প্রতিবাদের সাহস ও নির্মল তারুণ্য
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ম্যান অ্যান্ড ম্যাসকুলিন স্টাডিজ বিভাগে ‘ব্রেভম্যান ক্যাম্পেইন’ নামে মানবাধিকারবিষয়ক এক কর্মশালায় বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলাম। ছাত্রছাত্রীরা সবাই বাঙালি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস-এর ছাত্রছাত্রীরাও ছিল। পরিচয় পর্বে নিজের নামের শেষে ‘দ্রং’ উচ্চারণ করে ওদের গারো জাতির কথা বললাম। এর সংস্কৃতি, সৌন্দর্য, শক্তি ও বৈচিত্র্যের কথা বললাম। ওরা মুগ্ধ হয়ে শুনল।
মাতৃসূত্রীয় সমাজে নারীর স্বাধীনতার কথা বললাম। গারো মেয়েদের মনে কত আনন্দ, তার একটি উদাহরণ দিলাম। গত বছর শীতে আমার কজন অধ্যাপক বন্ধু গিয়েছিলেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে। তাঁরা নেদারল্যান্ডসে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। সন্ধ্যা-রাতে উঠানে খাওয়া–দাওয়ার আয়োজন ছিল। আনন্দময় সন্ধ্যা। সেখানে গ্রামের দুই নারী ছিলেন, কেউ গান গাইছিলেন। আমার বন্ধুরা প্রশ্ন করলেন, এই নারীদের বাড়ি কোথায়? আমি বললাম, পাশের গ্রামে। ওঁদের হেঁটে যেতে ২০–২৫ মিনিট লাগবে। বন্ধুরা বললেন, ওঁদের পরিবার, স্বামী কোথায়? আমি বললাম, তাঁরা হয়তো ঘরে আছেন, কোনো সমস্যা নেই। এখান থেকে খাওয়াদাওয়া, আনন্দ শেষে এই নারীরা ফিরবেন বাড়ি। নারীদের জন্য এইটুকু স্বাধীনতার আনন্দ গারো পরিবার ও সমাজ মেনে নেয়।
আমি পাওয়ার পয়েন্টে ছাত্রছাত্রীদের আমার গ্রামের ছবি দেখালাম। আষাঢ়–শ্রাবণের সবুজ ধানখেতের পরে বিশাল গারো পাহাড়। ওপারে ভারতের মেঘালয় রাজ্য। সেখানকার গারো, খাসিয়া ও জৈন্তাদের কথা বললাম। আরও বললাম, মেঘালয়ে পার্লামেন্ট বা লোকসভার আসন দুটি। সাংবিধানিকভাবে একটি গারোদের জন্য, অন্যটি খাসিয়াদের জন্য সংরক্ষিত। মেঘালয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি বা রাহুল গান্ধী বা অন্য কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারই যোগ্য নন। রাজ্যের বিধানসভার ৬০টি আসনেও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ও স্বশাসনের ব্যবস্থা।
ছাত্রছাত্রীদের ভিডিও ফুটেজে খাসিয়াদের গ্রাম, পাথারিয়া পাহাড়ের ছবি দেখিয়েছি। মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের পাশে মাধবপুঞ্জির মানুষের কথা বলেছি। প্রশ্ন করেছিলাম পাথারিয়া পাহাড়ের কথা ওরা জানে কি না। ভূমি ও অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে খাসিয়া ও গারোরা যে ইকোপার্ক গড়ার বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, তা ছাত্রছাত্রীরা জানে কি না। খাসিয়ারা বলেছিল এই বন, এই ভূমি, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, ছোট ছোট জলাধার ও জলপ্রপাত ওরাই রক্ষা করে। এসব নিয়েই ওদের জীবন। এখানে ইকোপার্কের দরকার নেই। অনেক সংগ্রামের শেষে সরকার বাধ্য হয়েছিল প্রকল্প বন্ধ করতে। ছাত্রছাত্রীরা এসব কথা জানে না, আজ থেকে ১৮ বছর আগে ২০০০ সালে ওরা শিশু ছিল।
আমি ওদের কিছু তথ্য দিয়ে বলেছি, জাতিসংঘে ‘ইনডিজিনাস পিপলস’ বলে পরিচিত মানুষের জন্য একটি ঘোষণাপত্র আছে। সেখানে আত্মপরিচয়ের অধিকার, আত্মনিয়ন্ত্রণ, ভূমি ও অরণ্যের অধিকার ইত্যাদি আছে। আইএলও কনভেনশন আছে। জাতিসংঘ সংখ্যালঘু ঘোষণাপত্র আছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের অধীনে নিউইয়র্কে একটি স্থায়ী ফোরাম আছে। জেনেভায় একটি এক্সপার্ট মেকানিজম আছে। আমাদের দেশের সরকারের কেউ কেউ আমাদের এসব ভালো কাজকে নেতিবাচকভাবে সংকীর্ণ দৃষ্টিতে দেখেন। আমরা অবাক হই। আমরা তো আমাদের প্রিয় জন্মভূমিকে আরও কল্যাণকর, আরও গণতান্ত্রিক, উদার অসাম্প্রদায়িক, সর্বজনীন, সর্বাঙ্গ সুন্দর করে গড়তে চাই। এ জন্য সবাই অবদান রাখতে চাই। কখনো কখনো রাষ্ট্র নিজেই প্রান্তিক মানুষদের দূরে সরিয়ে রাখে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের মূল ভাবনা ‘কেউ যেন পিছিয়ে না থাকে’। পৃথিবীর অনেক মানুষ পেছনে রয়ে গেছে ব্যবস্থার কারণে। আমার কথার ফাঁকে জেমস ক্যামেরনের অ্যাভাটার চলচ্চিত্রের ফুটেজ দেখালাম। স্কাই পিপলদের জেনারেল নায়ক জ্যাক সুলিকে পাঠিয়েছিল, যাতে ওমাতিকায়া জাতিকে তাদের জায়গা থেকে উচ্ছেদ করতে পারে। নায়ক জ্যাক উচ্ছেদ করা তো দূরের কথা, ওমাতিকায়াদের জীবনধারা দেখে মুগ্ধ হয়েছিল, প্রেমে পড়েছিল যুবতী নিওতিরির। তারপর শুরু হলো কঠিন অসম এক যুদ্ধ। মেশিনগান আর তির–ধনুকের যুদ্ধ। পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে ওমাতিকায়া জনগণ ও জ্যাক সুলি দেখে প্রকৃতি-পুরুষ আইওয়া কীভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। পরাজিত হয় স্কাই পিপল। কিন্তু নায়ক জ্যাক সুলি ভয়ানক রকম আহত হয়। নিওতিরি জ্যাক সুলিকে বাঁচায়। নিওতিরির চোখে জল। জ্যাক বলে, ‘আই সি ইউ (আমি তোমাকে দেখছি)’। নিওতিরি বলে, ‘আই সি ইউ’। শেষে এলিয়েনরা আত্মসমর্পণ করে এবং ফিরে যায়। তবে সব এলিয়েন ফিরে যায় না। জ্যাক সুলিরা থেকে যায় ওমাতিকায়া মানুষের পাশে।
ফ্রান্স ফুটবলে ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার পর বারাক ওবামা যে বলেছিলেন, ফ্রান্স বিশ্বকাপ জিতেছে, কারণ ওদের খেলোয়াড়দের মধ্যে বৈচিত্র্য ছিল। খেলোয়াড়দের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছিলেন আরব অথবা আফ্রিকান বংশোদ্ভূত।
শেষে ছাত্রছাত্রীদের আরও একটি গল্প শুনিয়েছি। আমার ছেলে অংশুর এক বন্ধু আমাদের গ্রামে বেড়াতে আসতে চায়। কিন্তু তার মা রাজি হচ্ছিলেন না। ঢাকার বাইরে এত দূরে একা বন্ধুর সঙ্গে একমাত্র ছেলেকে ছেড়ে দিতে মা–বাবার টেনশন হওয়ারই কথা। কিন্তু ছেলেটি কথা শুনতে চায় না, বারণ মানছে না। তার মায়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল, ছেলেটি বেড়াতে এসেছিল আমাদের গ্রামে। কয়েক দিন ছিল। পরে ছেলেটি আরও দুবার আমাদের গ্রামে এসে অনেক দিন থেকে গেছে। ঢাকায় ফিরে আমাকে অসম্ভব সুন্দর মেসেজ পাঠিয়েছিল মোবাইল ফোনে। লিখেছিল, আমাদের গ্রামে এসে জীবন সম্পর্কে তার ভাবনা বদলে গেছে। ছেলেটি আমাদের গ্রামের মানুষদের প্রশংসা করেছিল। এই ছেলেটি এখনো মাঝেমধ্যে ফোন করে। এই ছেলেরা আর ওদের বন্ধুরা যখন বড় হবে, সমাজ ও দেশের কাজে অবদান রাখবে, তখন মানুষে–মানুষে, জাতিতে–জাতিতে, দলে–দলে সংকীর্ণতা, চিন্তার মলিনতা, কলুষিত রাজনীতি, লোভ–লালসা, হিংসা–বিদ্বেষ, অপমান, অভিমান হয়তো আর থাকবে না। আমাদের দেশে এখন এমন নির্মল তরুণ প্রজন্ম দরকার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই কর্মশালা থেকে ফেরার সময় তরুণ বন্ধুদের বলেছিলাম, ‘আপনারা ব্রেভম্যান ক্যাম্পেইন করছেন, সেই তো ব্রেভম্যান, যার রয়েছে প্রতিবাদ করার সাহস।
সঞ্জীব দ্রং কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী