পার্বত্য চট্টগ্রাম: কারও বিনোদন কারও হুতাশন
প্রতি মুহূর্তে পাল্টাচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম
বান্দরবান শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে বগা লেকের পাড়ে বসে কফি খাওয়ার ব্যবস্থা আছে এখন। ঢাকার উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্তের জন্য এ এক রোমাঞ্চকর সুযোগ। তাঁদের নিরাপত্তা দিতে সেখানে আছে ক্যাম্পও। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দুই হাজার ফুট উঁচুতে স্বচ্ছ পানির এই লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে শত শত মানুষ রুমা যাচ্ছে প্রতি সপ্তাহে।
ঘোরাফেরার ফাঁকে পর্যটকদের সঙ্গে আলাপ করলেই বিচিত্র চাওয়া-পাওয়ার কথা শোনা যায়। তাঁরা এখানে আরও কটেজ চান, আরও ‘উন্নত’ যোগাযোগব্যবস্থা, নিরাপত্তার জন্য আরও ক্যাম্প তাঁদের দরকার। পূর্ণিমার রাতে বগা লেক ও আশপাশে নিরাপদ বিনোদনের বাড়তি সুযোগ পেতে ইচ্ছুক তাঁরা। গরমেও যাতে এসব স্থানে আরাম করা যায়, সেজন্য ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের ব্যবস্থাও নিশ্চিত দেখতে আগ্রহী।
প্রশাসনও আসন্ন দিনগুলোতে সাধ্যমতো এসব জোগান দিতে ইচ্ছুক। চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধান তাই বেশি নয়। ফলে বগা লেকের মতো পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামই প্রতি মুহূর্তে পাল্টাচ্ছে।
কিন্তু স্থানীয় বগামুখপাড়ার বমদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সামান্যই আর অবশিষ্ট আছে। বমপাড়ার তরুণীরা এই লেকেই গোসল করত একসময়। সেসব বন্ধ হয়েছে বহু কাল। তাদের ঘরদোরের পাশে বেজায় ভিড় লেগে থাকে আজকাল। স্বাভাবিকভাবে চলাফেরাই দায়। বেড়াতে আসা মানুষ বমদের আঙিনায় ঢুকে সেলফিও তুলতে চান। এক মারমা তরুণ ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, ‘পর্যটকদের কাছে আমরা কম-বেশি “সাফারি পার্ক”-এর প্রাণীর মতোই।’
অতীতের নির্জনতা আর অসংখ্য জাতের পাখির কলকাকলি এখানে বেশ দুর্লভ এখন। ২০ বছর আগেও বগা লেকের পথে কমলা বাজার বা রুমা বাজারের ধারেকাছে এত ভিড়, দোকানপাট, হই হট্টগোল, পেট্রল-মবিল-যানবাহন ব্যবসা, প্লাস্টিক আর ময়লা আবর্জনার স্তূপ ছিল না। পাশেই ‘নতুন পাড়া’ নামে যে ত্রিপুরা বসতি ছিল, সেটাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। জেলার বিভিন্ন স্থানে অনেক¤ম্রো পাড়াকেও সরতে হয়েছে পর্যটনকেন্দ্রকে জায়গা করে দিতে। বান্দরবান শহরে যৌন ব্যবসায় স্থানীয় কোনো পাহাড়ি মেয়েকে পাওয়া যাবে, এ-ও এককালে ছিল অবিশ্বাস্য। কিন্তু এসব নিয়েই চারদিকে ক্রমাগত বড় হচ্ছে নতুন এক অর্থনীতি, যে অর্থনীতির বড় অংশ অবশ্যই পাহাড়িদের নিয়ন্ত্রণে নেই।
রুইলুইপাড়ার পাংখোরা কোথায় যায়?
বগা লেকের মতোই খাগড়াছড়ির বড় আকর্ষণ আলুটিলায়ও অনেক নতুন দোকান গড়ে উঠেছে। নিশ্চয়ই এরূপ পসরা আরও বাড়বে আগামী দিনে। সেখানে পর্যটন ‘জোন’ গড়ার কথা ছিল। তাতে জমি হারানোর শঙ্কা থেকে তিন মৌজাজুড়ে স্থানীয় লোকজন আন্দোলনে নেমেছিলেন বিগত সময়ে। ওই জমিতে ফলদ ও ঔষধি বাগান চাইছিলেন তাঁরা। উত্তাল সেই আপত্তিতে প্রকল্পটি আপাতত থেমেছে। তবে পর্যটনের ঢেউ থামেনি।
প্রতিদিন সমতল থেকে অন্তত ২০০ মানুষ বেড়াতে যান খাগড়াছড়ি। শুক্র-শনিবার এই সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে যায়। শীতের ছুটিতে বাস ও হোটেলে ঠাঁই পাওয়াই কঠিন। এই মানুষদের ঘিরে পরিবহন ব্যবসা, হোটেল ব্যবসা ভালোই বিকশিত হয়েছে সেখানে। কিন্তু পাহাড়ে চাকমা ও ত্রিপুরা গ্রামগুলোর নিরুপদ্রব দিনগুলো আর আগের মতো থাকছে না।
বগা লেক ও আলুটিলার চেয়েও শহুরে পর্যটকদের বড় আকর্ষণ এখন রাঙামাটির সাজেক। চাহিদা সামাল দিতে এখানে প্রচুর রিসোর্ট হচ্ছে। অনেক ‘বিনিয়োগকারী’ আসছেন। এখানকার রুইলুইপাড়ার আশপাশে জমির দাম রাঙামাটি শহরের মতোই হয়ে গেছে। সাজেকের এককালের দরিদ্র জুমচাষি ত্রিপুরা আর পাংখোয়াদের এত দামি জমি ধরে রাখা কঠিন। অনেকেই ইতিমধ্যে জমিটি ‘ভালো দামে’ বিনিয়োগকারীদের দিয়ে দিয়েছেন। আশপাশে জুমচাষও আর হওয়ার নয়। পর্যটনের ‘সুপার স্পট’ সাজেকের সৌন্দর্য দেখতে আসা দূর জেলার দুদিনের পর্যটকেরা হয়তো কোনো দিনই জানবেন না সাজেক ইউনিয়নের রুইলুইপাড়া এবং কংলাকপাড়ার পাংখোরা ধীরে ধীরে কমছে কেন; কোথায় যাচ্ছে তারা? এও হয়তো পর্যটন অর্থনীতির জন্য জানা অপ্রাসঙ্গিক, বাংলাদেশে পাংখোয়া আছে মাত্র কয়েক শ পরিবার। আজকে সাজেকে অনেক বিনিয়োগ এলেও এখানকার পানির সংকট মেটাতে অতীতে কোনো বিনিয়োগ পাওয়া যায়নি। ২০১৭ সালেও সাজেকের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে এক দফা খাদ্যাভাবের খবর দেশজুড়ে উৎকণ্ঠা তৈরি করেছিল।
তবে সাজেকের আজকের রিসোর্ট নির্মাণকারীরা অনেকেই পাহাড়ি। রাঙামাটি-খাগড়াছড়ির ধনী মানুষ তাঁরা। এখানকার পর্যটন অর্থনীতিতে ভালো একটা হিস্যা আছে তাঁদের। আগামী দিনে উচ্চ দামে এরাই হয়তো আরও দূরবর্তী বিনিয়োগকারীদের ব্যবসা ছেড়ে দেবেন। সেই লক্ষণও আছে। মুনাফামুখী ব্যবসার এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। পাহাড়ে পাহাড়ে পর্যটনের উত্থানে সাধারণ পাহাড়িরা তাই বেশি উৎসাহী নন। স্থানীয় জেলা পরিষদগুলোও এসব প্রশ্নে কর্তৃত্ব ফলানোর জায়গায় নেই।
অথচ স্থানীয় সরকারকে ব্যবহার করে এবং পর্যটনকে উপলক্ষ করেই সমতল ও পাহাড়ে সুদূরপ্রসারী সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটতে পারে। তার একটা উদাহরণ দিয়ে এ-সম্পর্কিত গবেষক পাভেল পার্থ বললেন, একদল চিকিৎসক যদি কোনো পাহাড়ি গ্রামে বেড়াতে গিয়ে একটি মেডিকেল ক্যাম্পও করেন এবং বিনিময়ে স্থানীয় লোকজন যদি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন, তাহলে মুনাফামুখিতার বিকল্প হিসেবে নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম হতো। দারুণ এই সম্ভাবনাটি শুধু ব্যবসায়ীদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
কতটুকু আড্ডা-উল্লাস-মাস্তি শোভন?
এ প্রশ্নে পর্যটকেরা উদাসীন। যদিও পাহাড়িদের জীবনধারা এবং তাদের পাহাড়ি বসতিই উদীয়মান পর্যটন অর্থনীতির প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু তাঁদের সঙ্গে এর আর্থিক সম্পর্ক গড়ে উঠছে সামান্যই। সাজেকের রিসোর্টগুলো ছাড়া পুরো অঞ্চলের পরিবহন ও হোটেল ব্যবসায় তাঁদের হিস্যা বেশি নয়। উপরন্তু এতে জুমকেন্দ্রিক কৃষি অর্থনীতির উন্নয়নে সবার আগ্রহে ভাটা পড়েছে। সরকারি-বেসরকারি সব চেষ্টা পর্যটনের বিকাশের জন্য। ফেসবুকেও দেখা যায়, হঠাৎ হঠাৎ দৃষ্টিনন্দন স্থান গুহা, ছড়া, ঝরনা ইত্যাদি ‘আবিষ্কার’ হচ্ছে ওখানকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এ রকম আবিষ্কারের পরই সেই ছড়ার পানিতে স্থানীয়দের ব্যবহার কমাতে হয়। পর্যটকদের উপভোগের জন্য তৈরি শুরু হয় সেখানে যাওয়ার নতুন রাস্তা। ‘প্রকল্প’ হিসেবে এসব খুব ভালো। আর রাস্তা মানেই নতুন আরেকটি পরিবহন রুট, যা বহুজনের আয়ের রুটও বটে।
পর্যটকদের প্রাত্যহিক চাহিদার কারণে পাহাড়ে নিত্যপণ্যের বাজারও চড়া থাকে। রাঙামাটির এক সংস্কৃতি গবেষক শুভ্র জ্যোতি চাকমা জানালেন, শীতের মৌসুমে নির্ধারিত আয়ে স্থানীয় অনেকের জন্যই সংসার চালানো দায়। মাছ-মাংসসহ সবকিছুর বাজার থাকে ঊর্ধ্বমুখী। পর্যটকদের উদার মনে খরচপাতি স্থানীয়দের খাবার তালিকা ছোট করতে বাধ্য করে। ব্যবসায়ী তৃতীয় পক্ষ ভালোভাবেই সুযোগটা নেয়।
পর্যটনের মতোই স্থানীয় ব্যবসার নিয়ন্ত্রণও অনেকাংশে এখানে অপাহাড়িদের হাতে। আলীকদম থেকে পানছড়ি পর্যন্ত পাঁচ হাজার বর্গমাইলজুড়েই প্রায় একই পরিস্থিতি। স্থানীয় এই অর্থনীতির সাংস্কৃতিক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বিশেষ মনোযোগ দাবি করে। যেহেতু পর্যটনের নিয়ন্ত্রণ মুখ্যত অন্য জাতিসত্তার হাতে এবং সেখানে যাঁরা আনন্দের খোঁজে যাচ্ছেন, তাঁরাও অন্য জাতির মানুষ; তাই স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধার ঘাটতি ঘটছে। অপর সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক আড়ালের কতটুকুতে নজর দেওয়া যাবে, কতটুকু আড্ডা-উল্লাস-মাস্তি শোভন; প্রকৃতির প্রতি কী পরিমাণ দায়বদ্ধতা জরুরি—এসব বিষয়ে অনেক পর্যটকই উদাসীন। এ পরিস্থিতি পাল্টাতে বিকল্প কোনো পরিকল্পনা ও অনুশীলন নিয়ে ভাবার কেউ আছে বলে মনে হয় না। প্রয়োজনীয় পর্যটন-শিক্ষা না থাকলে কী ঘটে, তার ছোট্ট একটি উদাহরণ দিলেন কাপ্তাই লেকের পাশের বসতির এক বাসিন্দা। জানালেন, শীতে সকাল-সন্ধ্যা পিকনিক পার্টির সাউন্ড সিস্টেমের উল্লাস তাঁদের স্বস্তি কেড়ে নেয়।
তারপরও পর্যটক ছাড়া রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি-বান্দরবানকে এখন আর কল্পনা করা যায় না। বরং পর্যটনের আরও ব্যাপকতার জন্য প্রস্তুত তিন জেলা। অন্য কর্মসংস্থান না পেয়ে একে ঘিরে কিছু করার স্বপ্ন দেখছেন অনেক তরুণ-তরুণী। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, পর্যটনের ‘বিপুল সম্ভাবনা’কে বাস্তব করতে অতীতের মতো আগামী দিনেও পার্বত্য অঞ্চলে প্রচুর প্রকল্প-রাস্তাঘাট-ভবন হবে। এসব কাজের জন্য প্রচুর পাথর তুলতে হবে বিভিন্ন ছড়া ও জলধারা থেকে। নির্বিচারে এসব পাথর উত্তোলনের ফলে ভূমির বিন্যাস পাল্টাবে। ভূমিধসও বাড়তে পারে। কমতে পারে পানির উৎস। এসবের মিলিত ফল হিসেবে অনেক স্থানে বসতি পাল্টে পুরোনো বাসিন্দাদের আরও গহিনে যেতে হবে। এলাকায় আপাতদৃষ্টিতে ক্ষণিকের অতিথি আনন্দপিয়াসী মানুষের আনাগোনা তাতে কমবে না। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয়দের মতামত ও অংশগ্রহণ বাড়িয়ে পুরো পরিস্থিতিকে আরও টেকসই, শোভন ও স্বস্তির করা যেত। বান্দরবানের সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমার মতে, এখানকার প্রকৃতি ও তার সৌন্দর্যকে ঘিরে বাণিজ্যের যে বিস্তার, তাতে স্থানীয় লোকজনের দ্বিধা-সংশয় কাটাতে প্রয়োজন পর্যটন পরিকল্পনায় তাদের পূর্ণ সংশ্লিষ্টতা। তিন জেলায় জনসমাজের কত পরিসর জুড়ে কী ধরনের পর্যটন চলতে পারে, সে বিষয়ে বুদ্ধজ্যোতি চাকমার প্রত্যাশামতো মিলিত সংলাপ আদৌ কি আর সম্ভব হবে এ জনপদে?
আলতাফ পারভেজ: গবেষক