পোশাকশিল্পে মজুরি বাড়ল কই?
তৈরি পোশাক খাতের মজুরি বৃদ্ধির খসড়া সুপারিশের গেজেট বের হয়েছে গত ৮ অক্টোবর। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত এটি। এ খাতে মজুরি বৃদ্ধির উদ্যোগমাত্রই ইতিবাচক বড় ঘটনা। মালিকেরা বলেছেন, তাঁরা ‘সাধ্যের অতিরিক্ত’ দিয়েছেন। তাঁদের এরূপ মনোভাবের পরও মজুরি বোর্ডে শ্রমিক সংগঠনগুলো কেন সর্বশেষ মজুরি প্রস্তাবের বিষয়ে বিপুল সংখ্যায় আপত্তিপত্র দিল, সেটা জানা-বোঝা জরুরি হয়ে পড়েছে। ৮ অক্টোবর-পরবর্তী দুই সপ্তাহ ধরে মজুরি বোর্ডে শ্রমিক সংগঠনগুলো এসব আপত্তিপত্র জমা দিয়েছে বলে জানা যায়।
পোশাক খাতসহ বিভিন্ন শিল্প খাতে লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন-জীবিকার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কাজের সফলতাও অনেকাংশে এসব খাতের মজুরি ঘোষণার ওপর নানাভাবে নির্ভর করে। সে কারণে এরূপ মজুরি ঘোষণামাত্রই অনুসন্ধানী মনোযোগ দাবি করে।
মজুরি বৃদ্ধির গ্রেডভিত্তিক চিত্র
তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকদের সাতটি ভাগ আছে (গ্রেড এক থেকে গ্রেড সাত)। এ ছাড়া আছে ‘শিক্ষানবিশ’ নামে আরেকটি বর্গ। যাঁদের মজুরি সপ্তম গ্রেডের নিচে।
নতুন মজুরিকাঠামোতে সপ্তম গ্রেডের শ্রমিকদের ‘মোট মজুরি’ ধরা হয়েছে ৮ হাজার টাকা; যাতে ‘মূল মজুরি’ হলো ৪ হাজার ১০০ টাকা। বাকিটা অন্যান্য ভাতা। ২০১৩ সালের পূর্ববর্তী মজুরিকাঠামোতে সপ্তম গ্রেডের শ্রমিকদের মূল মজুরি ছিল ৩ হাজার টাকা।
সরকারি মজুরি ঘোষণা মতে, মূল মজুরি প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে বাড়ে। সে অনুযায়ী সপ্তম গ্রেডের শ্রমিকদের ২০১৩ সালের মূল মজুরি ২০১৮ সালে হয়েছে ৩ হাজার ৮২৯ টাকা। আর এখন নতুন মজুরিকাঠামোতে সপ্তম গ্রেডের জন্য মজুরি ঘোষিত হলো ৪ হাজার ১০০ টাকা; অর্থাৎ এই গ্রেডের মজুরি বাড়ল কার্যত ২৭১ টাকা মাত্র। মূল্যস্ফীতির হিসাব বিবেচনা করলে প্রকৃত মজুরি কার্যত বেড়েছে বলা যায় না; বরং মজুরি নির্ধারণের পুরো পদ্ধতি নিয়ে তখন গভীর প্রশ্ন ওঠে।
পোশাক খাতের নতুন মজুরির আরেকটি গ্রেডের হিসাব দেখতে পারি আমরা। যেমন সর্বোচ্চ (প্রথম) গ্রেডের শ্রমিকদের ২০১৩ সালের মজুরিকাঠামোতে মূল মজুরি ছিল ৮ হাজার ৫০০ টাকা। এই গ্রেডের শ্রমিকদের ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধির পর ২০১৮ সালে মূল মজুরি পাওয়ার কথা ১০ হাজার ৩৩১ টাকা ৮০ পয়সা। পাঁচ বছর পর এখন তাঁদের মূল মজুরি ঘোষণা হলো ১০ হাজার ৪৩৬ টাকা; অর্থাৎ নতুন মজুরি ঘোষণায় তাঁদের মূল মজুরি বেড়েছে ১০৪ টাকা মাত্র।
অনেক গ্রেডেই এভাবে ১০০-২০০ টাকা করে মূল মজুরি বেড়েছে। তবে দ্বিতীয় গ্রেডের দৃশ্যপট অন্য রকম। এই গ্রেডে ২০১৩ সালে মূল মজুরি ছিল ৭ হাজার টাকা। পাঁচ বছরে ৫ শতাংশ হারে বেড়ে সেটা দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯৩৪ টাকা; অর্থাৎ ওই গ্রেডের শ্রমিকেরা এখন ৮ হাজার ৯৩৪ টাকা পাচ্ছেন ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু ৮ অক্টোবরের গেজেটে দ্বিতীয় গ্রেড শ্রমিকদের মূল মজুরি প্রস্তাব করা হয় ৮ হাজার ৫১৪ টাকা। বিস্ময়কর প্রস্তাব।
বেসিকের হিস্যা নিয়ে প্রশ্ন
শ্রমিকেরা এবারের মজুরিকাঠামোতে মূল মজুরির হিস্যা কমে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন ২০১৩ সালের কাঠামোতে প্রথম গ্রেডে মোট মজুরি ছিল ১৩ হাজার টাকা আর মূল মজুরি ছিল ৮ হাজার ৫০০ টাকা; অর্থাৎ মোট বেতনে মূল মজুরির হিস্যা ছিল প্রায় ৬৫ শতাংশ। এবার একই গ্রেডে মূল মজুরির হিস্যা ৬০ শতাংশ; অর্থাৎ ৫ শতাংশ কম।
দ্বিতীয় গ্রেডে মূল মজুরির হিস্যা এবার প্রায় ৫৮ শতাংশ। পূর্ববর্তী মজুরিকাঠামোতে দ্বিতীয় গ্রেডে মূল মজুরির হিস্যা ছিল ৬৪ শতাংশের বেশি। এভাবে অধিকাংশ গ্রেডে বেসিকের হিস্যা কমে গেছে এবার।
সপ্তম গ্রেডে মূল মজুরির হিস্যা হয়েছে এবার মোট মজুরির ৫১ শতাংশ। পূর্ববর্তী (২০১৩) মজুরিকাঠামোতে সেটা ছিল ৫৭ শতাংশ। ২০১৩ সালের আগে প্রতিটি মজুরি ঘোষণায় সর্বনিম্ন মোট মজুরিতে বেসিকের হিস্যা থাকত ৬০ থেকে ৬৭ শতাংশের মধ্যে। শ্রমিকেরা এবারের নতুন প্রবণতায় হতাশ।
পোশাক খাতে এ বছর যখন মজুরি নির্ধারিত হচ্ছে, সেই একই সময়ে বেকারি (১৫ জুলাই), দরজি (১০ মার্চ), অ্যালুমিনিয়াম (২৪ সেপ্টেম্বর) খাতের শ্রমিকদেরও মজুরি নির্ধারিত হলো। এসব খাতের মজুরিকাঠামোর সঙ্গে পোশাক খাতের মজুরি প্রস্তাবের বেসিকের তুলনা করলে শ্রমিকদের হতাশার যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। বেকারিতে সর্বনিম্ন গ্রেডে মূল মজুরি মোট মজুরির ৫৬ শতাংশ, দরজি খাতে সেটা ৬২ শতাংশ এবং অ্যালুমিনিয়াম শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ৫৮ শতাংশ।
যেকোনো মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণায় ‘বেসিক’ বা মূল মজুরি কত বাড়ছে, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একে ভিত্তি করেই উৎসব ভাতা, ওভারটাইম ইত্যাদি হিসাব করা হয়। ওভারটাইম সচরাচর মূল বেতন হারের দ্বিগুণ হয়ে থাকে। নিয়ম হলো, শ্রমিক মাসজুড়ে ঘণ্টায় (২৬ দিন/২০৮ ঘণ্টা ধরে) যে পরিমাণ মূল বেতন পান, ওভারটাইম পাবেন ঘণ্টায় তার দ্বিগুণ। সুতরাং মূল মজুরি সামান্য বৃদ্ধি মানেই আগামী দিনে পোশাক খাতের শ্রমিকদের ওভারটাইমও সামান্যই বাড়বে। একইভাবে মূল মজুরি কমে গেলে তাঁর ওভারটাইমপ্রাপ্তিও কমে যাবে।
‘বেসিক’-এর হিস্যা কমার পাশাপাশি ৫ বছর ব্যবধানে মজুরি বৃদ্ধির হারও কমেছে এবার। পোশাকশ্রমিকদের পূর্ববর্তী মজুরিকাঠামোতে সর্বনিম্ন মোট মজুরি ছিল ৫ হাজার ৩০০ টাকা। এবার সেটা হয়েছে ৮ হাজার টাকা; অর্থাৎ ৫ শতাংশ হারে বার্ষিক বৃদ্ধির বিষয়টি বাদ দিয়ে হিসাব করলে গতবারের সর্বনিম্ন মোট মজুরি থেকে এবারের সর্বনিম্ন মোট মজুরি ৫১ শতাংশ বেড়েছে বলা যায়। অথচ ২০১৩ সালের ঘোষণাকালে সর্বনিম্ন স্তরে মোট মজুরি বেড়েছিল পূর্ববর্তী মজুরিকাঠামোর চেয়ে ৭৭ শতাংশ বেশি; অর্থাৎ এবার ২৬ শতাংশ কম হারে মজুরি বেড়েছে।
অন্যান্য খাতের সঙ্গে পোশাক খাতের মজুরি-তুলনা
বিগত কয়েক বছর মজুরি বোর্ড বেশ সক্রিয়তার সঙ্গে অনেক খাতের মজুরি নির্ধারণ করল। এটা ভালো প্রবণতা। তবে সমসাময়িক অন্যান্য মজুরি ঘোষণার সঙ্গে পোশাক খাতের মজুরিকাঠামোর তুলনা করলে অনেক ক্ষেত্রেই এই খাতের মজুরির নিম্ন হার চোখে পড়ে।
এ বছর চামড়া খাতে নতুন যে মজুরিকাঠামো ঘোষিত হয় (ফেব্রুয়ারিতে), তাতে সর্বনিম্ন গ্রেডের শ্রমিকদের মোট মজুরি ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। শিপব্রেকিং খাতে (ফেব্রুয়ারিতে) সর্বনিম্ন মজুরি হলো ১৬ হাজার টাকা। অ্যালুমিনিয়াম ও এনামেল শ্রমিকদের (সেপ্টেম্বরে) সর্বনিম্ন মজুরি হলো ৮ হাজার ৭০০ টাকা।
সমসাময়িককালে ঘোষিত বিভিন্ন খাতের মজুরিকাঠামোতে সর্বোচ্চ-সর্বনিম্ন গ্রেডের যে ব্যবধান তার তুলনায়ও দেখা যায় পোশাক খাতে ওই ব্যবধান বেশি। পোশাক খাতে প্রথম গ্রেড এবং সর্বশেষ গ্রেডের মধ্যে মোট মজুরিতে ব্যবধান দ্বিগুণের বেশি। কিন্তু ট্যানারি, জাহাজভাঙা, অ্যালুমিনিয়াম, বেকারি ইত্যাদি প্রতি খাতে তা দ্বিগুণের অনেক কম।
উল্লিখিত খাতগুলোর মধ্যে ট্যানারি ও জাহাজভাঙা শিল্পে ‘শিক্ষানবিশ’ শ্রমিকদের মজুরি যথাক্রমে ৭ হাজার ও ৮ হাজার টাকা। পোশাকশিল্পে তা ৫ হাজার ৯৭৫; অর্থাৎ প্রথমোক্ত খাতগুলোতে শিক্ষানবিশসহ সর্বনিম্ন স্তরের শ্রমিকদের মজুরি পোশাক খাতের নিচের স্তরের শ্রমিকদের মজুরির চেয়ে বেশি। অথচ বাংলাদেশে পোশাক খাতেই প্রবৃদ্ধি ঘটছে বেশি এবং পোশাক খাতকে দেওয়া রাষ্ট্রীয় প্রণোদনাও উল্লেখ করার মতো। তবে পোশাক খাতকে দেওয়া প্রণোদনার কোনো হিস্যা শ্রমিকদের পকেটে আসছে কি না, নতুন মজুরিকাঠামোর বিশ্লেষণে সে বিষয়ে গভীর প্রশ্ন থেকে যায়।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক