প্রকৃতির দিকে তাকাই না। যেন ফেলনা, আপনাআপনিই এসেছে। যেন এর থেকে শিক্ষণীয় তেমন কিছুই নেই। নিজের অজান্তেই আবার পাঠ নিই বৃক্ষ থেকে।
শহুরে যারা, কমই তাকাই চারদিকে সবুজ বৃক্ষরাজির সম্ভারের দিকে, পৃথিবীকে যা করে শ্যামল সুন্দর, ভারসাম্যের দাঁড়িপাল্লা নিয়ে। গ্রহটির ভূমিভাগের এক ভাগ অরণ্যের অংশ, যা মানবকে দিচ্ছে জীবনের সিংহভাগ রসদ, জীবনোপকরণ সুপেয় পানি। বৃক্ষ না হলে পানি সুপেয় হবে না, বৃক্ষ না হলে বায়ু হবে না পরিশুদ্ধ। আমাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। বৃক্ষ কী করে? প্রতিটি বৃক্ষ কার্বন ডাই-অক্সাইড ও তাকে সূর্যরশ্মির ও অক্সিজেনের সঙ্গে মিশিয়ে করে মনুষ্য উপযোগী। যত লতাগুল্ম তার সঙ্গে আছে লাখÿ লাখ কীটপতঙ্গ। লাখ লাখ কোটি কোটি গাছের পাতা যখন ঝরে যায়, সেই ঝরা পাতা দিয়ে তৈরি হয় এমন প্রাকৃতিক পরিবেশ, যা বাঁচিয়ে রাখে শত শত প্রাণী, পাখি ও স্তন্যপায়ীদের। তাই তাকাতে হয় প্রতিটি সৃষ্টির দিকে, প্রকৃতি যা সাজিয়ে রেখেছে। সবাই মূল্যবান। কাউকে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। সবাইকে নিয়ে আমরা বাঁচি।
বৃক্ষ থেকে কি শেখার আছে? অনেক।
১. নমনীয় হবে। গাছেরা যখন বেড়ে ওঠে, একটু বাতাসেই তারা কেমন হেলে-দুলে ওঠে, পড়ে যায় না, শুধু দুলে ওঠে। দুলে উঠবে, পড়ে যাবে না। নমনীয় হবে। যখন শক্ত হয়ে গাছেদের মতো বেড়ে উঠবে, তখন আর দুলতে হবে না। জীবন যখন বেড়ে উঠছে, একটু সমালোচনাতেই মুষড়ে পড়বে না। প্রতিকূল ভারী বাতাসের আঘাত এলেও সামলে নেবে।
২. পাতার দিকে তাকিয়ে থাকি। পাতা নিয়ে আছে কবিতা। বৃেক্ষ লাখ লাখ পাতা। প্রতিটি পাতা মূল্যবান। পাতা না থাকলে গাছ বাড়বে না। পত্রপল্লবহীন বৃক্ষ যেন মৃত। কেউ এসে মুখে বলে ‘ধন্যবাদ’ অথবা ‘ধন্যবাদ কার্ড’ পাঠায়, কেউ খানিকটা উৎসাহ দেয়, সেটাকে বিরাট পাওয়া মনে করবে। তোমার যাত্রাপথে একেকটি পাতার মতো ওরা কাজ করবে। ছোট ছোট জিনিসকে মূল্য দেবে।
৩. অশ্বত্থ বৃেক্ষর দিকে তাকিয়ে থাকি। ওরা ছোট ছিল, ধীরে বড় হয়েছে। গান আছে বটবৃক্ষ নিয়ে: ‘বটবৃেক্ষর ছায়া যেমন রে, মোর বন্ধুর মায়া তেমন রে’ [ভাওয়াইয়া]। শিক্ষণীয়, কোনো ছোট আরম্ভই ছোট নয়। ছোটরা বড় হবে একদিন অশ্বত্থের মতো।
৪. গাছের বীজ বা ফল, আমের আঁটি বা যা-ই হোক বদলে যায়। বদলে যাওয়া নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, যেমনটি ডেভিড জিন্ডেল বলেছেন, The Broken God গ্রন্থে, ‘গাছের বীজ কখনো ভয় পায় না বৃেক্ষ রূপান্তরিত হওয়ার লক্ষ্যে বদলে যেতে।’
৫. বনে যাদের বাস তারা জানে, গাছ একা বাড়ে না, সবাইকে নিয়ে বাড়ে। গান গায় নানা সুরে; হাসে, কাঁদে। যারা শুনতে জানে, শুধু তারাই শুনতে পায়। একসঙ্গে বেড়ে ওঠা, এটা শিক্ষণীয়।
৬. গাছদের মধ্যে নেতৃত্বের বিকাশ চোখে পড়ে না। যাঁরা গবেষণা করেছেন, তাঁরা জানেন এক বৃক্ষ আরেক বড় বৃক্ষকে উঠতে সাহায্য করে। মানবও তা-ই করতে পারে।
৭. বৃক্ষদের আছে শিকড় ও উৎসপ্রীতি, না হলে স্ফূর্তি হবে না। মানুষেরও তা-ই থাকতে হবে, নাহলে জীবনের উত্থান হবে না। জয়সি কিলমার নামে একজন কবি লিখেছেন সুন্দর একটি কবিতা। বাংলা এ রকম:
‘ভেবে দেখলাম/ যত কবিতা পড়া হয়েছে এ জীবনে/ সবচেয়ে সুন্দর জীবন্ত কবিতা/ সামনের ওই বৃক্ষটি/ আমার দিকে তাকিয়ে আছে যে।’
বৃক্ষ থেকে কী শিখব তার তালিকা নিজেরাই করা যায়।
১. তোমার শিকড় থাকতেই হবে।
২. যে সময় এসেছে, ডালপালার বিস্তার অবশ্যম্ভাবী।
৩. বেদনায় জীর্ণ হয়ে তোমার পুরোনো আবাস পরিত্যাগ কোরো না।
৪. তুমি যা বিশ্বাস করো, তা থেকে সরে পোড়ো না।
৫. অনেক সময় পুরোনো বাকলের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে।
৬. যেখানে পোঁতা হয়েছে, সেখানেই বেড়ে ওঠো।
৭. দেরিতে ফুল ফুটলে কোনো ক্ষতি নেই। যখন ফোটার তখনই ফুটবে।
৮. যারা তোমাকে কেটে ফেলতে চায়, তাদের পরিত্যাগ করো।
৯. শরৎকালে তোমার আসল রং লুকাতে পারবে না। ওটাই তোমার আসল রং।
১০. দাবানলে একসঙ্গে মরবে। কেয়ামতের সঙ্গে তুলনীয়।
১১. বসন্তে সবার রঙে রং মেশাতে হয়। প্রকৃতিতে যখন ভালোবাসার দিন, তখন আলাদা থেকো না।
১২. একা থেকো না, ঝড়ে পড়ে যাবে। সবার সঙ্গে থাকো, ঝড় কিছু করতে পারবে না।
১৩. সবার জন্য ভালোবাসা। নিজে তা-ই হতে চেষ্টা করবে।
১৪. সবুজ রংটি আদরের, ওকে ভালোবেসো।
১৫. ওদের ঝগড়াঝাঁটি নেই, নেই মারামারি।
১৬. ‘চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা প্রার্থনায়, সব নিয়ম মেনে চলছে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়।’ প্রকৃতির নিয়ম মানলে ভালো।
বৃেক্ষ প্রবাহিত যে সংগীতসুধা, তা বিধৃত জালালউদ্দিন রুমির মসনবিতে। লিখেছেন উইলিয়াম শেক্সপিয়ারও। বারান্তরে।
কৃষক ও তাঁর সন্তানদের গল্প দিয়ে শেষ করি।
কৃষকের মৃত্যুর সময় ছেলেদের ডাক দিয়ে বললেন, সারা জীবন কৃষিকাজ করে তোমাদের মানুষ করেছি। একটি কথা মন দিয়ে শোনো। আঙুরেখতের কোনো এক জায়গায় লুকোনো বিপুল ধন-সম্পদ। এই বলে কৃষক শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। গুপ্তধনের সন্ধানে ছেলেরা সমস্ত খেত চষে ফেলল। গুপ্তধন পাওয়া গেল না। খেত চষে ফেলায় এমন ফসল এল, যা কল্পনাতেও আসে না।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।