রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তাঁর মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে অবৈধভাবে বিভিন্ন পদে জনবল নিয়োগ দিয়েছেন।
আমরা গণমাধ্যম মারফত জানতে পারলাম, এই উপাচার্যকে পুলিশি পাহারায় নিজের অফিস ছাড়তে হয়েছে। কেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পুলিশি পাহারায় নিজের কর্মক্ষেত্র ছাড়তে হচ্ছে?
কারণ, এ নিয়োগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এর মধ্যেই দুটি পক্ষ তৈরি হয়ে গেছে। এক পক্ষ এ নিয়োগকে অবৈধ বলছে। আরেক পক্ষ এ নিয়োগকে বৈধ বলতে চাইছে। এ নিয়ে সেখানে রীতিমতো মারামারি-হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে।
এখন শুনতে পাচ্ছি, বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকদের একটা জোটও তৈরি হয়েছে। এর মানেটা আসলে কী? সেখানে কি দুর্নীতির পক্ষেও কিছু শিক্ষক আছেন? দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমন ঘটনা আজকাল প্রায়ই ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খবরের শিরোনাম হয় উপাচার্যের দুর্নীতি, শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি, টেন্ডার নিয়ে দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে।
এ ধরনের ঘটনাগুলো যখন নিয়মিত ঘটতে থাকে এবং নিয়মিত খবরের শিরোনাম হয়, তখন সমাজে একটা প্রভাব পড়ে। এক ধরনের ন্যারেটিভ কিন্তু তৈরি হতে থাকে। যেমন মানুষ হয়তো ভাবতে শুরু করবে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসলে পড়াশোনা হয় না। জ্ঞানচর্চা হয় না। সেখানে কেবল নানা রকম দুর্নীতিই ঘটে থাকে!।
অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল যেই কাজ, সেই কাজই হয়তো হয় না! আমার তো মনে হয়, সমাজে এমন একটা ধারণা এর মধ্যে তৈরি হয়েই গেছে। এর জন্য বোধ করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের দায়ই সবচেয়ে বেশি।
রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি এবং সেটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রয়োগের যে প্রচলন তাঁরা শুরু করেছেন, সেই ধারা অব্যাহত থাকলে একটা সময় সমাজের মানুষ হয়তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং দুর্নীতি করে চাকরি দেওয়ার কারখানা ভাবতে শুরু করবে!
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি কখনো জ্ঞান–বিজ্ঞান কিংবা আবিষ্কারের জন্য খুব একটা খবরের শিরোনাম হয়? এই যে করোনার সময় আমরা ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির নাম শুনছি। কেন শুনছি? কারণ, তারা একটা টিকা আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত। আমরা আমেরিকার জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনতে পাচ্ছি। কেন পাচ্ছি? কারণ, তারা জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে। পৃথিবীর সব দেশ থেকে আসা তথ্যউপাত্ত নিয়ে কাজ করছে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিকভাবে না হোক, স্থানীয়ভাবে কি এমন কিছু করেছে? জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাদের অবদানটা আসলে কী? অথচ খুব সহজেই দেশের সব কটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র কিন্তু পাল্টে দেওয়া যায়। কোনো কিছু লাগবে না। স্রেফ একটা স্লোগান যদি তারা ধারণা করে এবং সে অনুযায়ী চলে, তাহলে কিন্তু সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। জগতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিন্তু এভাবেই এগোচ্ছে। তো, স্লোগানটি কী? জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষকেরা গবেষণা করে পুরোনো ও নতুন যে জ্ঞান অর্জন করবে, সেই জ্ঞানটুকু শিক্ষকতার মাধ্যমে ছাত্রদের কাছে বিতরণ করবে। এই তো শেষ! এর বাইরে আর কিছু করার তো দরকার নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের শিক্ষকেরা কি আদৌ নিজেরা নতুন নতুন জ্ঞান অর্জন করছেন কিংবা তাঁদের কি সেই জ্ঞান বিতরণের সৎ ইচ্ছা আছে?
জগতের ভালো ভালো সব বিশ্ববিদ্যালয় স্রেফ এই নীতি মেনে চলেই নানা কিছু আবিষ্কার করে ফেলছে।
আর আমাদের উপাচার্য বা শিক্ষকেরা কিনা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বৈধ-অবৈধ উপায়ে চাকরি দেওয়ার কারখানা বানিয়ে ফেলেছেন। এ নিয়েই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খবরের শিরোনাম হচ্ছে। দুই দলে ভাগ হয়ে কেউ নিয়োগ নিয়ে মারামারি করছে, কেউ টেন্ডার নিয়ে হুলুস্থুল বাধিয়ে দিচ্ছে!
জ্ঞান অর্জন ও বিতরণের কোনো সংবাদ তো শুনতে পাই না।
দয়া করে আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চাকরি দেওয়ার কারখানা না বানিয়ে জ্ঞান অর্জন ও বিতরণের কারখানায় পরিণত করুন।
ড. আমিনুল ইসলাম শিক্ষক, এস্তোনিয়া থেকে
[email protected]