনো ছাড় পত্রিকাটি দেয় না।

পশ্চিমের অনেক দেশে মুদ্রিত সংবাদপত্র হারিয়ে যাচ্ছে দৃশ্য সাংবাদিকতা বা ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমের প্রাবল্যে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতো কাগজ প্রথা ভেঙে প্রথম পৃষ্ঠায় বিজ্ঞাপন ছাপাচ্ছে টিকে থাকার জন্য। আমাদের দেশেও সেটি হতে যাচ্ছে। কিন্তু প্রথম আলোর অগ্রসরবর্তী চিন্তায় এই উদ্বেগ অনেক আগেই ধরা পড়েছে। ফলে পত্রিকাটি অনেকটাই দৃশ্যবহুল বা ‘ভিজ্যুয়াল’ হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, গত কুড়ি বছরে পত্রিকাটি সময়ের সঙ্গে সুন্দর একটা তাল বজায় রেখে চলেছে। তারুণ্যের উৎসাহ, দাবি, আশা ও হতাশার জায়গাগুলো সঠিকভাবে শনাক্ত করেছে। দৃশ্যমাধ্যমের
আকর্ষণকে ছাপানো পাতায় নিয়ে আসতে সফল হয়েছে। পত্রিকাটি হাতে নিলে একটা আকর্ষণ টের পাওয়া যায়। যেন পত্রিকাটি বলছে, আমাকে দেখো এবং পড়ো।

প্রথম আলোর জন্মলগ্ন থেকে আমি এর একজন কলাম লেখক। কলাম লেখকেরা সাধারণত ব্যস্তসমস্ত হন, তাঁদের অ্যান্টেনার নিচে অনেক কিছুই ধরা পড়ে। প্রথম আলোর কিছু সক্রিয় কলাম লেখক আছেন, যাঁরা নিয়মিতভাবে নানা বিষয়ে লেখেন। চমৎকার সেসব লেখা, ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণে সজীব। আমি অলস প্রকৃতির মানুষ, আমার শর্ত ছিল লিখব অনিয়মিতভাবে, কিন্তু যা লিখব তা-ই ছেপে দিতে হবে। আমি পত্রিকাটির কাছে কৃতজ্ঞ, এই শর্ত মেনে আমাকে কলাম লেখকদের দলভুক্ত করেছে। নানা প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকারেরও কঠোর সমালোচনা আমি কোনো কোনো কলামে করেছি, কিন্তু প্রথম আলো সব ছেপেছে একটি শব্দও অদলবদল না করে। লেখকের স্বাধীনতায় যে পত্রিকা বিশ্বাস করে, তা পাঠকের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করে। আমার একটা বিশ্বাস, প্রথম আলোর বাংলাদেশের শীর্ষ দৈনিক হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এর উপসম্পাদকীয় পাতার, এর নিয়মিত কলামগুলোর বড় অবদান। সেসব কলাম আমি পড়ি এবং আনন্দিত হই। শক্তি নিয়ে মতপ্রকাশের সাহস দেখানো এবং প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে কলামগুলো কতটা একনিষ্ঠ।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে একটি উদ্বেগের বিষয় নিয়ে কিছু বলি। সম্প্রতি সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে এক কঠিন আইন জাতীয় সংসদে পাস করেছে। এটি এখন ডেমোক্লিসের তরবারির মতো সব সাংবাদিক, কলাম লেখক, এমনকি চিঠিপত্র লেখকের মাথার ওপর ঝুলবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিক নিষিদ্ধ হবে (দেশে দুর্নীতি আকাশচুম্বী হবে, আইনের শাসন ভেঙে পড়বে), সত্য প্রকাশের পথে হিমালয় দাঁড়িয়ে যাবে, ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছি সরকার এবং রাষ্ট্র সমার্থক হয়ে গেছে, সরকারের সমালোচনা রাষ্ট্রবিরোধিতার মতো অপরাধ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই অন্তবিহীন পথে হাঁটতে থাকলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব আমরা? মিথ্যা সংবাদ, বিকৃত এবং অপসংবাদ—এখন তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য কিন্তু সীমারেখাটা মানুষই টানুক, রাষ্ট্র নয়।

প্রথম আলোর সীমাবদ্ধতা অনেক। কারণ, চলার উৎপ্রেক্ষাটা একটু বদলে দিলে, একে পাড়ি দিতে হয় প্রতিকূল স্রোত। সবকিছু বলার মতো অবস্থানে এটি নেই। এর পাতা সাজানো নিয়েও আছে অভিযোগ। আমার নিজের একটা অভিযোগ, এর সাহিত্য পাতার আয়তন নিয়ে।

প্রথম আলো কেন শিক্ষার্থীদের ইংরেজি–সমাজবিদ্যার ক্লাস নেবে, এ প্রশ্নটি আমার। কিন্তু সবকিছুর পর দিনের শুরুতে প্রথম আলোকে আমি চাই। আমি দেখেছি, যাঁরা এর নিন্দা করেন, এর প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেদের দেখেন, তাঁরাও পত্রিকাটি পড়েন।

এইখানে এর শক্তিটি নিহিত। প্রথম আলো পেরেছে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলতে।

কুড়ি অতিক্রম করে তিরিশে-চল্লিশে-পঞ্চাশে পৌঁছাক প্রথম আলো। দেশের কথা বলুক, মানুষের কথা বলুক, মানুষ ও দেশের পক্ষে ভয়ডরহীন দাঁড়াক এবং সময়ের সঙ্গে, সময়কে ধারণ করে এগিয়ে যাক—এই আশাবাদটি জেগে থাকুক এর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর উৎসব-আয়োজন ছাপিয়ে।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ