২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক যুদ্ধও শুরু হচ্ছে

ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের বিরুদ্ধে ফ্রাঙ্কফুর্টে বিক্ষোভ। বিক্ষোভকারীরা আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রধান ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়ার দাবি জানান
ছবি: এএফপি

রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যে আট বছর ধরে থেমে থেমে ‘অর্থনৈতিক সংঘর্ষ’ চলছে। এখন পর্যন্ত এ অর্থনৈতিক টানাপোড়েন রাশিয়ার ওপর কিছু উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল, কিন্তু তা বাকি বিস্তৃত বিশ্ব অর্থনীতিতে খুব কমই প্রভাব ফেলেছিল। তবে বিনা উসকানিতে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার চলমান আগ্রাসী অভিযান, সে অবস্থা পাল্টে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করেছে। এ চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমারা নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। এসব নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাশিয়া যেসব ব্যবস্থা নেবে, তার নেতিবাচক প্রভাব সমগ্র বিশ্ববাসীর ঘাড়ে এসে পড়বে।

পশ্চিমাদের সঙ্গে এ অর্থনৈতিক যুদ্ধের শুরুটা করেছিল রাশিয়া এবং এর সঙ্গে ইউক্রেনও জড়িত ছিল। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ইউরোমাইডান বিক্ষোভ (ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের সরকার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে ‘ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-ইউক্রেন অ্যাসোসিয়েশন অ্যাগ্রিমেন্ট’ শীর্ষক একটি চুক্তি করতে যাচ্ছিল। কিন্তু রাশিয়ার চাপে পড়ে সে চুক্তি থেকে সরে আসায় ইউক্রেনবাসী রাজধানী কিয়েভের ইউরোমাইডান এলাকায় যে বিক্ষোভ শুরু করে, সেটি ‘ইউরোমাইডান বিক্ষোভ’ নামে পরিচিতি পায়) যখন তুঙ্গে, তখন মস্কো ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের রাশিয়াপন্থী সরকারকে ৩০০ কোটি ডলারের অত্যন্ত জটিল শর্তযুক্ত ঋণ দিয়েছিল। ওই ঋণের চুক্তির ধারায় ইউক্রেনের ভবিষ্যৎকে উন্নত করে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল রাশিয়া।

একই বছরের মার্চে যখন রাশিয়া ইউক্রেনে তার প্রাথমিক আক্রমণ শুরু করে এবং ক্রিমিয়া দখল করে নেয়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসন ক্রেমলিনের অনেক কর্মকর্তাকে কালোতালিকাভুক্ত করে। মূলত তখন থেকেই পশ্চিমের সঙ্গে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়। রাশিয়াপন্থী প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ বিক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে পালানোর পর যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে অর্থনৈতিকভাবে উদ্ধার করতে এবং দেশটির যুদ্ধোত্তর ঋণ পুনর্গঠন প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে সহায়তা করেছিল। রাশিয়ার কাছ থেকে নেওয়া ঋণ ইউক্রেন যাতে শোধ করতে পারে, সে জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তার নিয়মগুলোকে শিথিল করেছিল। তখন থেকেই পশ্চিমাদের সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক টানাপোড়েন তীব্রতার দিকে যেতে শুরু করে। সর্বশেষ ইউক্রেনে অভিযানের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন অবরোধ আরোপ করল। নতুন নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার তেল ও গ্যাসশিল্পে পশ্চিমা বিনিয়োগ সংকুচিত করা হয়েছে। মহামারিকবলিত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া রুশ কোম্পানিগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষমতা এর ফলে আরও খর্ব করা হলো।

আরও পড়ুন

২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা নেওয়ার পর তিনি তাঁর পূর্বসূরি বারাক ওবামার নিষেধাজ্ঞা কৌশলের সমালোচনা করেছিলেন। একই সঙ্গে ট্রাম্প এক ভাষণে ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশংসা করেছিলেন। তবে রিপাবলিকান–নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস ট্রাম্পের সেই মন্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারেনি। সে বছর দ্বিদলীয় ঐক্যের ভিত্তিতে প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে ‘কাউন্টারিং আমেরিকাস অ্যাডভারসারিজ থ্রু স্যাংশন অ্যাক্ট’ শীর্ষক একটি আইন পাস হয়। এর আওতায় রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ও খনি খাতের ওপর আরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া ও পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক যুদ্ধ শীতল হচ্ছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু সব সময়ই সেই শীতলতা স্বল্পস্থায়ী হয়েছে। রাশিয়ার জ্বালানি ও অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানি ইএন প্লাস লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে ২০১৭ সালে তালিকাভুক্ত হয়। কিন্তু তালিকাভুক্তির এক বছরের কম সময়ের মধ্যে এ কোম্পানির প্রধান শেয়ারহোল্ডার রুশ শিল্পপতি ওলেগ দেরিপাস্কার ওপর ওয়াশিংটন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বসে।

যদিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মাঝেমধ্যেই পুতিনের প্রশংসা করে বিতর্ক সৃষ্টি করছিলেন, কিন্তু দেরিপাস্কার ওপর ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞা প্রমাণ করেছে, ট্রাম্পের প্রশাসনের অন্তত কিছু লোক (যাঁদের ট্রাম্প কদাচিৎ নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন) রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সংঘর্ষ থেকে সরে না দাঁড়ানোর পক্ষে ছিলেন। তবে ট্রাম্প নয় মাস পরে দেরিপাস্কার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে একটি বিতর্কিত চুক্তি অনুমোদন দিয়েছিলেন। এরপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের জন্য এফবিআই দেরিপাস্কার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে। তারপরে ট্রাম্প ২০১৮ সালের মার্চ মাসে যুক্তরাজ্যে প্রাক্তন ডাবল এজেন্ট সের্গেই স্ক্রিপালকে হত্যার চেষ্টার জন্য রাশিয়ান ঋণের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

জো বাইডেন ক্ষমতায় এসেই অবরোধ আরোপের নীতি পুনঃস্থাপন করেন। তিনি বিশেষ করে রাশিয়ার বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কালোতালিকাভুক্ত করে সেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর অবরোধ আরোপ করেছেন। বাইডেন প্রশাসনের এ নিষেধাজ্ঞা স্পষ্টতই ক্রেমলিনকে তার তৎপরতা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। পুতিন ভালো করেই জানতেন, ইউক্রেনে অভিযান চালালে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বড় বড় দেশের পক্ষে থেকে নতুন নতুন অবরোধ আসতে পারে। কিন্তু পুতিন এসব নিষেধাজ্ঞাকে পাত্তা দিতে চান না বলেই মনে হচ্ছে।

ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অধীনে থাকা দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নতুন অবরোধ আরোপ করে। নতুন অবরোধের কেন্দ্রে রয়েছে রাশিয়ার ছয়টি ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সক্ষমতা। রুশ নীতিনির্ধারকদের অর্থায়ন করছে এবং ইউক্রেনের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অংশে কার্যক্রম চালাচ্ছে এমন ব্যাংকসহ ২৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। রাশিয়ার পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের যেসব সদস্য ইউক্রেনের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অংশকে মস্কোর স্বীকৃতি দেওয়ার পক্ষে ভোট দিয়েছেন, সেসব সদস্যকেও অবরোধে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে এসব অবরোধকে রাশিয়ার দিক থেকে তার অর্থনীতির দুর্গে ‘আঁচড়মাত্র’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাশিয়া অভিযান থেকে সরে না এলে আরও বড় ধরনের অবরোধ দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ এবং যুক্তরাজ্য কার্যকরভাবে রাশিয়াকে বৈশ্বিক আর্থিক বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেষ্টা করবে বলে ভাবা হচ্ছে। এটি যে বিস্তৃত অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলবে, তা বাইডেন নিজেই ইতিমধ্যে স্বীকার করেছেন। রাশিয়ার অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ হওয়ায় পাল্টা আঘাত হিসেবে রাশিয়া জ্বালানি বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ফেলবে। ইতিমধ্যে রাশিয়া ইউরোপকে অদূর ভবিষ্যতে গ্যাসের উচ্চ মূল্যের জন্য প্রস্তুত থাকতে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। আর ইউরোপে জ্বালানির বাজারে আগুন ধরলে তার আঁচ ইউরোপের বাইরেও অনুভূত হবে।

শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে রাশিয়া ও ইউক্রেন সারা বিশ্বের ‘রুটির বাস্কেট’ হিসেবে ভূমিকা রাখে। প্রধানত গম উৎপাদনে রাশিয়া শীর্ষস্থানে রয়েছে। বিষয়টি মাথায় রেখেই রাশিয়া ধীরে ধীরে তার খাদ্যশস্যের ব্যবসা এবং সারশিল্পের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আনছে। রাশিয়া পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে কৃত্রিম বৈশ্বিক খাদ্যসংকট তৈরি করতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে বোঝা যাচ্ছে, রাশিয়া ও পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক যুদ্ধের অর্থ হলো কৃষি, ধাতু এবং জ্বালানি বাজারে দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা জিইয়ে রাখা। বিশ্ব হয়তো সেদিকেই যাচ্ছে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো