২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

পরীক্ষায় ফেল: সন্তান কেন মরবে?

সদ্য প্রকাশিত এইচএসসি ফলাফল হাতে আসতে না আসতে বেদনাদায়ক আত্মহত্যার খবরের কাফেলা ক্রমেই বড় হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় ছয়-সাতজনের আত্মহননের কথা ছাপা হয়েছে। এই তালিকার একজন ছাড়া বাকি সবাই কিশোরী। পঞ্চগড়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় একবার অকৃতকার্য হওয়ায় শাবনুর আক্তার (১৯) এবার দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়েছিলেন। আত্মহত্যার মতো চরম পথ বেছে নেওয়া পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তাঁরাও একটা উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠী। দু-একবার ফেল করায় তাঁরা জীবনের শেষ বলে ধরে নেন।

আত্মহত্যার পাশাপাশি আত্মহত্যার চেষ্টার কোনো প্রকৃত হিসাব পাওয়া বেশ কঠিন। শিশু অধিকার ফোরামের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর ৭ থেকে ১০ মে—এই চার দিনে ৪৭ জন পরীক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এটা হাসপাতাল থেকে নেওয়া হিসাব। অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসা নেন না বা তেমন গুরুতর কিছু নয় জ্ঞান করে অভিভাবকেরা হাসপাতালে পাঠান না। হাসপাতালে যাঁরা আসেন, তাঁদেরও শারীরিক চিকিৎসা ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা দেওয়া হয় কি? যে মানসিক অবস্থায় পৌঁছানোর পর একজন কিশোর বা কিশোরী দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, সেই মানসিক সংকটের কোনো চিকিৎসা কি আমরা দিতে পারি? না তার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি?

সদ্য প্রকাশিত এইচএসসির ফলাফলের পর এখন পর্যন্ত যে কয়জনের (মোট ছয়জন) আত্মহননের খবর এসেছে, তার মধ্যে পাঁচজনই মেয়ে শিক্ষার্থী। দুর্যোগ ফোরামের তথ্য আনুযায়ী, ২০১৮ সালে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে যে ১৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে, তাদের মধ্যে ১৫ জন ছিল মেয়ে শিক্ষার্থী এবং দুজন ছেলে শিক্ষার্থী। এ ছাড়া তিনটি জেলায় ২৯ জন আত্মহত্যার চেষ্টা করে। এর মধ্যে রংপুরে একজন ছেলে শিক্ষার্থীসহ ৬ জন মেয়ে শিক্ষার্থী, টাঙ্গাইলে ৭ জন এবং রাজশাহীতে ১৫ জন আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়।

পরীক্ষার ফলাফলে অসন্তুষ্ট হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা শুধু যে এ বছরে এসএসসি, এইচএসসিতে ঘটেছে তা নয়, প্রতিবছরেই এটা ঘটে। এমনকি জেএসসি, পিএসসি পরীক্ষার ফলাফলের পরও আত্মহত্যা বা আত্মহত্যাচেষ্টার ঘটনা ঘটছে। শিশু অধিকার ফোরামের প্রতিবেদন বলছে, পিএসসি, জেএসসি ইত্যাদি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া বা আশানুরূপ ফল (এ‍ প্লাস) না পাওয়ার কারণে বছরে ১০ থেকে ১৫ জন শিশু আত্মহত্যা করে।

গত মে মাসে এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর জামালপুরের ইসলামপুর শহীদ খালেদ মোশাররফ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শারমিন আক্তার বাড়ির কাছে রেললাইনে দৌড়ে গিয়ে ঢাকাগামী আন্তনগর তিস্তা ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাকে বাঁচাতে ছুটে যান তাঁর অন্তঃসত্ত্বা খালা সুখতারা বেগম। শারমিনের সঙ্গে তিনিও ট্রেনে কাটা পড়ে মারা যান। এসএসসি পরীক্ষায় ফেল করার খবরে আত্মহত্যার তালিকা বেশ দীর্ঘ। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ফলাফল প্রকাশের আধা ঘণ্টা পর থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। ফেল করার পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত গ্রেড না পাওয়ায় আত্মহত্যার বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। বাগেরহাটের ফকিরহাটে এসএসসি পরীক্ষায় বি গ্রেড পেয়ে উত্তীর্ণ হওয়ায় জোবায়দা খানম মীম (১৬) বিষপানে আত্মহত্যা করে। মীম শুভদিয়া কেবি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুব্রত দাস বলেন, মীম বি গ্রেড পাওয়ার ছাত্রী ছিল না। সে এ রকম ফলের ভার নিতে না পেরে অভিমানে আত্মহত্যা করে থাকতে পারে।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষকেরাও তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের অপ্রত্যাশিত খারাপ ফলাফলে বিস্মিত হয়েছেন। পুনরায় যাচাইয়ের সুযোগ থাকলেও ছাত্রছাত্রীদের সেটা জানা না থাকার কারণে কেউ কেউ চরম পথ বেছে নিয়েছে। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় পূজা বাড়ৈ কোটালীপাড়া ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। ফেল করার খবর শুনেই সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক বনোজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘পূজা খুব মেধাবী ছাত্রী ছিল। সে গণিতে ফেল করবে, এটা আমরা কেউ ভাবিনি। যেহেতু সে ভালো ছাত্রী, সেহেতু বোর্ডে খাতা চ্যালেঞ্জের সুযোগ ছিল। কিন্তু কিছু না বুঝেই সে এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল।’

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত আত্মহত্যার খবরগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই দুঃখজনক পরিস্থিতির শিকারের সিংহভাগ হচ্ছে মেয়েশিশু বা কিশোরী। ২০১৭ সালে যে ২১৩টি শিশু বা কিশোর বয়সীরা আত্মহত্যা করে, তাদের মধ্যে ৫৩ জন ছেলেশিশু এবং ১৬০ জন মেয়েশিশু। অর্থাৎ ২০১৭ সালে আত্মহত্যার শিকার শিশুদের ২৫ শতাংশ ছেলে এবং ৭৫ শতাংশ মেয়ে। আর তাদের ৬৮ শতাংশেরই বয়স ১৩ থেকে ১৮–এর মধ্যে।

এ রকম পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আগে আমাদের সংকটটা স্বীকার করতে হবে। ভাবতে হবে, কেন প্রধানত মেয়ে শিক্ষার্থীরা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে? তারা কি বেশি চাপ আর লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করে লেখাপড়া চালিয়ে যায়? নাকি বলে দেওয়া হয় এবার ফেল করলে আর পড়ানো যাবে না—বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে! পরীক্ষায় ফেল মানেই কি জীবনের সব দুয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া; নাকি ঘুরে দাঁড়ানোর আর অনেক উপায় আছে? স্কুলে কি পরীক্ষাভীতি আর ফলাফলের জুজু নিয়ে কোনো কথা বলেন শিক্ষকেরা?

ভারতে এক বাবা ছেলে চার বিষয়ে ফেল করেছে জেনেও ঢাকঢোল পিটিয়ে মিষ্টি খাওয়ালেন প্রতিবেশীদের। বকাঝকা তো দূরের কথা, উল্টো ছেলেকে ফুলের মালা দিয়ে সাজিয়ে রীতিমতো শোভাযাত্রা বের করে পাড়ায় ঘুরিয়েছেন তিনি! এমন অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে ভারতের মধ্যপ্রদেশের সাগরে। এ সেই মধ্যপ্রদেশ, যেখানে কয়েক দিন আগেই পরীক্ষায় পাস করতে না পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল ১১ ছাত্র। তাদের মধ্যে ছয়জন মারাও গেছে। কেউ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে, কেউবা উচ্চমাধ্যমিকে। অকৃতকার্য ওই ছাত্রের বাবা সুরেন্দ্র কুমার জানান, তিনি বরং উল্টো পথে হেঁটে ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, পরীক্ষায় ফেল মানেই জীবন শেষ নয়। জীবন সবে শুরু হয়েছে। চান না ছেলে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিক।

সুরেন্দ্র বলেন, সন্তানদের অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে, তাদের কাছে টেনে ভালোবাসা উচিত। অকৃতকার্য ছাত্রের বাবা যে সাহস দেখিয়েছেন, তাতে হয়তো আরেকটি আত্মহত্যা আটকানো গেল।

আমাদের কি কিছু শেখার আছে এ থেকে?

গওহর নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকর্মী এবং শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।