জুয়া খেলায় হাতে ভালো তাস থাকলেই হয় না, ভাঁওতাও মারতে হয়। ভালো তাস থাকলেও ধাপ্পা লাগে, না থাকলে ভাঁওতা দিয়েই মওকা মারতে হয়। রাজনীতি ও যুদ্ধেও ভাঁওতার দরকার হয়। ইউক্রেন নিয়ে তৈরি হওয়া বৈশ্বিক উত্তেজনায় বাস্তব ঘটনার সঙ্গে ভাঁওতার ভূমিকাও কম ছিল না।
বাইডেন আর পুতিনের মধ্যে কে বেশি ভাঁওতা মারছেন, তা নিয়ে জল্পনাও ছিল, বিস্তর কল্পনাও ছিল। ইউক্রেনে ‘রুশ আগ্রাসন’ এই হলো বলে যুদ্ধের জল্পনায় ভরে গেল পশ্চিমা গণমাধ্যম। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও বাজি ধরে বললেন, ফেব্রুয়ারি মাসেই তা হতে যাচ্ছে। ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়াল নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গল্পের মতো। হোজ্জার সঙ্গে এক ধনাঢ্য আমিরের শত্রুতা। আমিরকে বেকায়দায় ফেলতে এক হাটবারে হোজ্জা মিথ্যামিথ্যি রটিয়ে দিলেন, অমুক দিন আমিরের বাড়িতে ভোজ হবে। কেউ যেন ওই ভোজন মিস না করে। যথারীতি খবর ছড়াল। নির্দিষ্ট দিনে হোজ্জা দেখলেন, দলে দলে মানুষ ওই আমিরের বাড়ির দিকে যাচ্ছে। সব দেখেশুনে তাঁর মনে হলো, এত লোক যখন যাচ্ছে, তখন বোধ হয় আজ সত্যিই ভোজ আছে। মিস করা ঠিক হবে না। এই ভেবে হোজ্জাও নিজের মিথ্যাকে নিজেই বিশ্বাস করে বসলেন।
ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা হয়েছে সেখানেই। ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের হুমকিকে বাস্তব বলে প্রতিষ্ঠা করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগ এবং তাদের প্রভাবাধীন গণমাধ্যম। সেই বাস্তবকে আরও ভিত্তি দিতে ইউক্রেনে সামরিক সরঞ্জাম পাঠানো শুরু হলো। একপর্যায়ে বাইডেন বলে ফেললেন, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। নিজের কথায় বিশ্বাস রাখার পর তিনি মিত্রদের গোছাতে নামলেন। নেমে দেখলেন, হাতে রইল পেনসিল। অর্থাৎ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ছাড়া আর কোনো রাষ্ট্রনেতা ‘জো হুকুম জাহাঁপনা’ বলতে রাজি নন। ইরাক যুদ্ধের সময় থেকেই এটা দেখা যাচ্ছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীরা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকেই নিজেদের নীতি ভাবতে পছন্দ করছেন। জনসনের জন্য একটা যুদ্ধ দরকার। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিতে বেকায়দায় পড়ে গেছেন তিনি। এ থেকে বাঁচার জন্য একটা যুদ্ধ আর মন্দ কী!
কিন্তু না ফ্রান্স, না জার্মানি—কেউই নিঃশর্তভাবে আমেরিকার নেতৃত্বে ‘মিত্রশক্তি’ হতে রাজি নয়। বরং ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও জার্মানির নয়া চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ মস্কো যাবেন ‘একনায়ক’ পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। অর্থাৎ তাঁরা কূটনৈতিক সমাধানে আগ্রহী। বাইডেনের মতো ‘লড়কে লেঙ্গে ইউক্রেন’ বুলিতে তাঁদের আস্থা নেই। কারণ, জাতীয় স্বার্থ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের মাটিতে আর যুদ্ধ নয়, এ রকম এক সমঝোতা ইউরোপীয়দের মধ্যে রয়েছে। এটা একটা কারণ। আশু বাস্তব কারণটি অন্য। সামনেই ফরাসি নির্বাচন। নির্বাচনের আগেই মাখোঁ চান রুশ-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের ধাঁধাটি সমাধান করে নিজেকে ইউরোপের শান্তিবাদী নেতা করে তুলতে। মনে রাখতে হবে, মাখোঁই ২০১৯ সালে ন্যাটো জোটকে ‘ব্রেন-ডেড’ বলে সমালোচনা করেছিলেন। তার পরপরই ভ্লাদিমির পুতিনকে প্যারিসে দাওয়াত করেন।
জার্মানির সমস্যা রাশিয়া নয়। রাশিয়া তার জন্য সমাধান। রুশ গ্যাস ছাড়া এই শীতে জার্মানি জমে বরফ হয়ে যাবে। ইউরোপীয় চাহিদার ৪০ শতাংশ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। মার্কিন অবরোধে রাশিয়া অবশ্যই ভুগবে। তবে ইউরোপও বাদ যাবে না। কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার থমকে যাবে। ঘরের হিটার থেকে শুরু করে কারখানার শক্তি, বন্ধ হয়ে যাবে। ন্যাটো সদস্য হয়েও জার্মানি তাই ইউক্রেনে সামরিক সাহায্য পাঠাতে রাজি হয়নি। এমনকি ন্যাটোর সদস্যদেশ এস্তোনিয়ার তরফে ইউক্রেনকে জার্মানিতে তৈরি হাউৎজার অস্ত্র রপ্তানি নিষিদ্ধও করা হয়েছে।
পুতিনের সঙ্গে মোলাকাতের শেষে ঝুলি থেকে বের করেন ইউরোপীয় নিরাপত্তার নতুন তত্ত্ব। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়ার মধ্যে নতুন নিরাপত্তা স্থাপত্যের জরুরতের কথা তোলেন। এই ‘নতুন স্থাপত্যের’ দরকার হচ্ছে কেন, যখন ন্যাটো রয়েছে? এর অর্থ হলো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ন্যাটোর যে নিরাপত্তাবলয় ছিল, রাশিয়াকে ঘিরে তেমন বলয়ের তো দরকারই নেই। বরং রাশিয়াকেই নতুন নিরাপত্তাকাঠামোর অংশীদার করে নেওয়া দরকার। সুতরাং বাইডেন কথিত ইউক্রেন যুদ্ধ যদি শুরুও হয়, ফ্রান্সকে সেখানে টানা কঠিন হবে। বাইডেনের বিরক্তির কারণ থাকলেও দুই দিন আগেই মাখোঁ আর পুতিন টেলিফোনে ঘণ্টাখানেক ধরে আলাপও করেছেন।
জার্মানির সমস্যা রাশিয়া নয়। রাশিয়া তার জন্য সমাধান। রুশ গ্যাস ছাড়া এই শীতে জার্মানি জমে বরফ হয়ে যাবে। ইউরোপীয় চাহিদার ৪০ শতাংশ গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। মার্কিন অবরোধে রাশিয়া অবশ্যই ভুগবে। তবে ইউরোপও বাদ যাবে না। কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার থমকে যাবে। ঘরের হিটার থেকে শুরু করে কারখানার শক্তি, বন্ধ হয়ে যাবে। ন্যাটো সদস্য হয়েও জার্মানি তাই ইউক্রেনে সামরিক সাহায্য পাঠাতে রাজি হয়নি। এমনকি ন্যাটোর সদস্যদেশ এস্তোনিয়ার তরফে ইউক্রেনকে জার্মানিতে তৈরি হাউৎজার অস্ত্র রপ্তানি নিষিদ্ধও করা হয়েছে।
রাশিয়া থেকে জার্মানিতে যে গ্যাস আসে, তা থেকেই তৈরি হয় দেশটির রপ্তানি পণ্যের ৬০ ভাগ। এই জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে সরাসরি রাশিয়া-জার্মানির মধ্যে তৈরি হয়েছে নর্ড স্ট্রিম ২ পাইপলাইন। আইনি জটিলতায় এই পাইপলাইন এখনো চালু না হলেও জার্মান অর্থনীতির জন্য এটা নতুন রক্তবাহী ধমনির মতো। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটো জোটে জার্মানি সক্রিয়ভাবে না থাকা মানে ইউরোপীয় ন্যাটো পঙ্গু হয়ে পড়া।
সুতরাং আসন্ন ‘রুশ আগ্রাসনের’ আগে দেখা গেল বাইডেনের হাতে তুরুপের তাস তেমন নেই। খোদ ইউক্রেনই এখন ন্যাটোর হম্বিতম্বিতে বিরক্ত। দেশটির প্রেসিডেন্ট পেন্টাগনের সুরের বিপরীতে যুদ্ধপিপাসুদের ‘শান্ত’ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনকে বলা হয় ভূরাজনৈতিক বাজিকর। জর্জিয়া, বেলারুশ, সিরিয়া ও কাজাখস্তানকে পুতিন রুশ ভূরাজনৈতিক স্বার্থের ছকে টেনে এনেছেন। ইউক্রেনেও সেটাই চাইছেন তিনি। তাঁর খ্যাতি-অখ্যাতির কারণ মোটামুটি দুটি: তাঁর ভূরাজনৈতিক পাশা খেলার পটুতা এবং কথার চেয়ে কাজে এগিয়ে থাকার চমক। যখন মার্কিন শিবির নিজেরাই বিভক্ত, তখন বেইজিং অলিম্পিকের উদ্বোধনী আসরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চি পিংকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন, রাশিয়া আক্রান্ত হলে চীন বসে থাকবে না। দেখা যাচ্ছে, ন্যাটোর যে মন্ত্র ন্যাটোভুক্ত ফ্রান্স বা জার্মানি মানতে দ্বিধান্বিত, সেই মন্ত্র নিয়েই জোট গড়ছে রাশিয়া ও চীন। ন্যাটো চুক্তির মৌলিক অঙ্গ আর্টিকেল ৫-এ বলা হয়েছিল, ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশ আক্রান্ত হলে অন্য সদস্যদেশগুলো একযোগে রুখে দাঁড়াবে। রাশিয়া আক্রান্ত হলে চীন তো থাকবেই, ইরান-তুরস্কও পক্ষ বেছে নেবে। বলা বাহুল্য, তা ন্যাটোস্তান গড়তে নয়, ইউরেশিয়া গড়ার পক্ষে।
পুতিনের হাতের আরও তাস বের হচ্ছে। মাখোঁ মস্কো ও কিয়েভের মধ্যে শান্তির নায়ক হতে চান। কিন্তু ইতিমধ্যে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে হাজির তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ এরদোয়ান। তিনি ন্যাটোভুক্ত একটি দেশের নেতা হিসেবে একদিকে ইউক্রেনের কাছে আর্মেনীয় যুদ্ধের পরীক্ষিত বিজয়ী বায়াখতার ড্রোন বেচছেন, অন্যদিকে হতে চাইছেন রাশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা অংশীদার। অটোমান সাম্রাজ্যের নস্টালজিয়ায় কাতর এই নেতা পুতিনের ইউরেশিয়া সংযোগ প্রকল্পেও আছেন, চীনের বেল অ্যান্ড রোডেও আছেন, আবার ন্যাটোতেও আছেন। তারপরও রুশ-মার্কিন হিসাবের বাইরে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে খেলে দিয়েছিলেন আজারবাইজানে। সব পক্ষের কাছে জরুরি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিচ্ছেন তিনি। চাইছেন, ন্যাটো রুশ সীমান্তের কাছে ঘেঁষবে না, আবার ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বও অক্ষুণ্ন থাকবে।
এতটুকুতে পুতিনও রাজি। এভাবে শক্তির সমীকরণ পুতিনের দিকেই হেলে যাচ্ছে।
পশ্চিমারা রাশিয়ার সঙ্গে প্রতারণাই করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর পাশ্চাত্য কথা দিয়েছিল, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর বিস্তার ঘটানো হবে না। সেই কথা রাখা হয়নি। ২০১৪-১৫ সালের রুশ-ইউক্রেন সংকটের পর মিনস্ক চুক্তি ইউক্রেনসহ সব পক্ষ মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ইউক্রেন সেই চুক্তি ভঙ্গ করে রাশিয়ার সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি বানাতে ন্যাটোকে ডেকে এনেছে। তৃতীয়ত, বেলারুশ, কাজাখস্তানসহ রুশ সীমান্তের কাছের বিভিন্ন রাষ্ট্রে মার্কিন মদদে রঙিন বিপ্লবের মহড়াও রাশিয়া মানবে কেন? কোনো বড় রাষ্ট্রই তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে প্রতিপক্ষ শিবিরে চলে যেতে দেবে না। এদিক থেকে রাশিয়া ন্যাটো ও পাশ্চাত্যের কাছ থেকে যে নিরাপত্তা গ্যারান্টি চাইছে, তা অন্যায্য নয়। কিন্তু ছোট রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকেও মানতে হবে। পাল্টাপাল্টি সামরিক জোটে নাম লেখাতেই হবে কেন তাদের? হয় তুমি মার্কিন, নয়তো তুমি চীনা বা রাশিয়াপন্থী; এটা তো হতে পারে না। জোটনিরপেক্ষ অবস্থানও থাকতে পারে, চলতে পারে সব পক্ষীয় যোগাযোগ।
আবার ছোট রাষ্ট্রেরও উচিত নয় আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর হাতের পুতুল হয়ে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা। ইউক্রেন রাশিয়ার জন্য হুমকি না হোক, তেমনি রাশিয়াও ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব মেনে নিক। কিন্তু মেনে না নিলে কী হবে? যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ন্যাটোর যুদ্ধমঞ্চ বানিয়ে ফেললেও জবাবে ইউক্রেনে হামলা করা ছাড়াও উপায় আছে রাশিয়ার। ইউক্রেন থেকে বের হয়ে যাওয়া রুশভাষী দুটি অঞ্চলের স্বাধীনতার দাবিকে স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া। তখন ইউক্রেন তার ভূখণ্ড উদ্ধারের নামে ন্যাটোর কামানের নল নিজের কাঁধে তুলে নিলে রাশিয়া পাল্টা হামলা বৈধতা পেয়ে যাবে। পুতিন বলতে পারবেন, আমরা তো স্বাধীনতার পক্ষে, ন্যাটোই বরং আগ্রাসী।
ওদিকে ইউরোপে মাখোঁ আর ইউরেশিয়ায় এরদোয়ান হয়ে উঠছেন আঞ্চলিক শক্তির নেতা। বন্ধু বাছাইয়ে পুতিনের ভুল হয় না। আর পৃথিবীও দেখেছে, গণতন্ত্র রপ্তানির ফল সাধারণত বুমেরাং হয়।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
faruk. wasif@prothomalo. com