২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

পুতিনের অভিযান ইউক্রেনেই শেষ হবে তো?

ভ্লাদিমির পুতিন
ফাইল ছবি

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণ বোঝা দুরূহ নয়, দীর্ঘদিন ধরেই এর পটভূমি তৈরি হয়েছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভ্লাদিমির পুতিনের উত্থানের শুরু থেকেই এটা স্পষ্ট ছিল যে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের হৃতগৌরব এবং প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠা তাঁর লক্ষ্য। এ জন্য পুতিন সামরিক প্রস্তুতি নিয়েছেন, কূটনৈতিক কৌশল অবলম্বন করেছেন এবং সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছেন। এ প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি এবং রাশিয়ার প্রতি অনুগত সরকার থাকা কেবল জরুরি নয়, অত্যাবশ্যকীয়ও বটে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন তার সূচনা কি না।

ইউক্রেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা?

একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সীমানা লঙ্ঘন করে একাধিক এলাকা দিয়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার সৈন্যের প্রবেশ আন্তর্জাতিক আইনের নগ্ন বরখেলাপ—এ বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে হামলা চালানোর সময় একইভাবে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছে। সিরিয়ায় অভিযানের ব্যাপারে ন্যাটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের আচরণ এ মানদণ্ডে অগ্রহণযোগ্যই শুধু নয়, তা রীতিমতো অপরাধের পর্যায়েই পড়ে। কিন্তু তা কোনো অবস্থাতেই একই আচরণের বৈধতা দেয় না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই রাশিয়ার এ আগ্রাসনকে দেখতে হবে এবং তা যে আন্তর্জাতিক আইন ও নীতির বিরুদ্ধে, সেটা বলতে হবে। কিন্তু ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলা ইউক্রেনকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতাও। এ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বাক্ষরিত একটি সমঝোতা স্মারকে।

ইউক্রেন যখন তার হাতে থাকা সব ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংস করে নন-প্রলিফারেশন অব নিউক্লিয়ার উইপন ট্রিটি বা পারমাণবিক অস্ত্রবিস্তার নিয়ন্ত্রণ চুক্তি স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়, সে সময় একটি স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তাতে স্বাক্ষর করেছিল ইউক্রেন, রাশিয়া, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র। বুদাপেস্টে ৫ ডিসেম্বর ১৯৯৪ সই করা এ স্মারকে ইউক্রেনকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল যে তার সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করা হবে না।

ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দুটি এলাকা—দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক যেখানটা রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ২০১৪ সাল থেকে দখল করে আছে, তাদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে রাশিয়া এ যুদ্ধের যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয়, রাশিয়া এবং রাশিয়ার পক্ষ হয়ে যাঁরা কথা বলছেন, তাঁরা দাবি করছেন, ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকে ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। তঁাদের দাবি, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার যে প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা রোধ করার জন্যই এ আগ্রাসন।

প্রথমত একটি স্বাধীন দেশ কোনো জোটে যোগ দেবে, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার সেই দেশের এবং সেই দেশের জনগণের; কোনো বড় প্রতিবেশী দেশ সেটা অপছন্দ করলেই সেই দেশে সামরিক আগ্রাসনের অধিকার রাখে না।

দ্বিতীয়ত, ১৯৯৪ সালের স্মারকে কোথাও বলা হয়নি যে ইউক্রেন চাইলে ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে না। তদুপরি রাশিয়া বলছে ন্যাটো চাইছে তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে তার সার্বভৌমত্বের ওপরে আঘাত হানতে, কিন্তু রাশিয়ার এ কথা কতটা বাস্তব?

ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ কর্তৃত্ব স্থাপন এখন সময়ের ব্যাপার। তার অর্থ এই নয় যে ইউক্রেনে শান্তি আসবে। বরং পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল হবে। মানবিক বিপর্যয় ইতিমধ্যে ঘটতে শুরু করেছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এখানে একটি গৃহযুদ্ধেরই সূচনা হলো

ন্যাটোর সম্প্রসারণ কি কারণ

১৯৯০ সালের পরে ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটেছে, এ পর্যন্ত নতুন ১৫টি দেশ এ জোটে যোগ দিয়েছে। এর মধ্যে মাত্র তিনটি দেশ আছে, যেগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সীমান্ত আছে—লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া ও এস্তোনিয়া। পোল্যান্ডের সঙ্গে রাশিয়ার সরাসরি সীমান্ত নেই, কিন্তু তাদের মাঝখানে আছে কালিনিনগ্রাদ, যা রাশিয়ার ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এলাকা। কিন্তু এদের ন্যাটোতে যোগদানের পেছনে প্রতিবেশীদের প্রতি রাশিয়ার আচরণ এবং ভীতি কাজ করেছে কি না, সেটাই ভেবে দেখার অবকাশ আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে হাঙ্গেরিতে ১৯৫৬ সালে এবং চেকোস্লোভাকিয়ায় ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিযানের কথা সবারই স্মরণে আছে। ১৯৮১ সালে সম্ভাব্য সোভিয়েত অভিযানের ভয়ে পোল্যান্ডে সেনাশাসন জারি করা হয়েছিল। এগুলো বাদ দিয়েও রাশিয়ার ১৯৯১–পরবর্তী ইতিহাস খুব বেশি স্বস্তিদায়ক নয়।

ট্রান্সনিস্ট্রিয়া যুদ্ধ (১৯৯০-৯২) দিয়ে শুরু। যেখানে জাতিগতভাবে রাশিয়ান বিদ্রোহীরা রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর সমর্থন নিয়ে স্বাধীন মলদোভার ভেতরে একটি বিচ্ছিন্ন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল।

আজ যে রাশিয়া ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে, তারাই চেচেনদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছিল তা নিশ্চয় মনে আছ। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রথম চেচেন যুদ্ধে (১৯৯৪-৯৬) পরাজিত হয়েছিল, তবে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের জীবনহানি ঘটে। গ্রোজনির অবরোধ ও আক্রমণের সময় রাশিয়ান সরকার তার নিজের নাগরিকদের যা করার জন্য প্রস্তুত ছিল, তা কি রাশিয়ার ব্যাপারে প্রতিবেশীদের আশ্বস্ত করে?

ন্যাটো নিয়ে রাশিয়া কি আসলেই ভীত

ন্যাটো জোটের ব্যাপারে রাশিয়ার ভীতি ও শঙ্কা যতটা না সামরিক, তার চেয়ে বেশি হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনা। ১৯৯০-এর দশক থেকেই দেখা গেছে, দেশে যত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাই থাকুক, পশ্চিমা জোটের বিরোধিতা করা বিভিন্ন ধরনের রাজনীতিক শক্তিকে একত্র করে, নাগরিকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চিন্তাকে শক্তিশালী করে। এটি যে যখন ক্ষমতায় থেকেছে, তার জন্যই তা লাভজনক হয়েছে। বরিস ইয়েলৎসিন থেকে পুতিন—সবাই সেই হাতিয়ার ব্যবহার করেছেন। ন্যাটোর সম্প্রসারণ যে রাশিয়াকে এ সুবিধা দেবে, সেটা মার্কিন নীতিনির্ধারকেরা বিবেচনা করেছেন যে কারণে ১৯৯০-এর দশকের মার্কিন গোপন দলিলগুলোতে দেখা যায় এ ধরনের পদক্ষেপ না নেওয়ার পক্ষেই বেশি মত দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

এখন কী ঘটতে পারে

ইউক্রেনের ওপরে রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ কর্তৃত্ব স্থাপন এখন সময়ের ব্যাপার। তার অর্থ এই নয় যে ইউক্রেনে শান্তি আসবে। বরং পরিস্থিতি আরও বেশি জটিল হবে। মানবিক বিপর্যয় ইতিমধ্যে ঘটতে শুরু করেছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে এখানে একটি গৃহযুদ্ধেরই সূচনা হলো। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ পুতিন ও তঁার সহযোগীদের ওপরে, রাশিয়ার ওপরে আরও কিছু কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আরও কিছু পদক্ষেপ অত্যাসন্ন। এগুলোর ফল দীর্ঘ মেয়াদে রাশিয়ার জন্য ভয়াবহ। কিন্তু ন্যাটো এ মুহূর্তে ইউক্রেনে সৈন্য পাঠিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য ন্যাটো প্রস্তুত ছিল বলে মনে হয় না। পুতিন সেই পরিস্থিতি বুঝতে পারেন। ফলে তাঁর অভিযান ইউক্রেনেই শেষ হবে, নাকি অন্যান্য দেশেও বিস্তার লাভ করবে—সেটাই ঠিক করে দেবে পুতিন যে যুদ্ধের সূচনা করেছেন তার ভবিষ্যৎ তঁার হাতে থাকবে কি না।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট