পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর বিতর্কিত 'বিজয়'
রাজনীতিতে সমরবিদদের প্রভাবে যে সংস্কৃতি তৈরি হয়, পাকিস্তান তার মডেলতুল্য। জেনারেল পারভেজ মোশাররফকে এই সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক এক চরিত্র বলা যায়। বহুদিন সেনাপতি হিসেবে নেই তিনি। নেই রাজনৈতিক ক্ষমতায়ও। কিন্তু ঘুরেফিরে জীবন্ত আছেন।
সম্প্রতি আবার তুমুল আলোচিত মোশাররফ। ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। চার সপ্তাহ না পেরোতেই ১৩ জানুয়ারি আরেক আদালত তা বাতিল করেছেন। কেবল মৃত্যুদণ্ড বাতিল নয়, ওই রায় দেওয়া ট্রাইব্যুনালকে ‘অসাংবিধানিক’ও বলে দিয়েছেন দ্বিতীয় আদালত।
ক্ষমতায় না থেকেও বিশ্বের অনেক সমাজে ‘জেনারেল’রা কতটা শক্তি নিয়ে বাঁচেন, এ যেন তার প্রবল সাক্ষী। প্রায় ও রকম জীবন কাটিয়ে গেছেন বাংলাদেশের জেনারেল এরশাদও। ক্ষমতাচ্যুত হলেও ৪৩টি মামলার দীর্ঘ তালিকা মোকাবিলা করে কারাগারের বাইরে ৯০ বছর বয়স শেষে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে তাঁর। বহুল আলোচিত মঞ্জুর হত্যা মামলায় বিভিন্ন সময় ২৩ বার বিচারক বদল হয়েছেন। রায় শুনতে হয়নি বাংলাদেশের এই প্রয়াত রাষ্ট্রপতিকে।
বয়সের হিসাবে পারভেজ মোশাররফ জেনারেল এরশাদের চেয়ে ১৩ বছরের ছোট। সামরিক পেশায় ছোট ১০ বছর। একদা একই সেনাবাহিনীতে ছিলেন উভয়ে। তাঁদের জীবন ইতিহাসে আরও কিছু মিল রেখেছে নিয়তি। উভয়ের জন্ম আজকের ভারতীয় সীমানায় কিন্তু দুজনই ১৯৪৭-পরবর্তী অপর সীমানায় নিজ নিজ দেশে ‘দশম প্রেসিডেন্ট’ ছিলেন এবং ক্ষমতা ছাড়ার পরও সামরিক শাসনবিরোধী রাজনীতির কাছে বেশ প্রাসঙ্গিক থাকতে পেরেছেন। মোশাররফ যেন পাকিস্তানে জেনারেল এরশাদের ছায়া।
নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগ নামের একটা দলের প্রধান হলেও ৭৭ বয়সী জেনারেল মোশাররফ চার বছর ধরে থাকেন দুবাইয়ে। দেশ ছেড়ে ২০০৮-এ প্রথম পাড়ি জমান লন্ডনে। সেখানেই তাঁর ওই দলের জন্ম ২০১০ সালে। প্রতিষ্ঠাতার মতোই দলটিও টানাপোড়েনে আছে এ মুহূর্তে। করাচিতে এই দলের কিছু জনভিত্তি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তবে সর্বশেষ নির্বাচনে ৪৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে কোনো প্রতিনিধি পাঠাতে পারেনি তারা। নীরবে তারা ইমরান খানের দল পিটিআইকে সমর্থন দিয়েছে। এটা অস্বাভাবিক নয়। এই দল গঠন দেশদ্রোহের মামলা এবং বেনজির ভুট্টো হত্যা মামলা থেকে নিজেকে বাঁচাতে মোশাররফের সামনে নির্বাচন দর-কষাকষির একটা উপলক্ষ ছিল মাত্র। তাঁর পক্ষে দেশের ভেতরে রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন সহজ নয়। পেশোয়ার হাইকোর্টের এক রায়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুপযুক্ত তিনি। তবে মোশাররফ হাল ছাড়েননি। যেহেতু তাঁর দেশের রাজনৈতিক ভাঙাগড়ায় সশস্ত্র বাহিনীর গভীর প্রভাব কাজ করে, সে কারণে মোশাররফকে যেকোনো সময়ই প্রয়োজন হতে পারে ‘এস্টাবলিশমেন্ট’-এর।
সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করে মোশাররফ গদি দখল করেছিলেন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ১৯৯৯-এ নওয়াজই তাঁকে সেনাপতি হিসেবে বাছাই করেছিলেন। ইতিহাসের এ রকম কৌতুক দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য দেশেও আছে। প্রায় আট বছর পর আইনজীবী ও বিচারপতিদের সমর্থন নিয়ে নওয়াজ ও ভুট্টোদের দল তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম হয়।
ক্ষমতা ছাড়লেও মোশাররফ ভালোভাবেই জানতেন, সেনাবাহিনীর কারণে পিপলস পার্টি বা নওয়াজ শরিফের দল তাঁকে কারাগারে ঢোকাতে পারবে না। তাঁর হিসাব ঠিকই ছিল। তবে ২০১৩-তে নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় থেকে মোশাররফের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে জরুরি অবস্থা জারির জন্য মামলা করেন। তবে সেনাবাহিনীর ভয়ে নওয়াজের দল সেই মামলার ফয়সালায় আন্তরিক ছিল কমই।
পাকিস্তানে বেসামরিক পরিসরে সেনাপ্রভাব কিছুটা আড়াল হলেও আগের চেয়ে সামান্যই কমেছে। তার পরও সাবেক প্রধানের মৃত্যুদণ্ডের রায় হতে পারল। স্বভাবত দুবাইয়ে বসে চমকে উঠেছিলেন মোশাররফ। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের জন্যও এ রকম রূঢ় রায় ছিল বড় বিস্ময়কর।
আইনের ‘দম্ভে’ পাকিস্তানবাসী বিস্মিত
১৭ ডিসেম্বরের রায়ে মোশাররফ মৃত্যুদণ্ডে অভিযুক্ত হন মূলত সংবিধান স্থগিত করে জরুরি অবস্থা জারির কারণে। সংবিধানের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদেই এরূপ শাস্তির উল্লেখ আছে। আইনগতভাবে এই রায় অস্বাভাবিক ছিল না। যা অস্বাভাবিক ছিল তা হলো, পাকিস্তানে কোনো জেনারেলের বিরুদ্ধে এ রকম রায় হওয়া। বিচারপতিদের ভাষা ছিল খুবই আক্রমণাত্মক। তাঁরা মৃত্যুদণ্ড শেষে মোশাররফের ‘নিথর দেহ ইসলামাবাদের কেন্দ্রস্থলে তিন দিন ঝুলিয়ে রাখা’র জন্য বলেছিলেন। দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এ রকম কিছু শোনা অসহনীয়। ফলে তাদের হয়ে প্রচারমাধ্যমে রায়ের ভাষা ও অভিপ্রায় নিয়ে ব্যাপক হইচই হয়, আপত্তি ওঠে। সর্বগ্রাসী সমর সংস্কৃতির মাঝে আইনের এই ‘দম্ভে’ সাধারণ পাকিস্তানিরাও হতবাক হয়েছে।
মৃত্যুদণ্ডের রায়ে মোশাররফের পূর্বতন প্রতিষ্ঠান এতটাই ক্ষুব্ধ হয় যে, ১৯ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন ডেকে তারা রায়ের বিরোধিতার কথা জানায়। সংবাদ সম্মেলনে সেনা মুখপাত্র জেনারেল আসিফ গফুর বলেন, যে ভাষায় মোশাররফের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে মানবতা ও ধর্মীয় বিবেচনায় ‘সীমালঙ্ঘন’ হয়েছে।
এর আগে ১৭ ডিসেম্বর তাৎক্ষণিকভাবে রায় সম্পর্কে একটা বিবৃতিও দেওয়া হয় সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে। সেখানে উল্লেখ ছিল,Ñ‘রায়ে সেনাবাহিনী ব্যথিত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ’। খোদ সেনাপ্রধান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে দ্রুত কথা বলেন। কোনো দেশের বিচার আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর সরাসরি এ রকম বিরোধিতার নজির বিশ্বে বিরল। কিন্তু পাকিস্তানিরা এতে আশ্চর্য হয় না।
সেনাবাহিনীর তুমুল বিরোধিতা প্রায় তাৎক্ষণিকভাবেই প্রত্যাশিত ফল বয়ে আনে। ২৬ দিনের মাথায় লাহোর হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করে দিয়েছেন। ইমরান খান সরকার হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে এতে। প্রথম থেকে তারা এই মামলার রায় বিলম্বিত করার চেষ্টা করলেও দেশটির উচ্চ আদালতকে পূর্ণ প্রভাবিত করা সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
মৃত্যুদণ্ড বাতিল হওয়ায় জেনারেল মোশাররফ কার্যত এখন কালিমামুক্ত এক ব্যক্তিতে পরিণত হয়ে গেলেন। মাত্র এক মাসে তাঁর রাজনৈতিক ভাগ্য আমূল বদলে গেছে বলা যায়।
নাজুক গণতন্ত্রের দৈন্য দশা
পাকিস্তানে বিগত দশকে কয়েকটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু দেশটিতে এখনো রাজনীতিবিদদের কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়নি। আগের মতোই সামরিক আমলাতন্ত্র প্রভাবের জায়গা ধরে রেখেছে অনেকখানি। তবে উচ্চ আদালতকে সেখানে অনেক স্বাধীনচেতা ভূমিকায় দেখা যায় অনেক সময়। আবার আদালত ও সেনা আমলাতন্ত্র যখন কোনো রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে হাত মিলিয়ে ফেলে, তখন কী ঘটে তার বড় নজির নওয়াজ শরিফের ভাগ্য বিপর্যয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্ববিরোধী এক সৌন্দর্য হলো এর উচ্চ আদালত এমন অনেক সাহসী বিচারপতির জন্ম দিয়ে চলেছে যাঁরা সামরিক আমলাতন্ত্রকে অনেক সময় চ্যালেঞ্জ করে বসেন। হঠাৎ হঠাৎ সেখানে এমন সব রায় হয়ে যায়, যা শক্তিমান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের জন্য দুঃস্বপ্ন তৈরি করে। গত নভেম্বরে সেনাপ্রধান কামার জাভেদের চাকরির মেয়াদ নতুন করে বাড়ানোকে বেআইনি ঘোষণা করেন সর্বোচ্চ আদালত। প্রধান বিচারপতির তরফ থেকে এটা ছিল অভাবনীয় এক রায়। ইমরান সরকার বহু কষ্টে সেই বিপর্যয়ের সুরাহা করেছে।
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বরের রায়ও তেমনি একটি ঘটনা। মোশাররফকে মৃত্যুদণ্ড ছিল শক্তিশালী সামরিক আমলাতন্ত্রের সর্বগ্রাসী কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিচারালয়ের বিরক্তিরই প্রকাশ। হয়তো একটা সতর্কবার্তাও। সামরিক আমলাতন্ত্র অবশ্য দ্রুততম সময়ে বিচারপতিদের বাউন্ডারির উত্তর দিয়েছে ছক্কা হাঁকিয়ে। পুরো পরিস্থিতি নবীন গণতন্ত্রের চরম নাজুকতাও প্রকাশ করছে। রাজনীতিতে এসে ইমরান খান নিজেও জেনারেল মোশাররফের সংবিধান স্থগিত করার বিরোধী ছিলেন একদা।Ñএখন তাঁকে মোশাররফের শারীরিক ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়তা করতে হচ্ছে। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ট্রাইব্যুনালের এই মামলা থেকে মাত্র এক মাস আগেই সরকার তার আইনজীবীদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
রাজনীতির এ রকম দ্বিচারিতা রুখতে পারে কেবল সচেতন জনগণ, আদালত নন। দক্ষিণ এশিয়ায় সে রকম জনশক্তির ঘাটতি আছে। ১৯৯০-এ গণ-আন্দোলন শেষে বাংলাদেশও একই অভিজ্ঞতায় পড়েছিল। রাজনীতিতে অরাজনৈতিক কর্তৃত্বের দায় তাই শেষ বিচারের জনগণের ওপরই বর্তায়।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক