পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, শঙ্খ, মাতামুহুরী, কর্ণফুলী, যমুনা, কুশিয়ারা প্রভৃতি নদ-নদীতে রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে যঁারা দিনের পর দিন জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে নৌকা বেয়ে, দঁাড় টেনে চলেছেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যঁারা শক্ত মাটি চষে সোনার ফসল ফলিয়ে চলেছেন, তঁাদের মনের কথা সংবিধানে লেখা হয়নি। বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা উচিত নয়। কিন্তু সেই সব জাতির কথা এই খসড়া সংবিধানে নেই। বিভিন্ন জাতিসত্তার কথা এখানে স্বীকৃত হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো কথাই সংবিধানে নেই। ব্রিটিশ শাসন থেকে আরম্ভ করে সব সময় এই এলাকা স্বীকৃত হয়েছিল। অথচ আজ এই সংবিধানে সেই কথা নেই—গণপরিষদে ১৯৭২ সালের ২৫ অক্টোবর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এভাবে কথা বলেছিলেন।
আজ ১০ নভেম্বর তঁার প্রয়াণ দিবস। প্রতিবছর পাহাড়ের মানুষ দিনটি স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিয়ে। দিবসটি পাহাড়ে পালিত হয় দুঃখ-বেদনা নিয়ে, আবার শক্তি নিয়ে। এটিই তো আশার কথা যে শোক হয়ে যায় শক্তির উৎস। একটি শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখতেন তিনি, যেখানে পাহাড়ি-বাঙালি সব নাগরিক মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে বঁাচতে পারবে। গণপরিষদে বারবার দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসার কথা তিনি বলেছেন। কৃষক, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষ, রিকশাচালক, নৌকার মাঝি, নারীর অধিকারসহ সবার অধিকারের কথা বলেছেন।
তঁার সংসদীয় বক্তৃতাগুলো স্মারকগ্রন্থ আকারে প্রকাশ করা হয়েছে ২০০৯ সালে। বইটি তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণা হবে বলে আমি মনে করি। আদিবাসীদের ওপর নির্যাতন চলছে, সঁাওতালদের বাড়িঘর ছারখার করে দেওয়া হয়েছে, লংগদুতে সাম্প্রদায়িক বর্বরতা চলেছে, কিন্তু কোনো বিচার নেই। এই অবস্থায় মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার কথাগুলো নতুন করে ভাবায়, মনে আশা সঞ্চারিত করে। জাতীয় সংসদে এভাবে কথা বলা যায় এবং কথাগুলো রেকর্ড হয়ে থাকে, এটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সেই কালে মানুষের জন্য, দেশের জনগণের জন্য বলেছেন, ‘আমার যে ব্যাখ্যা, আমার যে বক্তব্য, তার সবই দেশের প্রতি ভালোবাসার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যেভাবে আমার দেশকে, জন্মভূমিকে ভালোবেসেছি, যে দৃষ্টিকোণ থেকে আমি এ দেশের কোটি কোটি মানুষকে দেখেছি, সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমি খসড়া সংবিধানকে দেখতে যাচ্ছি।’
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে সংসদেও সংখ্যালঘু হওয়ার বেদনা সইতে হয়েছে। মনের দুঃখে ওয়াকআউট করতে হয়েছে।
আমরা নিশ্চয় আশায় আছি, এক নতুন, সভ্য ও উন্নত, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্রের দেখা পাব। আবার নতুন করে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার সংসদীয় বক্তৃতা কবিতার মতো করে মানুষের হৃদয়ে বাজবে।
অনেক আশা নিয়ে একটি চুক্তি করেছিলেন পাহাড়ের মানুষেরা। লিখিত চুক্তি। তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ও পারিষদবর্গের কী উচ্ছ্বাস! সেই চুক্তির প্রায় ২০ বছর হয়ে গেল। ১৯৯৭ সালের আশাভরা সেই মুখগুলো, সেই সব মানুষ আজ কেমন আছেন, কোথায় আছেন? তঁাদের সন্তানেরা আজ নিশ্চয়ই বড় হয়েছেন। তঁারা এখন তরুণ। তঁারা কোথায় কেমন আছেন? নিশ্চয়ই তঁারা আশা হারিয়ে ফেলেননি। হাল ছেড়ে দেননি। অন্য কারও ভরসায় তঁারা নিশ্চয়ই বসেও নেই। এই নতুন দিনের তরুণ গায়কেরা নিশ্চয়ই আগামী দিনে নতুন দিনের গান শোনাবেন। মুক্তির আনন্দের গান। কথায় আছে, রাত যত গভীর হয়, ভোর তত নিকটবর্তী হয়। নিশ্চয়ই আজকের চেয়ে আগামীকাল আরও সুন্দর হবে।
আমাদের দেশটা যদি সুন্দর হয়, গণতান্ত্রিক ও মানবিক হয়, সব মানুষের জন্য বাসযোগ্য হয়, তবেই মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে স্মরণ করা সার্থক হবে। অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি বলে গেছেন, একটি দেশ কতটা গণতান্ত্রিক, কতটা সভ্য ও উন্নত, তার বিচার্য হলো সেই দেশে সংখ্যালঘু জনগণ কেমন আছে, সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষ কেমন আছে। দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের অবস্থা কেমন। সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল ডুবে গিয়ে হাহাকার করা মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে? চার কোটির অধিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসে বাধ্য হওয়া মানুষ উন্নয়ন নিয়ে কী বলে? অমানবিক পেশায় নিয়োজিত লাখ লাখ মানুষ, বস্তি ও পথের নারী ও শিশু, উত্তরবঙ্গসহ সারা দেশে বন্যায় ডুবে যাওয়া মানুষের দল, যঁারা অনেকে ক্ষুধার জ্বালায় শহরে এসে রিকশা চালাচ্ছেন নতুনভাবে, নাসিরনগরের হিন্দু, রামুর সন্ত্রস্ত বৌদ্ধ, লংগদুর পাহাড়ি মানুষ ও গাইবান্ধার সঁাওতালরা কেমন আছে? এই মানুষেরা সবাই যদি বলেন ভালো আছেন, তবেই বুঝতে হবে দেশটা মানবিক হয়েছে, উন্নত হচ্ছে, সভ্য হচ্ছে।
আসুন, মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার মতো বলি, আমি যেমন দেশকে, মাতৃভূমিকে ভালোবেসেছি, সেভাবেই প্রিয় দেশটাকে দেখতে চেয়েছি। এভাবে একদিন আমাদের দেশে নতুন সূর্যের প্রভাত আসুক। আঁধার চিরে আলো ফুটুক সবখানে।
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জন্য আজ গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
সঞ্জীব দ্রং: কলাম লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।