প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) সব কীর্তি এখন সবার জানা। পুনরাবৃত্তির দরকার নেই। জানা দরকার কতিপয় প্রশ্নের জবাব। বড় প্রশ্নটি হলো, পি কে হালাদারের সঙ্গে ও আগে-পেছনে আর কে কে? পি কে হালদার তো আর একা একা ‘দানব’ হয়ে ওঠেননি! দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন মহারথীসহ আরও কিছু সহযোগীর নাম আলোচিত হয়ে আসছে। তাদের ব্যাপারে কী করতে পারল আমাদের সরকার?
পি কে হালদারের নামে যেদিন মামলা হচ্ছে, সেদিন মুহূর্তে কে তাঁকে খবর দিল—পালাও, পালাও। কী রাজকীয় আয়োজন! পালানোর চেষ্টামাত্র দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি, রাস্তা ফাঁকা, সীমান্তে সব আয়োজন নিশ্ছিদ্র, একেবারে এক টানে সীমান্ত পার। কে বা কারা এত আয়োজন করল। টাকা থাকলে সবই হয়, বন্ধু যদি ভালো হয়, ভাগ্য যদি সহায় হয়। পি কে হালদারের বেলাতে সবই হয়েছে।
পি কে’র টাকা উড়ে উড়ে গেল ভারতে, কানাডায়; এখন শুনি দুবাইতেও। এই টাকায় পাখা লাগাল কারা? অর্থ পাচার রোধের আইন আছে, কিন্তু পাচার হওয়ার পথ রোধ করার বিষয়টি দেখভাল করার কেউ নেই? যদি থাকে, তাহলে এত টাকা উড়ে উড়ে গেল কী করে? এখন ফেরত আনার তোড়জোড় দেখি, দেখি নানা আয়োজন?
পি কে’র সঙ্গে আর কে কে—এ প্রশ্নে জবাব জানতে চাই ওপারের বন্ধুদের কাছেও। পি কে ধরা পড়ার পর অনেকে বলছেন, দেখেন ভারতের আইন কত শক্ত। যেটা আমরা পারিনি, তারা সেটা পেরেছে, পি কে হালদারকে ধরে ফেলেছে। কিন্তু একই প্রশ্ন সেখানেও। সেখানে পি কে নাম বদলে ভোটার হলেন কী করে? আধার কার্ড, প্যান কার্ড পেলেন কী করে? জমি-ফ্ল্যাট কিনে নামজারি করতে সহায়তা দিল কারা? কাজেই পি কে’র বন্ধুভাগ্য আর টাকার শক্তির জোট সেখানেও কাজ করেছে এক শক্তির সূত্রে।
তবে একটি ধন্যবাদ ভারতীয় গোয়েন্দাদের দিতে হয়। কারণ, জমি-ফ্ল্যাট কেনা নিয়ে গোটা বিষয়টির প্রতি তাঁরা নজর রেখেছেন, তাঁদের সন্দেহ হয়েছে। অথচ পি কে হালদার দেশে যে একের পর এক কোম্পানি গড়লেন, মানুষের টাকা নিজের পকেটে তুললেন, এ নিয়ে আমাদের কারও কোনো সন্দেহই হলো না। এখানে একেকটা কোম্পানি করতে বা জমি কিনতে এত ফাইল চালাচালি হলো সেগুলো নিয়েও কারও জানার আগ্রহ হলো না! নানা প্রয়োজনে বিদেশ সফর চলবেই। কিন্তু স্বামী বা স্ত্রী প্রতি সপ্তাহেই কেন সীমান্ত অতিক্রম করছেন? যাঁরা পাসপোর্টে সিল মারেন, তাঁদের সন্দেহই হয় না, কেন এত ঘন ঘন যাতায়াত, কোথায় চাকরি করেন, বেতন কত, ট্যাক্স দেন কত, এ দেশে স্থায়ী সম্পদ নেই কেন? এসব প্রশ্ন মনেই জাগে না কারও। পি কে’র বেলাতেও তাই ঘটেছে।
সংবাদপত্রের খবর, পি কে নাকি দেশে ফিরতে চান। রাঘববোয়ালদের নামও প্রকাশ করতে চান। আবারও ধাক্কা লাগে, দেশে যদি ফিরতেই চান, তাহলে পালালেন কেন? না পালিয়ে তখনই তো আত্মসমর্পণ করতে পারতেন? তখন পালানোর বুদ্ধি, সহায়তা কে দিল? আসলে পালিয়ে দেখলেন, সময় সবকিছু সামাল দেয় কি না। কিন্তু ওই যে কথায় বলে, সময় খারাপ হলে সাদা কাপড়েরও নাকি রং ওঠে। পি কে আসলে সবদিক সামলাতে পারেননি। এখন তিনি নাকি রাঘববোয়ালদের নাম বলে দিতে চান? জানতে ইচ্ছা করে, এই সাহস ও বুদ্ধি তাঁকে আবার কোন রাঘববোয়ালেরা দিচ্ছে?
একটা সরল অঙ্ক মাথায় ঘুরছে। প্রায় একই ধরনের অপরাধে ডেসটিনির একটি মামলা রায় হতে লাগল ১০ বছর। জেলে আটক ব্যক্তিদের সাজা খাটা শেষ, জরিমানার টাকা দিলে পাপমোচন করে মুক্ত জীবনে ফিরতে পারে তারা। এখন পি কে হালদারের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো ছক কষা হচ্ছে না তো? তাকে দেশে ফিরে আনা হবে, কিছুদিন রাখা হবে জেলে, কিছুদিন হাসপাতালে। এভাবে তিনিও একদিন দায়মুক্তি পেয়ে যাবেন। সবকিছু আইনিভাবেই হবে, তাঁর শাস্তিও হবে। কিন্তু দিন শেষে পি কে ও তার সহযোগীরা আরাম-আয়েশের জীবনযাপন নিশ্চিত হয়ে গেল। তবে পি কে যে রাঘববোয়ালদের নাম বলে দিতে চান, প্রয়োজনে এই বোয়ালরাই পুঁটি মাছ হিসেবে তাকে গিলে ফেলতে পারে, সেটিও নিশ্চয়ই পি কে’র না বোঝার কথা নয়।
পি কে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি জমে উঠেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপি এখন পি কে’র ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টায় আছে। ওদের ওখানে যা-ই হোক, এপারে বসে যাঁরা ভারতকে ‘মুক্তাঞ্চল’ ভাবছেন, তাঁদের জন্য পি কে হালদার ধরা পড়া একটা বড় সতর্কবার্তা। ঘরের পাশের দেশ বলে পি কে’র কাহিনি লতায়-পাতায় ফুলেফেঁপে এপারে আসছে; কিন্তু যারা ‘দূরের নক্ষত্র’, তাদের সব জানব কীভাবে?
বিদেশে টাকা পাচারের তথ্য নেই বলে হতাশ অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, এমন সুবিধা দেব, যাতে সবাই টাকা নিয়ে ফিরে আসেন। বিনয়ের সঙ্গে বলি, মাননীয় অর্থমন্ত্রী, যা যায় তা যায়, কখনো ফেরত আসে না। কিছু ব্যতিক্রম হতে পারে, কিন্তু যা গেছে, তা ফেরত আসবে না কোনো দিন। কাজেই পারলে পাচার ঠেকান।
আশার কথা হাইকোর্ট বলেছেন, আমরা এমন আদেশ দেব, পি কে হালদার ও অন্য অর্থ পাচারকারীরা পৃথিবীর কোথাও গিয়ে শান্তিতে থাকতে পারবেন না। ফসল রক্ষার জন্য দেয়াল যত পোক্ত বা উঁচু করাই হোক না কেন, নিচে ইঁদুর চলাচলের ছিদ্র যদি বন্ধ না করা যায়, তাহলে ফসল রক্ষা করা যাবে না। পি কে হালদারকে নিয়ে এপার-ওপারের সংঘবদ্ধ চক্র সেই জানান দেয়।
মনজুরুল আহসান বুলবুল বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি