ভোটকর্মী বলতে ব্যাপকার্থে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) থেকে শুরু করে ভোটকক্ষের সর্বনিম্ন কর্মকর্তা পোলিং কর্মকর্তাকেও বোঝায়। তবে এ লেখাটি মূলত ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিষয়েই সীমাবদ্ধ রাখছি। একটি ভোটকেন্দ্রের প্রধান থাকেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা। আর সে কেন্দ্রে যে কটি ভোটকক্ষ থাকে তার প্রতিটিতে একজন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও দুজন পোলিং কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। জানা যাচ্ছে, আসন্ন নির্বাচনে ৪০ হাজার ২০০ কেন্দ্র থাকবে। সে ক্ষেত্রে ভোটকক্ষের সংখ্যা হবে ২ লাখের কিছু কমবেশি। অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৬ লাখ ভোটকর্মী সরাসরি ভোট গ্রহণের কাজে কেন্দ্রে নিযুক্ত থাকবেন। তাঁদের নিয়োগ করার কর্তৃত্ব রিটার্নিং কর্মকর্তার। রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা নিয়োগ পেয়েছেন তফসিল ঘোষণার পর। এর পরপরই তাঁদের কেন্দ্রভিত্তিক ভোটকর্মী নিয়োগ দেওয়ার গুরুদায়িত্ব পালন করার কথা। কোথাও কোথাও আগেভাগে কিছু খসড়া করে রাখা হয়। চূড়ান্ত নিয়োগদানের পর তাঁদের দিনব্যাপী একটি প্রশিক্ষণও হয়। এসব কর্মকর্তার নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা রিটার্নিং কর্মকর্তারা আইনের বিধান অনুসারেই সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাকে দিতে পারেন। আর দিতেও হয়। বস্তুত, তাঁরাই রিটার্নিং কর্মকর্তার পক্ষে এ নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ পর্ব সামাল দেন। এবারের জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণারও বেশ আগে থেকে এই ভোটকর্মী নিয়োগ–প্রক্রিয়ায় পুলিশি যাচাই–বাছাইয়ের খবর আসতে থাকে। এখনো আসছে। নির্বাচন কমিশন খোলাসা করে কিছু বলছে না। কিন্তু জানা যায়, পুলিশ এসব ভোটকর্মী ও তাঁর স্বজনদের অতীত রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে বৃত্তান্ত সংগ্রহ করছে। কমিশন বা রিটার্নিং কর্মকর্তারা এ কাজের দায়িত্ব তাঁদের দিয়েছেন, এমনও জানা যায়। কিন্তু তদন্ত থেমে নেই।
নির্বাচনব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ পুলিশ। নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের দিন ও নির্বাচন–পরবর্তী সময়ে শান্তিশৃঙ্খলার বিধান মূলত তাদেরই কাজ। নির্বাচনের আগের দিন ভোটকেন্দ্রে মালামাল পৌঁছাতেও নিরাপত্তা বিধান করে পুলিশ। ভোট গ্রহণকালে কেন্দ্রের নিরাপত্তার প্রাথমিক দায়িত্ব তাদেরই। আর ভোট গ্রহণ ও গণনা শেষ হলে পুলিশি প্রহরায় প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা রিটার্নিং বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে ফলাফল বিবরণী ও ভোটে ব্যবহৃত মালামাল পৌঁছে দেন। সার্বিকভাবে বলা চলে, নির্বাচনব্যবস্থাটির সঙ্গে অন্তত আমাদের উপমহাদেশে পুলিশ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তবে ভোটকর্মী নিয়োগজনিত কাজের সঙ্গে তারা আগে কখনো সংশ্লিষ্ট ছিল না। তবে কোনো ভোটকর্মী পক্ষপাতসুলভ আচরণ করতে পারেন–জাতীয় কোনো তথ্য তারা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে দিতে পারে। এ ধরনের খবরাদি যেকোনো উৎস থেকে আসুক, রিটার্নিং কর্মকর্তা বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা তা দ্রুত বিবেচনায় নিয়ে রদবদল করেন। তবে এবার মনে হচ্ছে, গোটা তালিকাটি পুলিশ যাচাই–বাছাই করে দিচ্ছে। বিষয়টি আর যা–ই হোক, সংগত বলা যাবে না। জানা যায়, সরকারি দলের বিরুদ্ধে যেসব ভোটকর্মী বা তাঁদের নিকটজন অতীতে ভোট দিয়েছেন, তাঁদেরও প্রতিকূল বলে তাঁরা বিবেচনায় নিচ্ছে। যেকোনো রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মী ভোটকর্মী হিসেবে নিয়োগের জন্য অযোগ্য—এত দিন এটাই অনুসরণ করা হতো। আর এত লোকের মধ্যে কে কাকে ভোট দেন বা দিয়েছিলেন, তা কখনো দেখা হতো না। এতে ব্যাঘাত ঘটেনি সুষ্ঠু নির্বাচনের। এখানে আলোচনার প্রয়োজন যে এসব পদে সাধারণত নিয়োগ পান জেলা বা উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষকেরা। এ ভোট গ্রহণের কাজটি এতই ঝামেলা ও পরিশ্রমের যে অনেকেই তা থেকে অব্যাহতি পেতে সচেষ্ট থাকেন। সম্মানী ভাতাও অতি নগণ্য। এসব ক্ষেত্রে কেন্দ্র দখলের মতো কোনো ঘটনা না ঘটলে এই ভোটকর্মীদের কারও পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার কথা নয়। তারপর পুলিশ তো থাকছেই। থাকছে পুলিশসহ অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার মোবাইল টিম, স্ট্রাইকিং ফোর্স ও ম্যাজিস্ট্রেট। তা যা–ই হোক, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ এ জাতীয় যাচাই–বাছাই কাজের নামে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে। কয়েক মাস আগে তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) রাজনৈতিক অতীত সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেছিল। ওই সব কর্মকর্তা বিসিএস পরীক্ষায় পিএসসির সুপারিশ পাওয়ার পর পুলিশি তদন্তের পরই চাকরি পেয়েছেন। মাঝখানে এ ধরনের যাচাই–বাছাই অভিপ্রেত হতে পারে না। বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে কার্যক্রমটি পরিত্যক্ত হয়। পুলিশ সদস্যরা প্রায় সবাই দেশপ্রেমিক। ঠিক অন্যরাও একই কাতারের দেশপ্রেমিক, এটা পুলিশকে বুঝতে হবে।
তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে কোনো ভোটকর্মীর নিকটাত্মীয় সরকারবিরোধী অন্য একটি দল করেন। হতে পারে তিনিও সে দলকে অতীতে ভোট দিয়েছেন। তাহলে কি ওই ব্যক্তি ভোটকর্মী হওয়ার অনুপযুক্ত হবেন। সবাই তো কাউকে না কাউকে ভোট দেন। ভোট দেন স্বয়ং সিইসি। আর এখনকার সিইসির আপন ভাগনে সরকারি দল থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন। ভোটকর্মীরা যদি এ জাতীয় সম্পর্ক থাকার জন্য দায়িত্ব পালনে অনুপযুক্ত বিবেচিত হন, তাহলে সর্বোচ্চ পর্যায়ের জন্য কী হবে? এ বিষয়ে পুলিশ তাঁদের আওতায় থাকাই সংগত ছিল। এ ধরনের যাচাই–বাছাই করে যাঁরা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক, তাঁদের নিশ্চয়ই বাদ দেওয়া হচ্ছে না। তাহলে ভোটকর্মীর তালিকাটি প্রশ্নবিদ্ধ বললে অসংগত হবে না।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের পর এ দেশে কোনো অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন হয়নি। আসন্ন নির্বাচনটি তা হতে যাচ্ছে দেখে আমরা স্বস্তি বোধ করছি। আর এটা এত দূর এগিয়েছে সরকারপ্রধান ও বিরোধী দলের কয়েকজন নেতার দূরদর্শিতা ও উদারতার জন্য। তবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। যাঁর ভোট তিনি দেবেন। আর এর সুষ্ঠু গণনার ব্যবস্থাও করতে হবে। তবে এগুলো নিশ্চিত করার দায়িত্ব ভোট গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যদি এর বিপরীতটি ঘটে, তবে তার মাশুল দেবে গোটা জাতি। সবাই বলে থাকেন সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ভূমিকা মুখ্য।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও তা–ই বলে। তবে নির্বাচন কমিশনের সামগ্রিক তদারকি ও দিকনির্দেশনা অতিগুরুত্বপূর্ণ। আসন্ন নির্বাচনটি জাতীয় জীবনে বড় ধরনের প্রভাব রাখবে। এমনিতেই নির্বাচনের জন্য পক্ষগুলোকে সমতল ক্ষেত্র দেওয়া যায়নি। সরকার বহাল আছে। এ বিষয়ে কিছু বললে সংবিধান ও আদালতের আদেশের দোহাই দেওয়া হয়। বহাল আছে সংসদ। এটা ভেঙে দিতে সংবিধান অন্তরায় নয়। সদিচ্ছা থাকলেই তা করা যায়। এটা বহাল রাখায় অঘোষিত ক্ষমতাবলয়গুলো সক্রিয় রয়েছে। তাদের কারও কারও ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটতে পারে ভোটকর্মীদের তালিকা চূড়ান্ত করায়। আচরণবিধির প্রকাশ্য লঙ্ঘন ডাল–ভাত হয়ে গেছে। গায়ে মাখছে না রিটার্নিং কর্মকর্তা কিংবা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা। তাঁরা কতই–বা করবেন। সরকারের অতি উচ্চ অবস্থানে থাকা ব্যক্তির নেতৃত্বে প্রকাশ্য রাজপথে আচরণবিধি ভঙ্গ করে মিছিল হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কমিশন গণমাধ্যম থেকে সবই দেখছে ও জানছে। তারা এ জাতীয় দু–একটি ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নিলে এমনটা ঘটত না। এ রকম নীরবতায় সামনের দিনে তা ব্যাপক হবে।
বেদনার বিষয়, কমিশনকে সবাই হালকাভাবে নিচ্ছে। এভাবে একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন তারা কীভাবে গুছিয়ে আনবে, তা বোধগম্য হচ্ছে না। কয়েক দিন আগে আসন্ন নির্বাচনে যেসব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের ব্রিফিং হয়েছে। সেখানে সিইসি একটি মূল্যবান কথা বলেছেন। তিনি প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের কাজে অকারণ হস্তক্ষেপ না করতে তাঁদের নির্দেশনা দিয়েছেন। যাঁর কাজ তাঁরই সাজে। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভোট গ্রহণের কাজে অযাচিত বাধার সম্মুখীন হলে অবশ্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের নিয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করবেন। নচেৎ তাঁরা টহলেই থাকবেন। ভোটকর্মী নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ এবং এ–সংক্রান্ত বিধিতে পুলিশের কোনো ভূমিকা নেই। সে কারণে নির্বাচনে পুলিশের যে কাজ, তাতেই তাদের তৎপরতা সীমিত রাখতে সিইসির আগেই নির্দেশনা দেওয়া উচিত ছিল।
আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব