কয়েক দিন ধরে পাহাড়ে চলছে নাচ, গান, পানাহার, খেলাধুলা, ঘোরাঘুরি আর রঙের ছড়াছড়ি। এমনিতে উজ্জ্বল রং পাহাড়িদের পছন্দ। তাদের নাচের পোশাকের রং তো অবশ্যই, সাধারণ পরিচ্ছদেও রঙের সমাহার স্পষ্ট। ফেসবুকে দেখছি রঙিন উৎসব চলছে পাহাড়ে। নববর্ষের উৎসব। পুরোনোকে বিদায় জানানো আর নতুনকে বরণ করার উৎসব। বৈষু, বিজু, সাংগ্রাই, বিহু উৎসব। তাই আজ দুঃখ-কষ্টের কথা থাক। আনন্দ ও সম্ভাবনার কথা বলি, জীবনের কথা বলি।
আজ এই উৎসবের দিনে পাহাড়ি যুবতীরা ভোরবেলা নদীতে, হ্রদের জলে, পুকুরের জলে নানা রঙের ফুল ভাসিয়ে দিক। প্রার্থনা করি, এ বছর যেন জুম খেতে ফসল ভালো হয়, ঠিকমতো যেন বৃষ্টি নামে, পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে যেন ফসল বাঁচে, ভোরের সূর্য যেন শরীরে নতুন শক্তি নিয়ে আসে, আকাশের চন্দ্র-তারা যেন সব যন্ত্রণা তুলে নিয়ে যায়, বনের ফুলেরা স্নিগ্ধতায়-সুগন্ধে যেন সবার মন ভরিয়ে দেয়, পাহাড়জুড়ে যেন সবুজ ঘাস ও চিরহরিৎ বন জীবন ফিরে পায়। এই হোক আজ শুভকামনা। সবার মধ্যে নববর্ষের নতুন অনুভূতি ও দৃষ্টিভঙ্গির উদয় হোক, যে অনুভূতি হবে ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই।’ যদি এমন হতো, বৈশাখী ঝড় এসে রাজনীতির সব কালিমা ধুয়েমুছে দিয়েছে, এখানে মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা ও মমতা বেড়েছে, পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস দূর হয়েছে, পাহাড় ও সমতলে বইছে শান্তির সুবাতাস—কত ভালো হতো। আমি চাই, এখানে পাহাড়দেশে কেউ আর ভয় ও শঙ্কা নিয়ে বসবাস করবে না, বরং আশা ও অপার সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাবে।
অনেক বছর আগে বিজু উৎসবে আমি রাঙামাটি শহরে ছিলাম। ভোরে শহরের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বনরূপা বাজারে গিয়েছিলাম। সকালবেলা বাজারে অনেক মানুষ। দেখলাম, পাহাড়ি নারীরা তাঁদের জুম খেতের শাকসবজি-ফলমূল বিক্রি করতে এসেছেন। বনরূপায় পথের
দুধারে বাজার। বনরূপা বাজার পাহাড়ি নারীর পদচারণে মুখর। দেখলাম, ক্রেতা-বিক্রেতা অনেকেই পাহাড়ি। জেনেছিলাম, এ বাজারে বাঙালি বিক্রেতা ও ক্রেতার সংখ্যা বেশি নয়। বাজার ঘুরে দেখলাম, কত ধরনের সবজি বাজারে নিয়ে আসেন পাহাড়িরা। গারোরা বনের যে ফলকে খুংখা বলে, যা খুব তেতো, তাও দেখলাম বাজারে। নানা ধরনের পাতা দেখলাম, আলু দেখলাম। সাবারাং নামের একধরনের ছোট পাতার সবজি দেখেছিলাম বাজারে। কত রকম খাবারের আবিষ্কারক পাহাড়ের মানুষেরা? মারফা নামের একধরনের শসা পাহাড়িরা চাষ করেন। ফুজি ও বাওর নামের একধরনের সবজি দেখেছিলাম, যা জুম খেতে হয়। কত কিছু মেলে বাজারে! আমার বিশ্বাস, এখনো বনরূপার বাজারে প্রচণ্ড রোদের মধ্যেও পাহাড়ি নারীরা তাঁদের বাজার সাজিয়ে বসেন।
আজ এই উৎসবের দিনে একটি তথ্য দিতে চাই। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু স্বাধীনতার মাত্র ১২ বছরের মধ্যে ১৯৫৯ সালে ‘ট্রাইবাল পলিসি’ গ্রহণ করেছিলেন। পাঁচটি দর্শনের ওপর এই নীতি তৈরি হয়, যার মূল কথা হলো ‘ট্রাইবাল টাচ’ বা ট্রাইবাল স্পর্শ। নেহরু তাঁর নীতিতে বলেছেন, পাহাড়-অরণ্যের মানুষেরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, পরিচয়, রীতিনীতি, প্রথা নিয়ে উন্নতি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে, তাদের ভূমি ও অরণ্যের অধিকারকে সম্মান ও স্বীকৃতি দেওয়া হবে, তাদের মধ্য থেকে এমনভাবে শিক্ষিত ও দক্ষ একটি টিম গড়ে তোলা হবে, যাতে তারা নিজেরা প্রশাসন ও উন্নয়নের চালিকাশক্তি হয়, তাদের অঞ্চলে অতিরিক্ত প্রশাসনিক চাপ না দিয়ে সহানুভূতির নীতি গ্রহণ এবং পাহাড়-অরণ্যের মানুষদের উন্নয়নের ফলাফল পরিসংখ্যান বা অর্থ ব্যয়ের পরিমাণ দিয়ে না মেপে মানবসত্তার বিকাশ দিয়ে পরিমাপ করা হবে। আজ নববর্ষের এই উৎসবের কালে প্রশ্ন রাখব, যদি ভারতে স্বাধীনতার ১২ বছরে ট্রাইবাল নীতি হয়, আমাদের দেশে ৪৬ বছরেও কেন একটি নীতিমালা হলো না। তবে আমি আশাবাদী, একদিন এই নীতি হবে, যার মূল কথা হবে ‘অসীম নম্রতা’। ভালোবাসা দিয়ে, মর্মানুভূতি দিয়ে, আন্তরিকতা ও হৃদয়ের শুদ্ধতা দিয়ে লেখা হবে এই নীতিমালার প্রতিটি বাক্য।
আমার মতো আজ থেকে অনেক বছর আগে রাঙামাটি শহরে যাঁরা সংস্কৃতি মেলায় গেছেন, নিশ্চয় দেখেছেন এই শহরে তঞ্চঙ্গ্যা দুই বোন গান গাইতেন। সম্ভবত তবলছড়ির দিকে বাড়ি ছিল তাঁদের। মঞ্চে ছিল তাঁদের নিয়মিত সরব উপস্থিতি। পাহাড়ি কি বাঙালি অনেকেই তাঁদের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছেন। তারপর অনেক দিন তাঁদের খবর আমি জানি না। কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরে তাঁদের একজনকে দেখেছি। পরিবার নিয়ে তিনি সেখানে আছেন। পরে জেনেছিলাম, অন্য বোনটিও দেশের বাইরে। আমি তঞ্চঙ্গ্যা গানের অর্থ জানি না। তবে অনেক গান শুনেছি তাঁদের কণ্ঠে। কখনো একক, কখনো দ্বৈত কণ্ঠে তাঁদের গান। রাঙামাটি শহরে যাঁরা গান ভালোবাসেন, নিশ্চয় তাঁদের কথা সবার মনে আছে। শুধু ভাবতে গেলে শূন্যতার হাহাকার বুকে বাজে, কেন পাহাড়ের মানুষেরা দেশান্তরি হচ্ছে? আজ এই উৎসবের দিনে আমরা কি এই প্রশ্ন করতে পারি, যাতে ভবিষ্যতে আমরা আমাদের স্বজনদের আর না হারাই?
আমি নববর্ষের দিনে আশা রাখতে চাই, আমাদের রাজনীতি ভবিষ্যতে অনেক সুন্দর হবে। ‘আনন্দরূপ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আশা ও আনন্দ জাগিয়ে রাখতে বলেছেন। বলেছেন, ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে, ক্ষুদ্র অহমিকা দূর করে নিজের অন্তঃকরণকে একবার জাগিয়ে তুলতে। বলেছেন, ‘নিজের এই ক্ষুদ্র চোখের দীপ্তিটুকু যদি আমরা নষ্ট করিয়া ফেলি, তবে আকাশভরা আলো তো আর দেখিতে পাই না।’ আমরা আকাশভরা আলো দেখতে চাই।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।