গত ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক চলছিল। এ সময় জাতিসংঘে ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত সেরজিয়ে কিসলিৎসিয়াসকে জানানো হলো, তাঁর দেশে রাশিয়ার আক্রমণ শুরু হয়েছে। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে কিসলিৎসিয়াস তাঁর রাশিয়ান প্রতিপক্ষ ভ্যাসিলি নেবেনজিয়ার দিকে তাকালেন। তাঁকে বললেন: ‘যুদ্ধাপরাধীদের জন্য কোনো ছাড় নেই। তারা সরাসরি নরকে যাবে।’
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন যে আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এটা একটি অপরাধও। এই অপরাধ কেবল মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচারের পক্ষসমর্থন করে সই করা লোকদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে না, এটি খোদ রাষ্ট্র দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে। গত কয়েক দিন ধরে অনেক রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি, মিডিয়া এবং বিশ্লেষক যথার্থই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘৃণ্য আচরণের সমালোচনা করছেন।
বেশ জোর দিয়ে তাঁরা পুতিনের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। কিন্তু পুতিন এখন যা করছেন তা শুধু ঘৃণ্য বিশেষণে সমালোচনা করে উড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয় নয়। তিনি এখন ভয়ংকর কাজ করছেন। এই আক্রমণটি হলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের ‘কলিং কার্ড’ এবং যুদ্ধাপরাধ হলো তাঁর স্বাক্ষর।
ইউক্রেনের বেসামরিক ভবনগুলোতে রকেট হামলার ঘটনাসহ সেখানে এখন যা কিছু ঘটছে তার দায় সম্পূর্ণরূপে পুতিনের ওপরই বর্তায়। কয়েক দিন আগে, আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ক পণ্ডিত ফ্রেডেরিক মেগরেত এবং কেভিন জন হেলার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করে আগ্রাসনের অপরাধ করবেন। এখন বোঝা যাচ্ছে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে কেউ অবাক হবেন না। কারণ পুতিনের ব্যক্তিগত জীবন নৃশংসতা, অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় পরিপূর্ণ।
১৯৯৯-২০০০ সালে চেচনিয়ায় রাশিয়ার যুদ্ধের ওপর চেপে পুতিন খ্যাতি পেয়েছিলেন এবং সে সুবাদেই তিনি ক্ষমতায় আসেন। রাশিয়ার বিচ্ছিন্ন অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে ধ্বংস করতে রাশিয়া সরকার অনেক আগে থেকেই ভয়াবহ মাত্রার সহিংসতা দেখিয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নথিতে রাশিয়ার সেনাদের ‘নির্বিচারে এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বেসামরিক বস্তুতে বোমা বর্ষণ ও গোলাবর্ষণ’ এবং ‘যোদ্ধাদের ওপর জেনেভা কনভেনশনের বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে নির্যাতনের’ রেকর্ড আছে।
পশ্চিমারা বরাবরই পুতিনের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের জবাব নম্রভাবে দিয়েছে। নিন্দিত হওয়ার পরিবর্তে, পুতিন প্রধানত তাঁর পূর্বসুরী বরিস ইয়েলেৎসিনের স্থলাভিষিক্ত এমন একজন নেতা হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন যিনি রাশিয়ানদের অধিকতর উন্নত জীবন এবং পশ্চিমের সঙ্গে অধিকতর ভালো সম্পর্কের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
২০০৮ সালে পুতিন জর্জিয়ার দিকে মনোযোগ দেন এবং রাশিয়ান সেনাদের (যাদের তিনি ‘শান্তি রক্ষাকারী’ বলে থাকেন) জর্জিয়ান প্রদেশ দক্ষিণ ওশেটিয়া এবং আবখাজিয়ায় আক্রমণ করতে নির্দেশ দেন। রুশ সেনারা সেখানে যা করেছিল তাঁকে আর যাই হোক শান্তি রক্ষা করা বলা চলে না। যদিও মস্কো মানবিক ভাষা ব্যবহার করে যুক্তি দিয়েছিল, উভয় অঞ্চলে রাশিয়ার নাগরিকদের ‘রক্ষা করার দায়িত্ব’ রাশিয়া সরকারের; কিন্তু বাস্তবতা হলো, রাশিয়ান বাহিনী সেখানে নির্বিচারে বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছিল যা ছিল যুদ্ধাপরাধ।
২০১৪ সালে পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করেছিলেন। সেবার তিনি ক্রিমিয়াকে অবৈধভাবে দখল করে রাশিয়ার সঙ্গে একীভূত করেন। আর সেই ঘটনাই লুহানস্ক এবং দোনেতস্কে সংঘাতের ফুলকি ছড়িয়ে দেয় এবং এতে আনুমানিক ১৪ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিল। সহিংসতার সময় রাশিয়ান-সমর্থনপুষ্ট জঙ্গিরা ইউক্রেনের ওপর দিয়ে যাওয়া মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ১৭-এ ভূপাতিত করেছিল এবং তাতে ২৯৮ জন যাত্রী নিহত হয়েছিল।
বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে রাশিয়ান বাহিনীর আক্রমণ ছিল সাধারণ ঘটনা। বন্দী শিবিরগুলোতে হত্যা ও নির্যাতনের যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে তাকে রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা পরিচালিত ‘ইউরোপের শেষ বন্দী শিবির’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো পুতিনের অপরাধের একটি ক্ষুদ্র অংশ যা মানবাধিকার এবং তদন্ত সংস্থা দ্বারা নথিভুক্ত করা আছে।
রুশ বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধগুলোও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) পুতিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আইসিসি ২০১৬ সালে জর্জিয়ায় নৃশংসতা এবং ২০২০ সালে ইউক্রেনে সংঘটিত অপরাধের জন্য তদন্ত শুরু করেছিল। সেই তদন্ত শেষে আইসিসি রায় দিয়েছিল, রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের যুক্তিসংগত ভিত্তি আছে। আইসিসি রায়ে বলেছিল, সেখানে যে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা বিশ্বাসযোগ্য।
তারপর আছে সিরিয়া। এক দশক ধরে সেখানকার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার প্রমাণ থাকার পরও পুতিন বাশারকে সমর্থন করেছেন। সিরিয়ায় রুশ বিমানবাহিনী হাসপাতালে পর্যন্ত বোমা মেরেছে এবং তাঁরা যুদ্ধে হতাহতদের উদ্ধারে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকদের পর্যন্ত আক্রমণ করেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের গঠন করা সিরিয়া সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের ২০২০ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাশিয়া জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করে সিরিয়ায় বেসামরিক এলাকায় বোমাবর্ষণ করেছে। ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত আন্তর্জাতিক অপরাধে জড়িত থাকাতেই যেন পুতিনের মন ভরছিল না। তাঁর বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত রুশ ভিন্নমতাবলম্বীদের বিষ প্রয়োগে মারা এবং গণতন্ত্রপন্থী ও মানবাধিকার সমর্থকদের কারারুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগও আছে। পুতিনের বিরুদ্ধে যে পরিমাণ দুর্নীতির অভিযোগ আছে তার মাত্রা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে।
তবে এর কোনোটাকেই রাশিয়ার দোষ হিসেবে ধরা যাবে না। কারণ পুতিন রাশিয়া নন এবং রাশিয়াও পুতিন নয়। গত কয়েক দিনে রাশিয়া জুড়ে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ইউক্রেন আক্রমণের প্রতিবাদে যেভাবে রাস্তায় নেমেছেন তাতে সেটিই প্রমাণিত হয়। রাশিয়ার অনেক শহর ‘নো টু ওয়ার’ গ্রাফিতিতে ছেয়ে গেছে। অর্থাৎ পুতিন তাঁর দেশের মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই অভিযান চালাচ্ছেন।
এখন পুতিনের কর্মকাণ্ডকে শুধু দোনেতস্ক, লুহানস্ক বা কিয়েভের উপকণ্ঠে হামলার বিষয় দিয়ে বিচার করা যাবে না। জর্জিয়া, ক্রিমিয়া, সিরিয়া, চেচনিয়া এবং অন্যান্য জায়গায় পুতিন দায়মুক্তির সঙ্গে যে নৃশংসতা চালিয়েছেন তাও বিবেচনায় আনতে হবে। একেবারে চোখ বন্ধ করে তিনি এত দেশে নৃশংসতা চালিয়েছেন যে তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধকেও ছাড়িয়ে গেছে। সাঁজোয়া যানের সারি যখন ইউক্রেনে প্রবেশ করছিল, তখন জাতিসংঘে কানাডার রাষ্ট্রদূত বব রে পুতিনকে ‘একজন যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
হয়তো পুতিনকে কখনোই আইসিসির মতো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত বিশ্বের চোখের সামনে পুতিনের নৃশংসতার প্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। তাহলে হয়তো একদিন সেই প্রমাণ পুতিন এবং তার সরকারে থাকা লোকদের বিচারে ব্যবহার করা যাবে। সর্বোপরি, বাকি বিশ্বের উচিত পুতিন যা এবং তিনি যা করেছেন ও করছেন, সে অনুযায়ী তাঁর সঙ্গে আচরণ করা। পুতিনকে এমন একজন শাসক হিসেবে দেখা উচিত যিনি একজন অপরাধী; যিনি যুদ্ধের আইন এবং মানবতার মানদণ্ড কিছুই মানেন না।
আল জাজিরা থেকে নেওয়া
অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
মার্ক কার্সটেন ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর একজন ফেলো