পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত লেখক শ্রীমণিশংকর চ্যাটার্জি (শংকর) একদা কৌতুকচ্ছলে লিখেছিলেন, ‘আমাদের কলকাতায় প্রচুর মুখার্জি আছে, চ্যাটার্জি আছে, ব্যানার্জি আছে; কিন্তু কোনো এনার্জি নেই।’ তাঁর অনুসরণে বলা যেতে পারে—আমাদের ঢাকায় বনেদি-বেবনেদি এলাকানির্বিশেষে সেলুন আছে, বেলুন আছে, লন্ড্রি আছে, ফাউন্ড্রি (ঢালাইয়ের কারখানা) আছে; বিদ্যালয় আছে, চিকিৎসালয় আছে; বিফ-বার্গার আছে, ঔষধাগার আছে, কিন্তু (অতীব দুঃখের বিষয়) কোনো পাবলিক পাঠাগার নেই। সাম্প্রতিক মার্কিন মুলুক সফরকালে ব্যাপারটা প্রায়ই আমার মনের কোণে উঁকিঝুঁকি মারত।
তা আমি ‘পাঠাগার’ শব্দই–বা ব্যবহার করছি কেন? তৎপরিবর্তে লাইব্রেরি শব্দ তো অধিকতর সুপরিচিত আর শোনায়ও সুন্দর। আমাদের দেশের এক লোক কলকাতায় গিয়ে সবজির দোকানে ‘বাইগন দাও’ বলতেই ‘ঘটি’ দোকানদার বলে উঠল, ‘বাইগন বলছ কেন? বেগুন বলো। সেটা সুন্দর শোনায়।’ বাঙাল তখন খেপে গিয়ে বলেছিল, ‘সুন্দরই যখন শুনবার চাও তখন “প্রাণেশ্বরী” বললেই পারো, আরও বেশি সুন্দর শোনাইব।’ বাঙালির রসবোধের প্রশংসা করতেই হয়!
সে যা হোক। নিউইয়র্ক নগরী যে পাঁচটি ‘বরো’ তথা অঞ্চলে বিভক্ত, তার প্রতিটিতেই প্রায় হাঁটা দূরত্বে একাধিক পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত, যদিও ওখানে হেঁটে চলাফেরা করে খুব কম লোকই। তো ব্রঙ্কস বরোর বৃহৎ পাবলিক লাইব্রেরিতে পত্রিকা পড়তে গিয়ে বেশ খানিকটা হোঁচট খেতে হলো—পত্রিকাগুলো টেবিলের ওপর রাখা নেই, সহকারী লাইব্রেরিয়ানের ড্রয়ারে। ওঁর কাছ থেকে পাঠান্তে ফেরত প্রদানের নির্দেশনাসহ পত্রিকার প্রাপ্তি ঘটল। আমার উৎসুক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, ‘টেবিলে রাখলে না বলে নিয়ে চলে যায় যে।’ এবার আমার বিস্মিত হওয়ার পালা। আমেরিকার মতো জায়গায়, যেখানে একটা দৈনিকের দাম ৫০ সেন্ট থেকে বড়জোর ২ ডলার, সেখানে যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, সেটা স্বকর্ণে ঘোড়ার মুখ থেকে না শুনলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো বৈকি।
কিন্তু আরও বিস্ময় বুঝিবা অপেক্ষায় ছিল। ওখানকার পাবলিক লাইব্রেরিগুলোতে স্বভাবতই শতকরা ৯০ ভাগ বই থাকে ইংরেজি ভাষার, অবশিষ্ট ১০ ভাগ থাকে পৃথিবীর অন্যান্য প্রধান কয়েকটি ভাষার। বাংলা ভাষারও একটা সেকশন আছে। তো কুইন্স বরোর বৃহৎ পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখা গেল, বাংলা সেকশনে উভয় বাংলার শখানেক বইয়ের মাঝখানে এই ক্ষুদ্র লেখকের একখানা কেতাবও সগৌরবে বিরাজ করছে। ইংরেজি ভাষায় একটা কথা আছে, ‘নো ম্যান ইজ আ হিরো টু হিজ ওয়াইফ’—কোনো পুরুষই তার স্ত্রীর কাছে হিরো নয়। জনৈক বিখ্যাত লেখকের স্ত্রীকে নাকি জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তাঁর স্বামীর কোন বইটি তাঁর সবচেয়ে ভালো লাগে; তদুত্তরে তিনি জানালেন, ‘ওঁর চেক বইটি।’ আমি তাই অতঃপর সফরসঙ্গিনী সহধর্মিণীকে উপহাসচ্ছলে বললাম, ‘দেখো গিন্নি, তুমি ও তোমার সরকার আমার তিন দশকের সাহিত্য-সাধনার প্রকৃত মূল্যায়ন না করলেও মার্কিন সরকার কিন্তু ঠিকই করেছে, ওদের লাইব্রেরিতে আমার বই রেখেছে।’ আসলে বন্যার তোড়ে বৃক্ষরাজির সঙ্গে খড়কুটোও ভেসে আসে।
ফিরে আসি ঢাকায় অঞ্চলভিত্তিক পাবলিক লাইব্রেরির ব্যাপারটায়। পাবলিক লাইব্রেরিটা হাঁটা দূরত্বে হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। আমাদের ঢাকায় শাহবাগের কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরিতে নিয়মিত যাতায়াত ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। আর কষ্ট করে ওখানে পৌঁছালেও যে বসার জায়গা ও যথাস্থানে ঈপ্সিত বই পাবেন, সে ব্যাপারে আপনাকে কোনো গ্যারান্টি দিতে পারছি না। সচিবালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পিএসসিসহ প্রায় সব সরকারি দপ্তরে ছোট-বড় লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত আছে। কিন্তু ওগুলোতে ম্যাঙ্গো-পাবলিক তথা আমজনতার প্রবেশাধিকার নেই; আর যাঁদের জন্য লাইব্রেরি, তাঁরা কদাচিৎ ওখানে পদধূলি দেন। আমার ইচ্ছে হয় বলি, ওগুলোকে বাইরে বের করে নিয়ে এলে প্রায় নিখরচায় অঞ্চলভিত্তিক পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিষ্ঠা হয়ে যেত এবং বিমুক্ত জায়গাগুলো অফিসের অন্যান্য কাজে লাগত। কিন্তু জানি, এবংবিধ প্রস্তাব সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের ভাষায় বন্ধ্যাগমনের ন্যায় নিষ্ফল হবে।
বাকি রইল ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। পৃথিবীখ্যাত নাট্যকার হেনরিক ইবসেন যথার্থই বলেছেন, ‘যাঁর বাড়িতে একটি লাইব্রেরি আছে, মানসিক ঐশ্বর্যের দিক দিয়ে সে অনেক বড়।’ স্রষ্টার কৃপায় বর্তমানে এ দেশে বিত্তশালী লোকের অভাব নেই। কিন্তু ব্যক্তিগত লাইব্রেরির ব্যাপারে তাঁদের অধিকাংশের জীবনে বোধ করি মুজতবা আলী সাহেবের গল্পটিই প্রযোজ্য: নব্য ধনীর স্ত্রী বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে স্বামীর জন্য একটি উপহার কিনতে গেছেন। সেলসম্যান এটা দেখায়, ওটা দেখায়, কিছুই তাঁর পছন্দ হয় না, সবই তাঁর স্বামীর আছে। অবশেষে সেলসম্যান বইয়ের কথা বলতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘বইও ওঁর একটা আছে।’
তা কম্পিউটারের কল্যাণে আমেরিকায় বহু বইয়ের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। চেইন বুকস শপ ‘বর্ডারস’ তো গেছেই, ‘বার্নস অ্যান্ড নোবল’ও যাওয়ার পথে। তবে যে শাখাগুলো আছে, সেগুলোর অধিকাংশেই গ্রাহক যতক্ষণ খুশি বসে থেকে বই পড়তে ও ভিডিও দেখতে পারেন, চাই তিনি বই প্রভৃতি কিনুন আর না কিনুন। বিলেতের বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘ফয়েলস’-এও দেখেছি অবস্থা তদ্রূপ। অথচ আমাদের এখানকার যত্রতত্র ‘লাইব্রেরি’ নামধারী বইয়ের দোকানগুলোতে তেমন ব্যবস্থা নেই। ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়কে কিছুদিন ‘এটসেটরা’ (etc) নামে এরূপ একটা দোকান চলেছিল, ওখানে মাঝেমধ্যে গিয়ে বই পড়া ও বই কেনা হতো। বোধ করি লাভজনক হয়নি বিধায় ওটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, আমরা আর্থিক লাভটাকেই সর্বাগ্রে বিবেচনায় রাখি কিনা।
যাকগে। শেষ করছি লাইব্রেরি-সংশ্লিষ্ট একটি চুটকিলা দিয়ে—গভীর রাতে একজন লাইব্রেরিয়ান যখন নিদ্রামগ্ন, তখন তাঁর কাছে একটা টেলিফোন এল। টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘লাইব্রেরি কখন খোলে?’ প্রত্যুত্তরে তিনি বিরক্তিসহকারে বললেন, ‘সকাল ১০টায়। কিন্তু এত গভীর রাতে আমাকে এই প্রশ্ন করার মানে কী?’
‘১০টার আগে খুলবেন না?’ প্রশ্নকারী হতাশ কণ্ঠে পুনরায় প্রশ্ন করলেন। ‘কিছুতেই না,’ তিনি বললেন, ‘কিন্তু আপনি ১০টার আগে কেন লাইব্রেরির ভেতরে যেতে চান?’
‘আমি ভেতরে যেতে চাই না,’ প্রশ্নকারী এবারে বললেন, ‘আমি বাহির হতে চাই।’ পুনশ্চ: মরুভূমিতে মরূদ্যানের মতো আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সাহেবের ভ্রাম্যমাণ পাবলিক লাইব্রেরির কার্যক্রম নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷