২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

পুরো আমদানিনির্ভর হওয়ার ঝুঁকিতে জ্বালানি খাত

বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উৎপাদনের হার ক্রমাগতভাবে কমে যাওয়া এবং দেশে গ্যাসের চাহিদা বাড়ার কারণে যে গ্যাস–সংকট দেখা দেয়, তা মেটানোর জন্য এলএনজিরূপে গ্যাস আমদানি শুরু করা হয়। বাংলাদেশ আগে থেকেই পুরোপুরিভাবে তেল আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল। সম্প্রতি বৃহদাকারে কয়লা আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে গ্যাস আমদানি বৃদ্ধি পেলে সমগ্র জ্বালানি খাত আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ার শঙ্কা দেশে নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলবে, তা-ই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মতো গ্যাস সম্ভাবনাময় দেশে জ্বালানি জোগানের জন্য গ্যাস আমদানির ওপর নির্ভরশীল হওয়াকে পর্যবেক্ষক মহল মোটেই যুক্তিপূর্ণ মনে করছে না। কিন্তু বাস্তব অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাংলাদেশ সে পথেই হেঁটে চলেছে। এখন প্রশ্ন হলো, এ পথ থেকে সরে আসার উপায় কী?

দেশের নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনের নিম্নমুখী ধারা আগামী বছরগুলোতে অব্যাহত থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৮ সালের শেষ দিকে দেশে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলএনজি আমদানি শুরু করা হয়। এলএনজি একটি উচ্চমূল্যের জ্বালানি পণ্য এবং এটি ব্যবহারের জন্য অতি ব্যয়বহুল অবকাঠামোর প্রয়োজন হয়। সাম্প্রতিক এলএনজি বিতর্কের প্রধান বিষয় হলো, বিশ্ববাজারে এর আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি এবং এর মূল্যের অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির মূল্য শিগগির সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে বা সাময়িকভাবে নামলেও তা স্থির থাকবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

ভবিষ্যতে কোনো এক সময় এলএনজির আমদানি দেশীয় উৎস থেকে সরবরাহকৃত গ্যাসের পরিমাণের তুলনায় বেশি হতে পারে। কিন্তু উচ্চমূল্যের এলএনজির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করা হলে দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে ও তা একটি টেকসই ব্যবস্থা হবে না। প্রশ্ন হলো, এলএনজির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হওয়ার পরিকল্পনা কি যৌক্তিক?

বাংলাদেশের নিজস্ব গ্যাসক্ষেত্রগুলো তাদের উৎপাদনক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে কেন? এর প্রধান কারণ হলো, বাংলাদেশের প্রায় সব বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র যথেষ্ট পুরোনো হয়ে পড়ায় সেগুলোর উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। সাধারণভাবে একটি গ্যাসক্ষেত্রের স্বাভাবিক জীবনে প্রাথমিক অবস্থায় উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে একপর্যায়ে উৎপাদন চূড়ায় পৌঁছে এবং তার পর থেকে উৎপাদন কমে একসময় জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ‘ওয়াটার আউট’, অর্থাৎ গ্যাসের পরিবর্তে পানি উৎপাদন করে নিঃশেষিত হয়। দেশের সর্ববৃহৎ তিতাস গ্যাসক্ষেত্রটি ২০১৬ সালে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের মাধ্যমে চূড়ায় পৌঁছে এবং তার পর থেকে উৎপাদন কমে বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৩৮ কোটি ঘনফুটে পৌঁছায়। একই ধরনের বা আরও বেশি উৎপাদন কমেছে অন্যান্য পুরোনো বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্রেও, যেমন হবিগঞ্জ, কৈলাসটিলা, বাখরাবাদ ও রশিদপুরে। এসব গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাসস্তরের চাপ ও উৎপাদন কমে যাওয়া অব্যাহত রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেমন সাগরবক্ষে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র অপেক্ষাকৃত দ্রুত নিঃশেষিত হতে দেখা যায়। অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে দ্রুত গ্যাসস্তরের চাপ কমে যাওয়াকে এ জন্য অনেকে দায়ী করেন।

বাংলাদেশে বর্তমানে ২০টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এর মধ্যে শেভরন অয়েল কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত অপেক্ষাকৃত নতুন বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রটিকে মুকুটের মণি হিসেবে গণ্য করা যায়। এর কারণ হলো, এই একটিমাত্র গ্যাসক্ষেত্র দৈনিক ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করে থাকে, যা দেশের সব গ্যাসক্ষেত্রের সম্মিলিত দৈনিক উৎপাদনের প্রায় ৫১ শতাংশ। বিবিয়ানা কত দিন তার বর্তমান উৎপাদন মাত্রা বজায় রাখতে পারবে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পেট্রোবাংলার তথ্যসূত্রে জানা যায়, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রটি আগে দীর্ঘদিন তার উৎপাদনক্ষমতার অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন করেছে। গ্যাসস্তরটির সুস্থ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তা কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে, শেভরন কোম্পানির কর্মকর্তারাই সেটা ভালো বলতে পারবেন। তবে অনেকেই মনে করে থাকেন, ক্ষমতার অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন গ্যাসস্তরের সুব্যবস্থাপনার পরিপন্থী এবং তা ভবিষ্যতে গ্যাস উৎপাদন হারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সে যা-ই হোক না কেন, বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে বড় আকারে উৎপাদন হ্রাস বাংলাদেশের গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।

দেশের নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন কমে যেতে থাকায় চাহিদা মেটাতে বর্তমানে মোট সরবরাহকৃত গ্যাসের ১৮ শতাংশ আমদানি করা এলএনজির ওপর নির্ভর করা হচ্ছে। দেশীয় উৎপাদন হারের নিম্নমুখী ধারা চলতে থাকলে এলএনজির ওপর নির্ভরতা বাড়বে বলা যেতে পারে। ভবিষ্যতে কোনো এক সময় এলএনজির আমদানি দেশীয় উৎস থেকে সরবরাহকৃত গ্যাসের পরিমাণের তুলনায় বেশি হতে পারে। কিন্তু উচ্চমূল্যের এলএনজির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করা হলে দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে ও তা একটি টেকসই ব্যবস্থা হবে না। প্রশ্ন হলো, এলএনজির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হওয়ার পরিকল্পনা কি যৌক্তিক?

বাংলাদেশকে অনতিবিলম্বে গ্যাস অনুসন্ধানে দেশব্যাপী জোরালো কার্যক্রম শুরু করে নিজস্ব গ্যাস তুলে আনতে হবে। এলএনজি আমদানি সাময়িকভাবে বর্তমান গ্যাস সরবরাহের সমস্যাকে ঠেকাতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এলএনজি মূল্যের অনিশ্চিত গতিবিধি দেশের অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে যাবে।

এলএনজি একটি সহজে পরিবহনযোগ্য উচ্চমূল্যের জ্বালানি, যা শিল্পোন্নত অথচ নিজস্ব জ্বালানি নেই, এমন দেশগুলো ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। এলএনজি মূল্যের সাম্প্রতিক ঊর্ধ্বমুখী উল্লম্ফন বিশ্ববাজারে এটিকে সর্বাপেক্ষা অস্থায়ী ও অনিয়ন্ত্রিত মূল্যের জ্বালানিতে পরিণত করেছে। এ বছরের প্রথম দিকে স্পট মার্কেট থেকে প্রতি ইউনিট এলএনজি সাত ডলারে কিনলেও বছর শেষে বাংলাদেশকে সেটি ইউনিটপ্রতি ৩৫ ডলারে কিনতে হয়েছে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে এলএনজি মূল্যের পাঁচ গুণ বৃদ্ধি স্পট মার্কেট থেকে বাংলাদেশের এলএনজি আমদানি কার্যক্রমকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। এদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত কম ও স্থায়ী মূল্যে (ইউনিটপ্রতি প্রায় ১০ ডলার) দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে, এমন দুটি দেশ কাতার ও ওমান এ সময় বাংলাদেশকে এলএনজি সরবরাহে কৃচ্ছ্র প্রদর্শন করে ও ২০২২ সালে চুক্তির আওতায় সম্ভাব্য সর্বনিম্ন পরিমাণ এলএনজি সরবরাহ করার উদ্যোগ নেয় বলে সংবাদমাধ্যমে জানা গেছে। আপাতদৃষ্টে তারা দীর্ঘ মেয়াদে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে এলএনজি সরবরাহের চেয়ে বেশি মূল্যে স্পট মার্কেটে তা সরবরাহে অধিক উৎসাহী বলে মনে হয়।

এলএনজি মূল্যের এ ধরনের অনিয়ন্ত্রিত ও ঊর্ধ্বমুখী অবস্থান নিকট ও দূরবর্তী ভবিষ্যতে বজায় থাকা মানে বাংলাদেশের জ্বালানি দৃশ্যপটে অশনিসংকেত উঁকি দেওয়া। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে প্রতি ইউনিট এলএনজি ১০ ডলারে আমদানি করা মানে দেশীয় নিজস্ব উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহের তুলনায় তিন গুণ বেশি মূল্যে তা সরবরাহ করা। কিন্তু আমদানি মূল্য ইউনিটপ্রতি ৩৫ ডলার হতে পারে, এটি নীতিনির্ধারণী মহলের কেউ ভাবতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। সে যা-ই হোক না কেন, বর্তমান প্রাক্কলন অনুযায়ী দেশের নিজস্ব গ্যাস উৎস থেকে সরবরাহ কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এলএনজি আমদানির পরিমাণ বাড়বে ও ভবিষ্যতে কোনো এক সময় এলএনজি দেশীয় গ্যাসের সরবরাহের তুলনায় অধিক হয়ে পড়তে পারে। দেশের অর্থনীতি এমন আর্থিক বোঝা কত দিন সামাল দিতে পারবে, সে প্রশ্ন কেবল উদ্বেগই বাড়িয়ে তোলে। তবে এটি নিশ্চিত যে আর্থিক চাপের কারণে যদি সাময়িকভাবেও এলএনজি গ্যাসের আমদানি বন্ধ করতে হয়, তা অনেক গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ ও শিল্পকেন্দ্রকে অন্ধকারে ফেলে দেবে।

উপরিউক্ত সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার পথ একটাই এবং তা সহজতর। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধানে কোনো জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এবং এ কারণে দেশে গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের পার্থক্য কেবল বেড়েই চলেছে। অথচ ভূতাত্ত্বিক বিবেচনায় বদ্বীপ গঠিত এ দেশটির গ্যাস সম্ভাবনাকে অতি উজ্জ্বল বলে বিজ্ঞানীরা মত দিয়ে এসেছেন। এর একটি প্রমাণ মেলে ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালত কর্তৃক বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর মিয়ানমার তার সমুদ্র এলাকায় জোরালো অনুসন্ধানের মাধ্যমে বড় আকারের গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়।

পক্ষান্তরে, বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমানায় সে তুলনায় অনুসন্ধান কাজ করেনি বললেই চলে। আর সে কারণেই দেশে এই গ্যাসসংকট। বিশ্বব্যাপী গ্যাস, তেল অনুসন্ধান কার্যকলাপের বিবেচনায় বাংলাদেশ ন্যূনতম অনুসন্ধানকৃত এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশকে অনতিবিলম্বে গ্যাস অনুসন্ধানে দেশব্যাপী জোরালো কার্যক্রম শুরু করে নিজস্ব গ্যাস তুলে আনতে হবে। এলএনজি আমদানি সাময়িকভাবে বর্তমান গ্যাস সরবরাহের সমস্যাকে ঠেকাতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এলএনজি মূল্যের অনিশ্চিত গতিবিধি দেশের অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে যাবে। গ্যাস সরবরাহের সমস্যাকে একটি টেকসই সমাধান দিতে হলে নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করাই সঠিক উপায়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ভূবিজ্ঞানীদের মূল্যায়নে গ্যাসপ্রাপ্তির উজ্জ্বল সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে এসব কথা বলা পুরোপুরিভাবে যৌক্তিক।

  • বদরূল ইমাম অধ্যাপক (অব.), ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ