বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের ৫০ শতাংশই স্বামী বা সঙ্গীর কাছে শারীরিক অথবা যৌন নির্যাতনের শিকার হন। আমাদের জাতীয় পর্যায়ের জরিপেও একই ধরনের তথ্য মেলে। এ পরিস্থিতি বদলাতে হলে বহুমাত্রিক উদ্যোগ প্রয়োজন। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, লোকালয়, সমাজ, বিচারব্যবস্থা, রাষ্ট্র, সবারই সক্রিয় উদ্যোগ প্রয়োজন। নির্যাতনের শিকার নারীদের সুরক্ষা দিতে একটি শক্তিশালী আইনি কাঠামোর প্রয়োজনও অনস্বীকার্য।
অনেকের ধারণা, এ বিষয়ে দেশে একাধিক আইন ও নীতিমালা আছে। তাই আইন পরিবর্তন–পরিমার্জনের তেমন প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা। আমার মতে, এ ধারণা কিছুটা ঠিক, পুরোপুরি ঠিক নয়। আসলে আইন যথাযথ নেই, যা আছে তাতেও নারীর সুরক্ষা এবং প্রতিরোধের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় বাদ পড়ে গেছে। আইনগুলোর প্রায়োগিক দিকও অনেকটাই অস্পষ্ট, আইন প্রয়োগের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোও দুর্বল।
বাংলাদেশের ফৌজদারি আইনগুলোতে পারিবারিক নির্যাতনকে কোথাও পৃথক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়নি। ২০১০ সালের পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনের ক্ষেত্রে ফৌজদারি আদালতের এখতিয়ার থাকলেও আইনটিতে মূলত দেওয়ানি প্রকৃতির প্রতিকার দেওয়া হয়েছে। বলা হয়, ২০১০ সালের আইনটি করার অন্যতম উদ্দেশ্য পারিবারিক সম্পর্ক বহাল রেখে নির্যাতনমুক্ত গৃহের পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দেওয়া। সে কারণে নির্যাতনকারীকে অপরাধে দণ্ডিত না করে প্রতিকার হিসেবে নির্যাতনের শিকার নারীকে সুরক্ষা আদেশ, বসবাসের আদেশ, ক্ষতিপূরণ ও সন্তানের নিরাপদ হেফাজতের আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আদালতকে। শুধু সুরক্ষা আদেশের লঙ্ঘন ও মিথ্যা আবেদনের শাস্তি হিসেবে কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে এই আইনে। গৃহে নির্যাতনের শিকার নারীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এ দেওয়ানি প্রতিকারগুলোর যথাযথ প্রয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো নির্যাতিত নারী পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে চাইলে ২০১০ সালের আইনটিতে কোনো প্রতিকার নেই।
সহিংসতার শিকার নারী চাইবেন তাঁর মামলা চলুক বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনালে, কিন্তু আইনগতভাবে তা তিনি করতে পারবেন না। কারণ, সহিংসতার জন্য বিশেষায়িত আইন এবং ট্রাইব্যুনাল থাকলেও পারিবারিক সহিংসতাকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০–এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ আইনের শুধু একটি ধারায় (ধারা ১১) নির্যাতনকারী স্বামী বা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করা সম্ভব। এ ধারায় মামলা করা যাবে শুধু তখনই, যখন যৌতুকের কারণে সাধারণ জখম, মারাত্মক জখম বা মৃত্যু ঘটানো হয়। কখনো কখনো আইনজীবীরাও ভুক্তভোগী নারীকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করার উপদেশ দেন ১১ ধারার অধীনে, সেখানে যৌতুকের দাবি না থাকলেও। এ কারণে অনেক সময় যৌতুকের ধারায় মামলাগুলো মিথ্যা বলে আখ্যায়িত হচ্ছে, কিন্তু সহিংসতার ঘটনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মিথ্যা নয়। অর্থাৎ সহিংসতা দমনের জন্য ২০০০ সালের আইনটি করা হলেও সহিংসতার শিকার নারীদের একটি বড় অংশকেই আইনটি বাদ রেখে দিচ্ছে। বিষয়টি এমন দাঁড়ায় যে পারিবারিক সহিংসতার কারণে যদি একজন নারীর মৃত্যু হয়, তাহলেও আইনগতভাবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করা সম্ভব নয়।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পারিবারিক সহিংসতার মামলা করা যায় না, কিন্তু দণ্ডবিধির অধীনে হত্যা, মারাত্মক জখম, সাধারণ জখম ইত্যাদির মামলা সাধারণ ফৌজদারি আদালতে করা যায়। তবে যৌতুকের কারণে জখমের মামলার ক্ষেত্রে যেমন সাধারণ ফৌজদারি আদালতের তুলনায় একটি বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনালকে যথাযথ বলে মনে করা হয়েছে, একই যুক্তিতে পারিবারিক সহিংসতাকেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন ছিল। যৌতুকের কারণে মৃত্যু ঘটানো বা জখম করা যেমন সাধারণ ফৌজদারি আদালত থেকে সরিয়ে বিশেষায়িত ট্রাইব্যুনালে দেওয়া হয়েছে, তেমনি পারিবারিক সহিংসতাকেও একটি আলাদা অপরাধ হিসেবেই দেখতে হবে। আমাদের দণ্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন—কোনোটিতেই পারিবারিক নির্যাতন আলাদা অপরাধ গণ্য হয় না।
ভারতীয় দণ্ডবিধিতে কিন্তু ১৯৮৩ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে স্বামী বা স্বামীর পরিবারের মাধ্যমে সহিংসতা বা নিষ্ঠুরতাকে আলাদা অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ভারতীয় আদালত বিভিন্ন সময়ে এ ধারার অধীনে শারীরিক নির্যাতন, খাবার দিতে অস্বীকার করা, ঘরের ভেতর তালা দিয়ে রাখা, স্ত্রীকে মানসিক যন্ত্রণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর সামনে সন্তানকে নির্যাতন করা ইত্যাদি অনেক বিষয়কেই নিষ্ঠুরতা হিসেবে দণ্ডনীয় করেছেন।
আমাদের ২০১০ সালের আইনটিতে যেভাবে পারিবারিক সহিংসতাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তাতে তালাকপ্রাপ্ত বা বিধবা নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হলেও তিনি এ আইনে অনেক সময়ই আদালত থেকে প্রতিকার পান না। পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য প্রয়োজনীয় আশ্রয় বা সুরক্ষার ব্যবস্থায়ও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। তবে তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ২০১০ সালের আইনটির প্রয়োগ একেবারেই অবহেলিত। আইনটি যাঁরা প্রয়োগ করবেন, তাঁদের দক্ষতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আইনটি সম্বন্ধে জনসচেতনতা বাড়ানোও খুব জরুরি। পারিবারিক সহিংসতাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবেও দণ্ডনীয় করতে হবে। পারিবারিক সহিংসতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা ও আইনি প্রতিকারকে অর্থবহ করতে হলে অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে এ আইনি কাঠামোরও সংশোধন প্রয়োজন।
তাসলিমা ইয়াসমীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক