টিসিবির পণ্য বিক্রির ট্রাক চলে যাচ্ছে। গাড়ির পেছনে মানুষ দৌড়াচ্ছেন। বেশ কয়েকজন আবার ওই ট্রাকের পেছনে ঝুলেও আছেন নাছোড়বান্দার মতো। এক বোতল তেলের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ চলছে টিসিবির আরেকটি ট্রাক ঘিরে। বিক্রয়কর্মী কার হাতে তুলে দেবেন সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। একবার এর হাতে দেবেন তো আরেকবার ওর হাতে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। স্বল্প মূল্যে পণ্য বিক্রির টিসিবির ট্রাক ঘিরে শহুরে গরিবদের এমন দৌড়াদৌড়ি বা হুড়োহুড়ির দৃশ্যে গত কয়েক দিনের সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সয়লাব। টিসিবির ট্রাকের পেছনে ক্রেতাদের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সকালে বিক্রি শুরু করলেও ১২টার মধ্যেই সব পণ্য বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। এরপরও ক্রেতাদের লাইন শেষ হয় না।
কিন্তু মধ্যম আয়ের শ্রেণিতে উন্নীত হওয়া মাথাপিছু আড়াই হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া দেশে এ ধরনের দৃশ্য অস্বস্তিকর। খরা, বন্যা বা কোনো ধরনের দুর্যোগ পরিস্থিতি ব্যতিরেকে স্বাভাবিক অবস্থায় এমন দৃশ্য বিরল ঘটনা। বরং এ ধরনের ঘটনা জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করে। মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে। ক্রেতার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং গাড়ির পেছন পেছন দৌড়ে যাওয়া ভালো কোনো লক্ষণ নয়। সময় ভেদে ক্রেতার সারি দীর্ঘ হতে পারে। কিন্তু পণ্য না পাওয়া অবধি ঝুলে থাকা বা গাড়ি আসা মাত্রই হুমড়ি খেয়ে গাড়ির দিকে যাওয়া, দ্রুত পণ্য শেষ হয়ে যাওয়া অর্থনীতির দুরবস্থার ইঙ্গিত দেয়।
এ থেকে বোঝা যায়, আয় ও উন্নয়নের নানা গল্প শোনানো হলেও সাধারণ নাগরিকেরা ভালো নেই। উন্নয়ন সূচকগুলোর উর্ধ্বগামিতা পরিসংখ্যানগতভাবে প্রদর্শন করে ফাঁপা উন্নয়নের গল্প প্রচার করা হলেও সাধারণ মানুষ এর ভাগীদার হতে পারছে অল্পই।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সমাজের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি হাঁসফাঁস করছে। ‘গরিব সংকটে, মধ্যবিত্ত দুর্দশায়’, ‘সংসার চালানোই দায়’, ‘৫০ হাজার টাকায়ও সংসার চলে না’, ‘সংসার চালাতে দিশেহারা মানুষ,’—এগুলো গত কয়েক সপ্তাহে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রধান শিরোনাম। বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে পরিবহনভাড়া, খাদ্যপণ্য সবকিছুরই দাম বেড়েছে গত এক দশকে অস্বাভাবিকভাবে। দাম এতটাই বেড়েছে যে অবস্থাসম্পন্ন মানুষও এখন সরকারি গাড়ির সামনে লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছেন। খোদ বাণিজ্যমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, ভালো পোশাক পরা মানুষদেরও এখন টিসিবির গাড়ির সামনে লাইনে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে।
পণ্যের ঊর্ধ্বগতির রেখা মোটামুটি ভয়াবহ। কিন্তু এ বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ছিটাফোঁটা ধরনের বক্তব্য-বিবৃতির মধ্যে থেকেই সমালোচনা করছে। দেশের নামজাদা জাঁদরেল সব বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ও থিঙ্কট্যাংকগুলো রহস্যময় কারণে অনেকটা মুখে তালা মেরে আছে। মূল্যস্ফীতির অবস্থা নিয়ে তাঁদের কোনো বক্তব্য নেই। পরিসংখ্যান ব্যুরো জানাচ্ছে, কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সম্ভবত জাতীয় মজুরি সূচক ও মূল্যস্ফীতি একই বিন্দুতে এসে মিল গেছে। স্বাভাবিক সময়ে এই দুই সূচকের মধ্যে ১ শতাংশ পার্থক্য থাকে।
কিছু কিছু পণ্য বা সেবার দাম গত এক দশকের তুলনায় ২৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ২০১০ সালে বিদ্যুতের মূল্য ছিল ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৭৬ পয়সা। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭ টাকা ১৩ পয়সা। এই সময়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯০ শতাংশ। গ্যাসের দাম বেড়েছে আরও বেশি ১৪৪ শতাংশ। ২০০৯ সালে দুই চুলার দাম ছিল ৪০০ টাকা। ২০২১ সালে হয়েছে ৯৭৫ টাকা। এলপি গ্যাসের দাম ২০২০ সালে ছিল ৮৯১ টাকা। এখন ১ হাজার ১৭৮ টাকা। ২০০৮ সালে পানির দাম ছিল প্রতি ইউনিট ৫ টাকা ৭৫ পয়সা। ২০২১ সালে হয়েছে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। ২০০৮ সালের তুলনায় দাম বেড়েছে ২৬৪ শতাংশ।
এ ছাড়া চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ অন্যান্য আহার্য পণ্যের দাম বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। গত দুই বছরে মোটা ও সরু চালের দাম বেড়েছে গড়ে ১৩ টাকা করে। আটা ও ময়দার দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২২-২৩ টাকার আটা ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ৩৩ টাকার ময়দা ৫৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয় খুচরা বাজারে। সয়াবিন তেলের দাম লিটারে বেড়েছে ৫৫ টাকা করে। মসুর ডালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৫২ টাকা। চিনির দাম বেড়েছে ১৯ টাকা এক কেজিতে। মুরগির মাংস ৬০ টাকা, গরুর মাংস ১০০ টাকা করে বেড়েছে কেজিপ্রতি।
বাজারের এই অবস্থা সামাল দিতে দ্রুত ফাঁকা হচ্ছে সাধারণ মানুষের পকেট। আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু সূচক ও দৃশ্যমান উন্নতির বয়ান বলছে ভিন্ন কথা। দেশে নতুন নতুন অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। উড়ালসেতু, মেট্রোরেল, সেতু, সরকারি-বেসরকারি অট্টালিকার হিসাব ও সংখ্যা বাড়ছে। দেশে মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৫৫৭ ডলার। প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় বেড়েছে। কিন্তু জনজীবনে বিশেষ করে, বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব নেই কেন? অর্থনীতির উন্নতি হলে জনজীবনে স্বস্তি নেমে আসার কথা।
এখানেই পরিসংখ্যানের কারসাজি বা গরমিলটা রয়েছে। দেশের উন্নতি হচ্ছে, আয় বাড়ছে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সরকারের ব্যয়ও বেড়েছে। বিশেষ করে, সরকারের অপখরচ বেড়েছে। সম্ভবত অপখরচের কারণে বাজেটের ঘাটতিও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। আর বাজেটের আকার হচ্ছে ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। অপখরচ মেটাতে গিয়ে ঘাটতি মোকাবিলায় সরকারকে শুল্ক, মূসক ও ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি হ্রাসের সব থেকে সহজ ও তাৎক্ষণিক উপায় হচ্ছে আমদানি শুল্ক ও মূসক হ্রাস করা। এর সঙ্গে অন্যান্য নীতি পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়। কিন্তু সরকার যদি আমদানি শুল্ক ও মূসক হ্রাস করে, তবে অপখরচ করতে পারবে না। কিন্তু গোষ্ঠীকে তুষ্ট রাখতে এসব অপখরচের পথ অবলম্বন করেছে।
দুটি অপখরচের কথা উল্লেখ করতে পারি। একটি হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি। গত এক দশকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেছনে সরকারের ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে। এ ছাড়া অলস বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে ভর্তুকি দিচ্ছে। ১০ বছরে সরকার ৬০ হাজার কোটি টাকা বেসরকারি অনুৎপাদনশীল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দিয়েছে। গত অর্থবছরে ১১ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। এটা কৃষি খাতে সরাসরি ভর্তুকির প্রায় সমান।
চলতি অর্থবছরে কৃষিতে তেল-সার বাবদ ভর্তুকির পরিমাণ ৯ হাজার কোটি। আর কৃষি যন্ত্রাংশ খাতে তিন হাজার কোটি টাকা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে অধিকাংশ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক সরকারি দলের লোকজন বা সরকার ঘনিষ্ঠরা। ভর্তুকির টাকায় তাঁদের পকেট ফুলেফেঁপে উঠছে। এখানে কেবল দুটি অপখরচের উদাহরণ দেওয়া হলো। অনুসন্ধান করলে এ রকম অনেক অপখরচের খাত বেরিয়ে আসবে। অপখরচ মেটাতে সরকার নানাভাবে আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। যেমন জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। জ্বালানির দাম বাড়লে প্রতিটি পণ্যের মূল্য অবধারিতভাবেই বৃদ্ধি পাবে। মূল্যবৃদ্ধির বোঝা সরাসরি সাধারণ নাগরিকের কাঁধে চেপে বসে।
সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা প্রায়ই একটি কথা বলে থাকেন। আমাদের দেশকে নাকি এখন আর চেনা যায় না। হুট করে কোথাও থেকে এসে নামলে মনে হবে এ কোথায় উপস্থিত হলাম। এটা কি এখন কানাডা, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া? রাজনীতিবিদদের ব্যাপারই আলাদা। ওনারা অসুখ বিসুখ হলেই ওই সব দেশে চিকিৎসার জন্য চলে যান। ওখানে তাঁদের ঘরবাড়ি আছে বলে শোনা যায়।
এসব মাননীয়দের সন্তানসন্ততিরা নাকি বিদেশেই থাকেন। কানাডাতে তো ‘বেগম পাড়া’ ই সৃষ্ট হয়েছে। তাই রাজনীতিবিদেরা দেশে থাকলেও চোখে কেবল উন্নত দেশের ছবিই ভাসে। চোখ বন্ধ করলেই লাস ভেগাস নিদেনপক্ষে সিঙ্গাপুরের সুখস্মৃতি ভেসে উঠে। তাই চোখ খোলে আর নিজেদের দেশকে চিনতে পারছেন না তাঁরা। বিভ্রমের কারণে উত্তরার বোট ক্লাবে বসে মনে হয় মিসিসিপির পাড়ে বসে আছি।
তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে আমরাও কিন্তু দেশকে চিনতে পারছি না। টিসিবির ট্রাকের পেছনে পণ্যের জন্য এমনভাবে দৌড়ে হাহাকার করতে দেখিনি কখনোই। এমনকি ৮৮ বা ৯৮-এর বন্যারও সময় ত্রাণের জন্য এমন করে কাউকে দৌড়াতে দেখিনি।
গণমাধ্যমের পাতা উল্টাতেই গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজনের আহাজারির ছবি দেখি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুম হওয়া পিতার সন্তানের অশ্রুসজল মুখাবয়বের ছবি ভেসে বেড়ায়। খুন, ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিত্যদিনের সংবাদ।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা আপাতত বন্ধ আছে কিন্তু এরপরও স্বস্তি নেই। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি। বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাই, মাননীয়গণ আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। উন্নয়নের গল্প শুনছি বটে কিন্তু পেট ও পিঠ কোনোটারই তো রক্ষা হচ্ছে না। এই দেশ তো আমরা আসলেই চিনতে পারছি না।
ড. মারুফ মল্লিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক