দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ পানিবন্দী, ভাসমান লাখো পরিবার। বাঙালিকে এখন কাঁদতে বলা যায়, বলা যায়, ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো।’ কিংবা বলা যায়, এ শুধু জানালার লোভে নষ্ট করলাম ঘর-দরজা। সরকারি উন্নয়নবিদদের চোখে হাওর পর্যটন এলাকা। তাই পর্যটনের সুবিধার জন্য হাওরের বুক চিরে খুব সুন্দর সড়ক তৈরি করা হয়েছে। বাইকার ও গাড়িঅলারা সাঁই সাঁই করে সেসব রাস্তায় ঘুরেছেন আর সুন্দর সুন্দর ছবি তুলেছেন। এখন প্রকৃতি খুব সুন্দর করে তার প্রতিশোধ নিয়েছে। ভুল সড়ক, ভুল বাঁধ আর অবকাঠামো নির্মাণের প্রতিক্রিয়ায় পানি নামতে পারছে না বলে সহনশীল বন্যা দুঃসহ হয়ে উঠেছে।
কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা থেকে শুরু করে সিলেট বেসিন বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ প্লাবনভূমি। এই ভূমি দিয়ে পূর্ব ভারত দিয়ে আসা নদী ও বৃষ্টির ঢল নেমে আসে। বাংলাদেশের অন্যতম এক প্রাণভোমরা এই হাওর। পরিবেশবিজ্ঞানী ও ভূতত্ত্ববিদ ড. খালেকুজ্জামানের ভাষায়, ‘হাওর ১৪০ প্রজাতির মাছের প্রজননক্ষেত্র; ২০৬ প্রজাতির পাখি, ২০০ প্রজাতির গাছ, ৩৪ প্রজাতির রেপটাইল এবং ৩১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর বাস এই হাওরে। হাওরের জীববৈচিত্র্যের তুলনা একমাত্র সুন্দরবন।
প্রতিবছর ৬০ হাজারের বেশি পরিযায়ী পাখি হাওরে অস্থায়ী আবাস গড়ে তোলে। সুন্দরবনের মতোই টাঙ্গুয়ার হাওর ইউনেসকোর গুরুত্বপূর্ণ রামসার সাইট আর হাকালুকি হাওরটি এখন রামসার সাইট হিসেবে বিবেচনাধীন। বাংলাদেশের মোট ধান উৎপাদনের ১৬ শতাংশই হাওর অঞ্চল থেকে আসে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তার বড় অংশীদার হাওর অঞ্চল। হাওরের ভূমি দেশের ভূগর্ভস্থ পানির বড় আধার।
হাওরের জলাভূমির মাটি ধরন এবং জলজ উদ্ভিদের প্রাবল্যের কারণে তা বন্যার প্রবণতা হ্রাসে সহায়তা করে এবং রাসায়নিক দূষণ শুষে নেওয়ার ক্ষেত্রেও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া ইতিহাসের বিবেচনায় এটাও সুবিদিত যে হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং অবারিত খোলা প্রান্তর মানুষের আত্মিক ও মননশীল জীবন গঠন এবং সংস্কৃতিচর্চায় ঐতিহ্যবাহী ভূমিকা পালন করে আসছে।’ (দেশ রূপান্তর, ২২ এপ্রিল, ২০২২)
দেশ ভরে গেছে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় পৌর্তিক কাজ দিয়ে। ভারতীয় নদীবিশেষজ্ঞ প্রশান্ত মহলানবীশ সেই ১৯২৭ সালেই বলেছিলেন, বাঁধের ফলাফল হিসেবে তলানি জমে নদীতল ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসবে। উন্নয়নবাদীরা শোনেননি।
এই ভূমিতে যত হাজার কোটি টাকার উন্নয়নই ঢালা হোক, তা হয় নিজে ভেসে যাবে, নাহয় লাখো মানুষকে ভাসাবে। সেটাই হয়েছে। কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলায় ৮৭৪ দশমিক ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সড়কের কারণে ঢলের পানি হাওর থেকে নদীতে নামতে বাধা পাচ্ছে। জলাবদ্ধতায় সড়কের দুপাশে ধানখেত ডুবে থাকছে। এ পানিতে ধান পচে যায়।
পরিবেশবিজ্ঞানী ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার লক হ্যাভেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণের আগে যথাযথ পরিবেশগত সমীক্ষা চালানো হয়নি। তিনি বলেন, ‘হাওরের বৈশিষ্ট্য হলো, জলের অবাধ প্রবাহ। আমি প্রস্তাব করেছিলাম, সড়ক যদি নির্মাণ করতেই হয়, তাহলে যেন ৩০ কিলোমিটারের এই সড়কের অন্তত ৩০ ভাগ জায়গা উঁচু সেতু বা উড়াল সড়ক আকারে বানিয়ে পানি প্রবাহের সুযোগ রাখা হয়।’ (সূত্র: পূর্বোক্ত)
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়েছে উজানে ভারতের তৈরি অজস্র বাঁধ-জলাধার, অজস্র ব্যারাজ, জলবিদ্যুৎকেন্দ্র ও জলকাঠামো। এসবের কারণে নদী আর পলি বইতে পারছে না। পলি বইতে না পারলে পানিও বওয়া কঠিন হয় নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যাওয়ায়। ফলে নদী পানি উগরে দিচ্ছে, অস্বাভাবিক বন্যা হচ্ছে। অবস্থা হয়েছে এমন, ভারতের উজানে বন্যা ১০ দিন চললে বাংলাদেশে চলে মাসের বেশি দিন। পানি নামার পথে উন্নয়নের অনেক বাধা যে!
এই ভুলের শুরু ব্রিটিশ আমলে। আমাদের নদীগুলো উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত। সেসবকে হাজারো জায়গায় কাটাকুটি করে গেছে পূর্ব-পশ্চিমগামী রেললাইন। ফলে, বন্যার পানি বয়ে যাওয়ার প্লাবনভূমিতে উঁচু রেলবাঁধ পড়েছে। এভাবে নদীশাসনের নামে নদীর গতি নষ্ট করে সৌভাগ্যের জননীকে পরিণত করা হয় দুর্যোগের ডাকিনীতে। ব্রিটিশ নদীপ্রকৌশলী স্যার উইলিয়াম উইলকক্স ১৯২৮ সালে দেওয়া এক বক্তৃতায় অভিযোগ করেন, ‘ইংরেজ আমলের গোড়াতেই সনাতন খালব্যবস্থাগুলোকে কাজে লাগানো ও সংস্কার তো করাই হয়নি, বরং রেলপথের জন্য তৈরি বাঁধের মাধ্যমে এগুলো ধ্বংস করা হয়েছে।’
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জি থমসনও হিন্দু ও মুসলিম যুগের নদীব্যবস্থাপনা ধ্বংসকেই বাংলার কৃষি ও জলদেহকে বিপর্যস্ত করার দায় দিয়েছেন। তাতে মাটি অনুর্বর হয়েছে, মাছের আধার ধ্বংস হয়েছে, ম্যালেরিয়া মহামারি আকার পেয়েছিল এবং নদী স্ফীতিজনিত চাপে নদীর পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশ ভরে গেছে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় পৌর্তিক কাজ দিয়ে। ভারতীয় নদীবিশেষজ্ঞ প্রশান্ত মহলানবীশ সেই ১৯২৭ সালেই বলেছিলেন, বাঁধের ফলাফল হিসেবে তলানি জমে নদীতল ধীরে ধীরে ওপরে উঠে আসবে। উন্নয়নবাদীরা শোনেননি।
সে সময়ের এক বড় বন্যা ছিল ১৯৪৩ সালের দামোদরের বন্যা। পবন দাস বাউলের গাওয়া বিখ্যাত গান, ‘বসুন্ধরার বুকে বরষারই ধারা, তারা ভরা হাহাকার’ সে বন্যা নিয়েই তৈরি করেছিলেন কোনো অজ্ঞাত শিল্পী। ওই সময় ‘ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান’ লিখেছিল, ‘বন্যার জন্য দায়ী নদ-নদী নয়, অতিবৃষ্টি নয়, দায়ী ব্রিটিশের তৈরি রেলপথ’। গানের মধ্যেও রয়েছে সেই ফরিয়াদ—
তেরো শ পঁচাশি সালে দামোদরের বাঁধ
ভেঙে পড়ে…
বান উঠল ভাই ঘরে ঘরে
দেওয়ালচাপা মানুষ মরে
বালক ছেলে কোলে করে
স্কুলে পলাই…
ষোলো ক্রোশজুড়ে লুহার খুঁটি মেরে
ষোলো ক্রোশজুড়ে লুহার খুঁটি মেরে
জলকে রেখেছে ঘেরে
বসুন্ধরার বুকে বরষারি ধারা
তারা ভরা হাহাকার
জলকে বাঁধ দিয়ে ঘিরে রাখা এবং সেই বাঁধ ভেঙে পড়ার ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে নিন হাওরে সড়ক নির্মাণ করার ঘটনাকে। এখন সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, বন্যার পানি নামাতে প্রয়োজনে সড়ক কেটে দিন। কাটবেনই যদি তবে বানিয়েছিলেন কেন? বানালেনই যদি তবে ঘন ঘন কালভার্ট করেননি কেন?
২০১৭ সালে হাওরের বাঁধ ভেঙে পড়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ইঁদুরকে দায়ী করেছিল। অথচ সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল পাউবোর অনিয়ম আর ঠিকাদারদের দুর্নীতির কথা। স্থানীয় যুবলীগ নেতা এক ঠিকাদারকে আটকও করা হয়েছিল বিমানবন্দর থেকে। এবার সব নিশ্চুপ। শুধু আসামের বৃষ্টিকে দুষলে হবে না, গত এক যুগে হাওর ও সিলেটের জলপ্রবাহের ওপর কী কী অনাচার করা হয়েছ, তার তালিকা বের করতে হবে। দায়ীদের এবং তাদের ভুল উন্নয়ন দর্শনকে একসঙ্গে পরিত্যাগ করতে হবে।
ঠিক; এখন ত্রাণের সময়, উদ্ধারের সময়। উদ্ধারকাজে নৌকা মিলছে না, যে দেশে-বিদেশে সাঁতার শিখতে, স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার বসানো দেখতে, সাক্ষাৎকার নেওয়া শিখতে এমনকি চাদর কেনাকাটা করতেও বিদেশ সফরে শত শত কোটি টাকা অপচয় হয়, সেখানে ত্রাণের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ থাকবে না কেন? কেন স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গেয়ে ত্রাণ ভিক্ষা করতে হবে? কোন সাহসে সিলেটের নৌকার মালিকেরা দুর্গত মানুষকে জিম্মি করে ২০০ টাকার নৌকাভাড়া ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন? না দিলে অন্তঃসত্ত্বা নারীকে ফেলে যান? এসব মাঝিদের কাজ নয়, নৌকার মালিকদের কারসাজি। মালিকেরা এমনই হয়, দুর্যোগ তাঁদের আরও বড় মালিক বানায়। সিলেট ও হাওরাঞ্চলের সব নৌকা চালকসমেত ন্যায্য ভাড়ায় রিকুইজিশনে নিয়ে নিন। ভাড়া দেবে সরকার, বাঁচাবে মানুষ, ব্যবস্থাপনায় সেনাবাহিনী।
এটা আত্মসমালোচনারও সময়। এখনই যদি আমরা দোষ ও দোষীদের চিনতে না পারি, শীতকালে তো সব ভুলে যাব। ন্যায়ের কথা ও দায়ের কথা বলার এটাই সময়।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক।
[email protected]