১৮ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামে এক নতুন ইতিহাস রচিত হলো। পার্বত্য চুক্তির যথাযথ, দ্রুত ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবিতে বান্দরবানের ঘুমধুম থেকে খাগড়াছড়ির দুদুকছড়া পর্যন্ত ৩০০ কিলোমিটার পথে গণমানববন্ধন রচনার মধ্য দিয়ে এ দিনটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। একই সঙ্গে সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠনের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় গণমানববন্ধন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম হেডম্যান নেটওয়ার্কের উদ্যোগে এ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
চাকমা ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, ‘সুলস্নুগো ন মুরোদি য়ো যায়, বে-সুলস্নুগো ন পানি দি য়ো ন যায়’ অর্থাৎ একতা থাকলে স্থলেও নৌকা চলে, আর একতাবিহীন নৌকা জলেও চলে না। এই প্রবাদটি কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। এ প্রবাদের যথার্থতা মিলল ১৮ জানুয়ারি। চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি নিয়ে এতগুলো বছর বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে আন্দোলন চললেও নজিরবিহীনভাবে এমন সাড়া পাহাড় এবং সমতলে একসঙ্গে কখনো হয়নি। পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে এই ৩০০ কিলোমিটারের মানববন্ধনটি সরকারের উদ্যোগেও হতে পারত! ঘুমধুম থেকে দুদুকছড়া পর্যন্ত রচিত গণমানববন্ধনটি নিশ্চয় পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে যাওয়া চেঙ্গী, কর্ণফুলী, কাজলং, সাংগু কিংবা মাইনী নদীর মতো দেখতে হয়েছে!
পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিকামী মানুষগুলোর এই শান্তিপূর্ণ গণমানববন্ধনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধার অভিযোগ এসেছে। খাগড়াছড়ির মাইসছড়িতে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করতে আসা লোকজনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাস্তায় দাঁড়াতে দেয়নি। মানববন্ধনের ব্যানার, ফেস্টুন কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং সমবেত জনতার ওপর লাঠিপেটা করে কমপক্ষে নয়জনকে আহত করার খবরও পাওয়া গেছে। (সূত্র: প্রথম আলো, নিউএজ, ১৯ জানুয়ারি)। পার্বত্য চট্টগ্রামে, বিশেষত খাগড়াছড়ির প্রশাসন খাগড়াছড়িতে কোনো সংগঠনকেই কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনের জন্য অনুমতি প্রদান করছে না! সমাবেশ করার অধিকার রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ধরনের অসহযোগিতামূলক আচরণ সেখানকার পরিস্থিতিকে বরং আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। কোনো এলাকার মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে সেই এলাকায় শান্তি বজায় রাখা বা স্থাপন করার নজির খুব একটা নেই। যদি সেটি সম্ভবও হয় তাহলে ধরে নিতে হবে সেই এলাকাটি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে আছে! কারণ বারবার বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেখানে তুষের আগুন জ্বলে ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
>আমাদের আহ্বান থাকবে চলমান শীতকালীন অধিবেশনে এই ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১-এর সংশোধনী আইনটি উত্থাপন করে সংসদে পাস করা হোক
পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের ১৮ বছর পরেও চুক্তির মৌলিক ধারাগুলো এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও পাহাড়ের মানুষেরা দীর্ঘ দেড় যুগ ধরে চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে এলেও কোনো সরকারের আমলেই বিশেষ করে চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকার হিসেবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার পরপর দুবার ক্ষমতায় থাকার পরেও চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রীরা এবং কতক ক্ষেত্রে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের আশ্বাস দিলেও সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আজও আসেনি!
বর্তমােন দশম সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, এ শীতকালীন অধিবেশনে বেশ কয়েকটি বিল উত্থাপন ও পাস করা হবে। কিন্তু সম্ভাব্য সেসব বিলের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনটি নেই। অথচ পার্বত্য চুক্তির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ধারার মধ্যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন একটি অন্যতম শর্ত ছিল। কিন্তু এ কমিশনের আইনে কতগুলো ধারা চুক্তির সঙ্গে বিরোধাত্মক হওয়ায় এই আইনের সংশোধনী আবশ্যক হয়ে পড়ে। আইন সংশোধন না হওয়ায় এ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনটি বর্তমানে অথর্ব কমিশনে পরিণত হয়েছে। ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারাগুলো সংশোধনের লক্ষ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর ২০১৩ সালে এ আইনের ১৩টি বিরোধাত্মক ধারা সংশোধনের বিষয়ে সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি একমত হলেও আজ পর্যন্ত এ সংশোধিত আইনটি সংসদে পাস হয়নি। আমাদের আহ্বান থাকবে চলমান শীতকালীন অধিবেশনে এই ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন, ২০০১-এর সংশোধনী আইনটি উত্থাপন করে সংসদে পাস করা হোক।
পরিশেষে বলতে চাই, পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য অচিরেই যেন একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হয়। বর্তমানে দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো ভূমি সমস্যা। এ ভূমি সমস্যাটি পাহাড় এবং সমতল উভয় ক্ষেত্রেই চলমান একটি সমস্যা। তাই পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের আইন সংশোধন করে এ কমিশনকে কার্যকর করে তোলা এবং সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর জন্য আলাদা স্বাধীন ভূমি কমিশন গঠন করা হোক।
ইলিরা দেওয়ান: হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
[email protected]