পাকিস্তানে ক্ষমতার পালাবদলের পর শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতেও বেশ বড় ধরনেরই ওলট-পালট হলো। কিন্তু দুই দেশেই কি শেষ পর্যন্ত জনগণের সরকার ক্ষমতায় এল? আসেনি। আসার কথাও ছিল না। যদিও দুটি দেশে সমস্যার প্রকৃতি ও ধরন একই রকমের ছিল। মূলত অর্থনৈতিক সমস্যা, অব্যবস্থাপনা ও সংকটের কারণেই দেশ দুটিতে সরকারকে সরে যেতে হয়েছে। পাকিস্তানে ওই অর্থে জনবিক্ষোভ হয়নি ইমরান খানের সরকারের বিরুদ্ধে; বরং ইমরান খানের পক্ষে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে একযোগে বড় বড় বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু তার আগেই অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে বিরোধী দল ইমরানের সরকারকে সরিয়ে দিয়েছে।
মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে আস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত করার শক্তি শ্রীলঙ্কার বিরোধী দলের পার্লামেন্টে ছিল না। তাই শ্রীলঙ্কায় ভিন্ন কায়দায় সরকারের পরিবর্তন করা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে ইমরানের মতো মাহিন্দা অভিযোগ করতে পারেননি যে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমারা ষড়যন্ত্র করেছে; বরং শ্রীলঙ্কায় রাজপথে বিক্ষোভ হয়েছে। সহিংসতা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার সরকারবিরোধী বিক্ষোভে আগুন, হত্যা, রক্তপাত সবই ছিল। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল যে গণপিটুনিতে একজন সংসদ সদস্য নিহত হয়েছেন। মাহিন্দা রাজাপক্ষের সমর্থকদের বিরোধীরা ধাওয়া দিয়ে রাজপথ থেকে হটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার নতুন প্রধানমন্ত্রী রাতারাতি সমস্যার সমাধান করতে পারবে না।
ইমরান খান ও মাহিন্দা রাজপক্ষের পতন রাজনীতিবিদ, বিশেষ করে আমাদের মতো আধাআধি মার্কা দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক শিক্ষা। আধাআধি বললাম এ জন্য যে এই দেশগুলোতে সবকিছুই আধাআধি করে আছে। এই দেশগুলোকে পুরোপুরি গণতান্ত্রিকও বলা যাবে না, আবার পুরোপুরি কর্তৃত্ববাদী, ফ্যাসিস্টও বলা যায় না। নির্বাচনী একটা ব্যবস্থা আছে। নিয়মিত নির্বাচনও হয়, কিন্তু সেই নির্বাচনের প্রতি অধিকাংশ সময় জনসাধারণের আস্থা থাকে না। বিদেশি শক্তি, সামরিক শক্তিসহ নানা শক্তি ও অংশের প্রভাব থাকে নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারণে।
এই আধাআধি ধরনের দেশগুলোর বড় বিপদ হচ্ছে, তাদের গণতন্ত্র নিয়ে নানা ধরনের খেলাধুলা চলে। কারণ, সরকারগুলো জনসাধারণের মন জয় করার থেকে ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখতে বেশি মনোযোগী হয়। সে কারণে সরকারগুলো জনসাধারণের সমস্যা সমাধানে খুব বেশি মনোযোগী থাকে না; বরং বিদেশিদের সঙ্গে আঁতাত, সুসম্পর্ক বজায় রাখা, বেশি করে বিদেশি ঋণ ও অনুদান আনা এবং নিজেকে আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা এসব দেশের শাসকদের মধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান।
কোনো শাসক যখন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সংকটকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন এবং এই সংকট বিদেশি ঋণ, বড় বড় প্রকল্প ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি দিয়ে সামলানোর চেষ্টা করেন, নির্বিচারে বিরোধীদের দমন করেন বিদেশিদের ওপর ভর করে, তখন পরিস্থিতি ইমরান ও মাহিন্দার মতো হয়। আরেক বিদেশি শক্তি তাদের সরিয়ে দেয়। রাতারাতি জনবিক্ষোভ তৈরি হয়। কিন্তু এই বিক্ষোভের সুফল জনসাধারণ পায় না।
ইমরান খান ও মাহিন্দা রাজাপক্ষে উভয়েই বিদেশি শক্তির ওপর ভর করে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন। ইমরান খান ইউক্রেন সংকটের সময় রাশিয়া সফর করে এসেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও বেশ কড়া কথা শুনিয়েছেন। আরব রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। সৌদি আরবের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন ইমরান। ইরান, তুরস্ক ও কাতারের সঙ্গে পৃথক জোট করতে আগ্রহী ছিলেন। জাতিসংঘে আবেগপূর্ণ জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়ে ভারতকে নাস্তানাবুদ করতে চেয়েছেন। মার্কিনিদের পাকিস্তানের ঘাঁটি ব্যবহার করে আফগানিস্তানে তালেবানদের ওপর ড্রোন হামলা বন্ধ করেছিলেন। ইমরান খান নিজের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি গঠনে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি হয়তো ধারণা করেছিলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তাঁর ক্যারিশমাকে ব্যবহার করে তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উতরে যাবেন, কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। তিনি ক্ষমতার মেয়াদই শেষ করতে পারলেন না। যদিও ইমরান খান সরাসরি তাঁর বিরুদ্ধে মার্কিন ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছেন।
ইমরান খান যেখানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজের শক্তিশালী অবস্থান সৃষ্টি করতে সচেষ্ট ছিলেন, মাহিন্দা রাজাপক্ষে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইছিলেন। এটা করতে গিয়ে মাহিন্দা ক্রমেই চীনের পেটের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিলেন। চীন থেকে বড় আকারের ঋণ নিয়ে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে জনসাধারণকে বুঝ দিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। আইএমএফের ঋণ বাদ দিয়ে চীনের ঋণের ওপর নির্ভর করেছেন। দেশের কৃষিতে পশ্চিমের সার ও কীটনাশক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করার চেষ্টা করেছেন। তামিল নিধন প্রশ্নে বরাবরই পশ্চিমের অভিযোগকে অস্বীকার করেছেন। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগকে বিশেষ একটা পাত্তা দেননি। এ ক্ষেত্রে মাহিন্দা রাশিয়া ও চীনের ভেটো ক্ষমতাকে নিজের পক্ষে ব্যবহার করেছে জাতিসংঘে।
মূলত, ইমরান ও মাহিন্দা উভয়েই মার্কিন ছায়ার বাইরে গিয়ে রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন। দুজনই বিশ্বরাজনীতি, ঘরের পাশে ভারতের উপস্থিতি ও দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেননি। পশ্চিম বিমুখতা দুজনকেই বিপদে ফেলেছে। অথচ, ২০২০ সালের আগস্টের নির্বাচনে মাহিন্দার দল ২২৫ আসনের মধ্যে ১৪৫ আসনে জিতে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। ওই নির্বাচনে মাহিন্দার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী রনিল বিক্রমাসিংহের ভরাডুবি হয়েছিল। আজকে বিক্রমাসিংহে প্রধানমন্ত্রী আর মাহিন্দা সেনাঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছেন। অবশ্য অভিযোগ রয়েছে, মাহিন্দা বিপুল জনপ্রিয়তা পুঁজি করে ক্রমে ফ্যাসিবাদী আচরণ করেছেন। নিজের পরিবারের সদস্যদের সরকারে এনে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার চেষ্টা করেছেন। মাহিন্দার ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া বিরোধী পক্ষের অনেক কর্মীদের গুম করে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ইমরান খানও বিরোধী রাজনীতির জায়গা ক্রমে সংকুচিত করে ফেলছিলেন।
উভয়েই কূটনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেননি। ইমরান মোটামুটি পরিস্থিতিকে সামলে নিয়েছেন। বড় বড় সমাবেশ করে নিজের শক্তি দেখিয়েছেন। সামনের নির্বাচনে আবারও জিতে ক্ষমতায় আসতে পারেন। অবশ্য ভবিষ্যতে ইমরান রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হলে ক্ষমতায় ফিরে আসার সুযোগ কম। কিন্তু মাহিন্দার জন্য রাজনীতিতে আবারও ফিরে আসা কঠিন হতে পারে। মাহিন্দার কার্যত রাজনীতি থেকে বিদায় হয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে। মাহিন্দার জনসমর্থন আছে; কিন্তু সংকটে জর্জরিত মানুষের ক্ষোভের সামনে তাঁর জনসমর্থন মুহূর্তেই উবে গেছে।
শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এতটাই সংকটময় ছিল যে জটিল রোগীদের অস্ত্রোপচারের মতো ওষুধ আমদানি করতে পারছিল না সরকার। আর খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের সংকট ছিলই। এসবই জোয়ারের মতো মানুষকে পথে নামিয়েছে। মাহিন্দার সমর্থকেরা বাধা দিতে গেলেও টিকতে পারেনি। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এ বিক্ষোভের সামনে ছিল বিভিন্ন এনজিও ও অ্যাকটিভিস্টরা। এরাই পুরো বিষয়টিকে বিক্ষোভে রূপ দিয়েছে। জনসাধারণের ক্ষোভকে এসব অধিকারকর্মীরা ধারণ করেছেন। যে কারণে শ্রীলঙ্কায় পুরোপুরি বিরোধী মত বা জনসাধারণের সরকার গঠিত হয়েছে বলা যাবে না। গণ-অভ্যুত্থানে অনেক দেশেরই সরকার বদল হয়। এরপর নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার আসে। কিন্তু পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় নতুন সরকার না বলে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পছন্দের সরকার ক্ষমতায় বসানো হয়েছে বলা যায়।
কোনো শাসক যখন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সংকটকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন এবং এই সংকট বিদেশি ঋণ, বড় বড় প্রকল্প ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি দিয়ে সামলানোর চেষ্টা করেন, নির্বিচারে বিরোধীদের দমন করেন বিদেশিদের ওপর ভর করে, তখন পরিস্থিতি ইমরান ও মাহিন্দার মতো হয়। আরেক বিদেশি শক্তি তাদের সরিয়ে দেয়। রাতারাতি জনবিক্ষোভ তৈরি হয়। কিন্তু এই বিক্ষোভের সুফল জনসাধারণ পায় না। কারণ শাসকদের এ ধরনের আচরণে এমন সব শক্তি ক্ষমতায় আসে যারা আসলে জনসাধারণের শক্তি না। পাকিস্তানে ইমরানকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসা রাজনীতিবিদদের নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আছে। তাঁরা ইমরানের আমলের সমস্যার সমাধান করতে পারবেন বলে মনে হয় না। ইমরানের অতিরিক্ত রাশিয়া ও চীন প্রীতিই তাঁর ক্ষমতাচ্যুতির অন্যতম কারণ। মাহিন্দাও রাশিয়া, চীনের সঙ্গে ঘেঁষাঘেঁষি করে ক্ষমতা হারালেন নির্মমভাবে।
ইউক্রেন সংকটের পর অনেকেই অনুমান করেছিলেন, অনেক দেশেই ক্ষমতার পালাবদল হতে পারে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাবে। এরপর খুব বেশি দিন যায়নি, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় সরকার পড়ে গেল। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক পরিবর্তনের শিক্ষা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি, নানাবিধ পুরস্কার, সম্মাননা, সীমিত গণতন্ত্র ও অধিক উন্নয়ন ক্ষমতাচ্যুতি এবং গণপিটুনি থেকে শাসকদের রক্ষা করতে পারে না। আরও অনেক দেশে ক্ষমতার পরিবর্তন হতে পারে। তবে সতর্ক থাকতে হবে, পাকিস্তান বা শ্রীলঙ্কার মতো যেন তৃতীয় শক্তি বা সুবিধাবাদীরা ক্ষমতায় চলে এসে জনসাধারণকে প্রতারিত করতে না পারে।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক