জেনেভায় সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে আট ঘণ্টাব্যাপী যে আলোচনা হয়েছে, তার ফল নিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেল ওয়ানে সংবাদ সম্প্রচার করা হয়নি। তবে কাজাখস্তানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ সামলানো নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি সংস্থার (কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন—সিএসটিও। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়া, আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান নিয়ে এ জোট গঠিত হয়।) নেতাদের ভার্চ্যুয়াল বৈঠকের খবর বেশ ফলাও করে সম্প্রচারিত হয়েছে।
মনে করা হচ্ছে, পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করার অজুহাত সৃষ্টি করার জন্য পশ্চিমাদের উসকানি দিতে চান। এ কারণে তিনি কাজাখস্তানে সিএসটিও সামরিক জোটের আড়াই হাজার সেনা পাঠিয়েছেন। পুতিন হয়তো ভাবছেন, এতে নিজ দেশের মানুষের কাছেও তাঁর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যাবে। রাশিয়ার গৌরবময় প্রাধান্য ফিরিয়ে আনতে তিনি এ অঞ্চলে ভীতি প্রদর্শন ও সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে চাইছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
২৫ বছর ধরে ইউক্রেন, জর্জিয়া, মলদোভা, এমনকি ন্যাটোতে যোগ দেওয়া সাবেক সোভিয়েতভুক্ত এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়ায় মার্কিন প্রভাব কমানোর জন্য রাশিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় যাতে রাশিয়া পশ্চিমাদের কাছ থেকে বেশি গুরুত্ব পায়, সে জন্য পুতিন পশ্চিমাদের দেখাতে চান, ন্যাটোর মতো তাদেরও একটি সামরিক জোট রয়েছে। এ কারণেই তিনি সিএসটিও জোটের সেনাদের কাজাখস্তানে পাঠিয়েছেন।
১৯৯৯ সালে সিএসটিও প্রতিরক্ষা চুক্তি হলেও এত দিন পর্যন্ত এর আওতায় যৌথ সেনা মোতায়েন করতে দেখা যায়নি। কিন্তু এখন এ সামরিক জোট নিজেদের একটি সদস্যদেশের (কাজাখস্তান) অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা মোকাবিলার জন্য সেনা পাঠিয়েছে।
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে চলমান বিক্ষোভ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্প্রতি কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম জোমার্ট তোকায়েভ রুশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চান। এরপরই পুতিন রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সিএসটিও জোটের এসব সেনা পাঠান।
২০১০ সালে কিরগিজস্তান রাশিয়াকে সামরিক সাহায্য দিতে বলেছিল কিন্তু সিএসটিও তখন হস্তক্ষেপ করেনি। এ ছাড়া নাগোর্নো-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজানের সঙ্গে কিছুদিন আগে আর্মেনিয়ার যে লড়াই হয়, তখন আর্মেনিয়া সিএসটিওর কাছে সামরিক সহায়তা চেয়েছিল। কিন্তু রাশিয়ার কারণে সিএসটিও তাতে সাড়া দেয়নি। কিন্তু এখন সেই জায়গা থেকে সরে এসেছে পুতিনের নেতৃত্বাধীন এ জোট।
কাজাখস্তানে সিএসটিওর ‘শান্তি রক্ষার সামরিক মিশন’ যিনি পরিচালনা করছেন, তিনি হলেন রাশিয়ান কর্নেল-জেনারেল আন্দ্রেই সেরদিউকোভ। ২০১২ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলাভিযানের নেতৃত্বে তিনি ছিলেন। সিরিয়ায় রুশ বাহিনীর অধিনায়কও ছিলেন তিনি।
কাজাখস্তানে রাশিয়ার প্রবেশ অবশ্যই পশ্চিমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হলো এর কাঁচামাল (তেল, গ্যাস ও ইউরেনিয়াম)। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) কেন্দ্রীয় অবস্থানও কাজাখস্তান। নুরসুলতান নাজারবায়েভের অধীনে (তিনি ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরে যাওয়ার আগপর্যন্ত তিন দশক কাজাখস্তান শাসন করেছিলেন) কাজাখস্তান রাশিয়া, চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আপেক্ষিক স্বাধীনতার নীতি বজায় রেখেছিল। কিন্তু এখন সে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক থেকে দেশটি বেরিয়ে এসে রাশিয়ার দিকে বেশি ঝুঁকে গেছে।
এখন কাজাখস্তানে রুশ সেনারা টহল দিচ্ছেন। দেশে কোনো ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতি যাতে না ঘটে, সে চেষ্টা তাঁরা করছেন। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কাজাখ নাগরিকদের কেউ কেউ, বিশেষ করে রুশ ভাষাভাষী কাজাখ নাগরিকেরা এটিকে স্বাগত জানাচ্ছেন। কিন্তু দেশটির বড় একটি অংশ এটিকে সার্বভৌম কাজাখস্তানে বিদেশি হানাদার বাহিনীর অভিযান হিসেবে দেখছেন। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ থেকেই রাশিয়া কাজাখস্তানে সেনা নিয়োগ করেছে। দীর্ঘদিন এ সেনারা অবস্থান করবেন—এমনটি মাথায় রেখেই তাঁদের মোতায়েন করা হয়েছে। এ কারণে অচিরেই এটি কাজাখ জনগণের ক্ষোভের কারণ হবে।
কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম জোমার্ট তোকায়েভ গদি বাঁচাতে রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন যে সেনা নিজ দেশে ডেকে এনেছেন, তা শিগগিরই বের করা সম্ভব হবে না। এটি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে ক্ষুব্ধ করেছে। অন্যদিকে, দেশের মানুষও এটিকে ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। ফলে শিগগিরই আরেকটি গণবিক্ষোভ কাজাখস্তানে দেখা যাবে বলে মনে হচ্ছে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
স্লাভমির সিয়েরাকভস্কি জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের একজন জ্যেষ্ঠ ফেলো