২০২০ অলিম্পিকের আয়োজন শেষ হয়ে যাওয়ার পর ২৪ আগস্ট টোকিওতে শুরু হয়েছে প্রতিবন্ধীদের আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্যারালিম্পিক গেমস। অলিম্পিকের মূল আয়োজনের মতোই চোখে পড়ার মতো চমক ছিল প্যারালিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সবচেয়ে চমকপ্রদ অংশ যে স্টেজ শো, সেখানেও প্রতিবন্ধী তারকাদের অভূতপূর্ব পারদর্শিতা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে, সমাজে যাঁদের পিছিয়ে পড়া অংশ হিসেবে দেখা হয়, তাঁদের জন্য সম-অংশীদারমূলক ব্যবস্থা চালু করা গেলে, স্বাভাবিক জীবন যাঁরা যাপন করছেন, তাঁদের সমপর্যায়ের উন্নত পারদর্শিতা দেখাতে তাঁরা কতটা সক্ষম। প্যারালিম্পিক আয়োজনের পেছনে কিন্তু এই ধারণাই কাজ করছে। ফলে এই ক্রীড়ানুষ্ঠানের আয়োজনকে প্রতিবন্ধীদের মানবাধিকার নিশ্চিত করার পথে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে দেখা হয়।
প্যারালিম্পিকের ইতিহাস আধুনিক অলিম্পিকের মতো শতবর্ষ পার হয়ে যাওয়া ইতিহাস নয়। তবে এই ইতিহাসের পেছনে যে মানবিক মূল্যবোধ জড়িত, সেটাই হচ্ছে প্যারালিম্পিকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি দিক। প্যারালিম্পিকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিকে, ২৩টি দেশের ৪০০-এর মতো প্রতিযোগীকে নিয়ে যখন বসেছিল এর প্রথম আয়োজন। তবে এই ধারণার সূচনা এরও এক দশকের বেশি আগে, ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকের সময়।
লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংগতি রেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাবেক সৈনিকদের মধ্যে যাঁরা প্রতিবন্ধী হয়ে জীবিত ছিলেন, তাঁদের জন্য একটি হুইলচেয়ার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ব্রিটেনের স্টক ম্যান্ডেভিলে সে বছরের জুলাইয়ে। এই প্রতিযোগিতার উদ্যোক্তা ছিলেন লুডভিগ গুটমান নামের একজন জার্মান চিকিৎসক, জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যিনি পালিয়ে ব্রিটেনে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
জার্মানিতে থাকা অবস্থায় প্রতিবন্ধীদের প্রতি নাৎসি জার্মানির বর্বর আচরণ প্রত্যক্ষ করার সুযোগ গুটমানের হয়েছিল এবং তিনি দেখেছিলেন, জার্মানিকে ত্রুটিমুক্ত আদর্শ এক জাতি হিসেবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার অপচেষ্টায় নাৎসি বাহিনী কীভাবে প্রতিবন্ধীদের মেরে ফেলার ঘৃণ্য অপচেষ্টায় নিয়োজিত ছিল। তখন থেকেই এদের প্রতি অসম্ভব মমতা তাঁর মনে জেগে ওঠে এবং ব্রিটেনে চলে যাওয়ার পর যুদ্ধাহত সৈনিকদের একটি হাসপাতালে কাজ করা অবস্থায় প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলা আয়োজনের ধারণা তাঁর মাথায় এসেছিল। সেই থেকে এই প্যারালিম্পিকের সূচনা এবং ইউরোপের শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন আরও কিছু মানুষ গুটমানের সঙ্গে যোগ দিলে রোম অলিম্পিকে তাঁরা তাঁদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন করেছিলেন।
সেই সঙ্গে তাঁরা স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলেন সমাজের সেই সব অসহায় অংশকে, প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে যাদের খেলাধুলা করা তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষের জীবন যাপন করাও অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।
লুডভিগ গুটমানের দেখানো স্বপ্নের হাত ধরে প্যারালিম্পিক এখন হয়ে উঠেছে অলিম্পিকের পাশাপাশি প্রতিবন্ধীদের জন্য আয়োজিত নিয়মিত এক বিশ্ব পর্যায়ের প্রতিযোগিতা এবং ক্রমে অনেক বেশি দেশ এতে অংশ নিতে শুরু করেছে। সমাজের এই অবহেলিত অংশের প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজ কতটা দায়বদ্ধতা অনুভব করছে, তা বিচার করে দেখার গ্রহণযোগ্য এক মাপকাঠি এখন হয়ে উঠেছে এই প্যারালিম্পিক। ফলে এতে অংশগ্রহণ আমাদের সেই অঙ্গীকার বিশ্বের সামনে তুলে ধরার জুতসই এক মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত।
এবারের ২০২০ টোকিও প্যারালিম্পিকে বিশ্বের ১৬১টি দেশ ও ভূখণ্ডের রেকর্ডসংখ্যক ৪ হাজার ৪০৩ জন প্রতিবন্ধী ক্রীড়াবিদ অংশ নিচ্ছেন, টোকিও ও পার্শ্ববর্তী তিনটি জেলার বিভিন্ন ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হওয়া ২২টি খেলার ৫৩৯টি ইভেন্টে যাঁরা অংশ নিচ্ছেন। টোকিও অলিম্পিকে ক্রীড়াবিদের সংখ্যা ছিল ১১ হাজারের বেশি। সেই তুলনায় প্যারালিম্পিক ছোট মাপের প্রতিযোগিতা হলেও গুরুত্বের দিক থেকে এটাকে খাটো করে দেখার উপায় নেই। প্রতিবন্ধীরা কেউ নিজেদের ইচ্ছায় প্রতিবন্ধী হননি। তাঁদের শারীরিক কিংবা মানসিক অপূর্ণতার পেছনে নানা কারণ রয়েছে, যার কিছু সমাজের অবহেলার সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে তাঁদের জন্য স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান সমাজেরই দায়িত্ব। তবে সব সমাজ যে সেই দায়িত্ব পালনে আন্তরিক, তা অবশ্য নয়।
আমাদের মনোভাব এমন যেন প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিয়ে পরিবারকে এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন প্রতিবন্ধী সেই সন্তান। হিটলারের জার্মানির মতো তাঁদের নিধন করার মধ্য দিয়ে সমাজকে সে রকম কলুষ থেকে মুক্ত করার সুযোগ না থাকলেও হলফ করে বলা যায়, মনে মনে অনেকেই হয়তো সেই কামনা আজও করে থাকেন।
আমাদের সমাজের কথাই ধরুন। প্রতিবন্ধীদের আমরা স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গ্রহণ করতে পেরেছি কি? মনে তো হয় না। বরং সমাজের বোঝা হিসেবে আজও আমরা তাঁদের দেখে থাকি। ফলে দরিদ্র পরিবারের প্রতিবন্ধীদের সামনে পথের ভিখারি হয়ে অন্ন সংস্থানের কাজে নিয়োজিত হওয়ার বাইরে অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না। অন্য দিকে অবস্থাপন্ন ঘরে প্রতিবন্ধী সন্তান থাকলে সেই সন্তানকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জীবন কাটাতে হয় অন্ধকার কোনো ঘরে গৃহপরিচারকের দেখভাল করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।
আমাদের মনোভাব এমন যেন প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিয়ে পরিবারকে এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন প্রতিবন্ধী সেই সন্তান। হিটলারের জার্মানির মতো তাঁদের নিধন করার মধ্য দিয়ে সমাজকে সে রকম কলুষ থেকে মুক্ত করার সুযোগ না থাকলেও হলফ করে বলা যায়, মনে মনে অনেকেই হয়তো সেই কামনা আজও করে থাকেন।
বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিশ্চিত করায় বিভিন্ন দেশ অনেক পথ অগ্রসর হলেও আমরা যেন এখনো সেই তিমিরেই পড়ে আছি। আমার এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হতে পেরেছে ২০২০ টোকিও প্যারালিম্পিকে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ওপর আলোকপাত করার মধ্য দিয়ে।
বিশ্বের যে ১৬১ দেশ ও ভূখণ্ড এবারের প্যারালিম্পিকে অংশ নিচ্ছে, সেই তালিকায় নেই বাংলাদেশের নাম। কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর মনে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দেওয়া দরকার। আমাদের অনুপস্থিতি এ কারণে আরও দৃষ্টিকটু যে দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশের মধ্যে একমাত্র আমরাই এতে অনুপস্থিত আছি। আফগানিস্তানকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করা হলে হিসাব দাঁড়াবে আটে এক। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছু আছে কি?
আমি অবশ্য এর জন্য দেশের সরকার কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একা দায়ী করছি না। আমাদের সমাজ কি পেরেছে প্রতিবন্ধীদের আপনার আর আমার মতোই স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে মেনে নিতে? মনে তো হয় না। এই তো মাত্র সেদিন কোনো এক টেলিভিশনের অখাদ্য এক নাটকে জোর গলায় বলা হয় যে পিতামাতার পাপের ফল হচ্ছে প্রতিবন্ধী সন্তান।
একই সঙ্গে অন্য যে আরেক দিক আমাকে পীড়া দিচ্ছে, তা হলো প্যারালিম্পিক নিয়ে আমাদের সংবাদমাধ্যমের পিনপতন নীরবতা। যে পত্রিকার আমি নিয়মিত লেখক, ছাপা সংস্করণে প্যারালিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের একটি ছবি ছাপার মধ্য দিয়ে তারা করণীয় দায়িত্ব শেষ করেছে। এসব চিত্র বোধ হয় প্রতিবন্ধীদের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে আমরা কতটা উদাসীন, তা প্রমাণ করে দেয়।
এবারের প্যারালিম্পিক শুরু হয়েছে বলিষ্ঠ এক বার্তা প্রদানের মধ্য দিয়ে। বার্তাটি হচ্ছে—‘আমরা ১৫’, যার মধ্য দিয়ে বোঝানো হয়েছে যে বিশ্বজুড়ে ১৫ শতাংশ মানুষ আজ প্রতিবন্ধী। অঙ্কের হিসাবে সংখ্যা হবে ১০০ কোটির বেশি। ফলে আপনার নিজের ঘরে না হলেও আপনার আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে কেউ যে সে রকম দুর্ভাগ্যের শিকার নন, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। ফলে প্রতিবন্ধী সমস্যা হচ্ছে আপনার-আমার সবার সমস্যা এবং এ কারণেই ঘরের মানুষের জন্য আরও একটু মানবিক হতে পারা আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। এ কারণেই ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে বাংলাদেশের অনুপস্থিতি আমাদের বিস্ময়ই কেবল জাগিয়ে তোলে না, একই সঙ্গে এটা আমাদের করে বেদনাহত, এই ভেবে যে এতটা অমানবিক আমরা কীভাবে হলাম!
মনজুরুল হক জাপান প্রবাসী শিক্ষক ও সাংবাদিক