পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। পরীক্ষাকেন্দ্রের মূল ফটক বন্ধ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই এলেন এক পরীক্ষার্থী, সঙ্গে তাঁর মা। যানজটে আটকে পড়ে মালিবাগ থেকে সিটি কলেজ পর্যন্ত যথাসময়ে পৌঁছাতে পারলেন না। কতটুকু দূরত্ব আর! এখন কিছুতেই কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হবে না সামিয়া আফরিন নামের ওই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীকে। ফটকের গায়ে বাড়ি দিচ্ছিলেন মা, বারবার কাকুতি–মিনতি করছিলেন তাঁর মেয়েকে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দিতে। পরে উপস্থিত অন্য অভিভাবকদের অনুরোধে তাঁর জন্য কেন্দ্রের ফটক খুলে দেওয়া হয়। রীতিমতো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন মা।
করোনা মহামারির ধাক্কায় বহুদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর অনুষ্ঠিত হওয়া দেশের পাবলিক পরীক্ষাগুলোর কেন্দ্রের সামনে এভাবেই কোনো না কোনো অভিভাবককে অসহায় পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছিল। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কেন মা–বাবারা পরীক্ষাকেন্দ্রে আসেন, এ নিয়ে আমাদের সমালোচনার শেষ নেই। পথে কোনো বিপদ বা অসুবিধা হয়নি তো, এ চিন্তায় মা–বাবারা ঘরে থাকতে পারেন না। সেই থাকতে না পারা থেকেই আমরা এই মাকে দেখি পরীক্ষাকেন্দ্রের সামনে কাকুতি–মিনতি করতে।
অনেকেই বলেন, যানজট তো নতুন কিছু নয়, পরীক্ষার দিন একটু আগেভাগে বের হলেই তো হয়। তাঁরা কি জানেন, ভোর ছয়টায় ঘর থেকে বের হয়েও যথাসময়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছানো যায়নি, এমন ঘটনাও আছে।
গাজীপুর থেকে ঢাকায় পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রয়োজনের তিন গুণ সময় হাতে নিয়েও পৌঁছাতে পারেননি উচ্চমাধ্যমিকের এক পরীক্ষার্থী। একে তো বৃষ্টি, খানাখন্দে ভরা রাস্তায় ট্রাক উল্টে কয়েক মাইলের যানজট, জায়গায় জায়গায় হাঁটুপানি জমে যাওয়ায় কোনো সিএনজি, মোটরবাইক রাজি হলো না। বাস থেকে নেমে দুই ঘণ্টা দৌড়ে, আবার বাসে উঠে, সেটি থেকেও নেমে যেতে হলে এরপর সিএনজিতে উঠে কাদা মাখামাখি ও কাকভেজা হয়ে কেন্দ্রে পৌঁছাতে ৪০ মিনিট দেরি। অনেক অনুরোধের পর কেন্দ্রে ঢোকার অনুমতি পেলেও পরীক্ষকেরা সৃজনশীলের প্রশ্নপত্র দিলেন কিন্তু নৈর্ব্যত্তিকেরটা দিলেন না। দ্রুতবেগে সৃজনশীলের উত্তর শেষ করে হাতে ১০ মিনিট সময় ছিল আরও। কান্নাকাটি ও কাকুতি–মিনতি করার পরও পরীক্ষকদের মন গলাতে পারেননি তিনি।
গোটা একটা বছর নিশ্চিতভাবেই নষ্ট করে দেওয়া হলো তাঁর। করোনার কারণে দুটি শিক্ষাবর্ষ তো আগেই গেল। ওই ছাত্রের বিপর্যস্ত চেহারা ও শরীর দেখে সহজে বোঝা যেত যে এখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার কতটা আশঙ্কা থাকতে পারে, তা–ও আবার পরীক্ষা শেষ হওয়ার মাত্র ১০ মিনিট আগে। পরীক্ষকেরা একটু সদয় হলেই পারতেন।
এ মাসের শুরুর দিকে এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোড়ন তুলেছিল। এ দুটি ঘটনাই নয়, এবারের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় অনেক শিক্ষার্থীই ঠিকঠাকমতো পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেননি। এ নিয়ে এক টিভি টক শোতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান নেহাল আহমেদ নিজেও বলেছেন, ঢাকার স্বনামধন্য এক প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষাকেন্দ্রে এক ছাত্রী হাজির হয়েছেন, যখন পরীক্ষা প্রায় শেষ। যানজটে আটকে পড়েছিলেন উচ্চমাধ্যমিকের ওই পরীক্ষার্থী। একই অনুষ্ঠানে সাংবাদিক জুলহাস আলম বলেছেন, যানজটে আটকে পড়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা গাড়ি থেকে নেমে দৌড়াচ্ছেন, এমন দৃশ্য তিনি দেখেছেন। ভাবুন তো, একটা শহরকে আমরা কতটা শিক্ষার্থীবান্ধব করে তুলতে পেরেছি আসলে।
ঢাকা–ময়মনসিংহ সড়কের উন্নয়নের জেরে যানজট অনেক সময় গাজীপুর–টঙ্গী থেকে ঢাকায় এসে ঠেকে। এবারের এসএসসি পরীক্ষার শুরুর দিন এমনই ছিল। সেদিন যথাসময়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেননি অনেক পরীক্ষার্থী। সড়কটির এ ভোগান্তি কবে শেষ হবে, তা জানার আগ্রহটুকুও হারিয়ে ফেলেছে মানুষ। সেখানে ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পটি (বিআরটি লেন) শেষ হয়ে রাস্তায় বাস নেমে যাওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালেই, তা না হয়ে দ্বিগুণ সময় লাগছে, ব্যয়ও বেড়েছে দ্বিগুণ। এটিই বোধ হয় এ দেশের উন্নয়নের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য!
যানজট কমাতে ঢাকার ভেতরে–বাইরে একের পর এক ফ্লাইওভার করা হলো, এখনো করা হচ্ছে কিন্তু এর তেমন সুফল মিলল না। সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক গবেষণা বলছে, ঢাকায় গড় ট্রাফিকের গতি হচ্ছে ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার। হাঁটার গতির চেয়ে যা সামান্য কিছু বেশি। অথচ মাত্র ১২ বছর আগেও এ গড় গতি ছিল প্রায় ২১ কিলোমিটার। এভাবে চললে ২০৩৫ সাল নাগাদ তা ৪ দশমিক ৭ কিলোমিটারে নেমে যেতে পারে। তখন হাঁটার গতি থেকেই পিছিয়ে পড়বে যানবাহনের গতি। ঢাকায় যানজট নিরসনে গত এক দশকে সরকার প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে, কিন্তু প্রকল্পগুলো যথাসময়ে সম্পন্ন না হওয়ায় ভোগান্তি থেকেই যাচ্ছে।
পরীক্ষাকেন্দ্রে দেরিতে প্রবেশ করা কোনো পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার অনুমতি দিলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এ নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইবেন না স্বাভাবিক। এখন ঢাকার ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের যে খতিয়ান আমরা দেখতে পাচ্ছি, এর জন্য প্রস্তুতি হিসেবে শিক্ষা বোর্ডের একটি গাইডলাইন তৈরা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো বড় প্রকল্পগুলো শেষ হলে ঢাকার যোগাযোগব্যবস্থা বদলে যাবে ঠিকই, মানুষের দুর্ভোগ কি কমবে আদৌ? যানজট এড়িয়ে নির্বিঘ্নে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছা আদৌ সম্ভব হবে পরীক্ষার্থীদের? নাহ্, সহসা মুক্তি মিলছে না। ২০৫০ সাল পর্যন্ত থাকছে ঢাকাবাসীর দুর্ভোগ (বণিক বার্তা, ২৫ ডিসেম্বর)। কারণ, ঢাকায় আরও পাঁচটি মেট্রোরেল, আরেকটি বিআরটি লেন, পরিকল্পনাধীন তিনটি রিংরোড, বৃত্তাকার রেল, পাতালরেল হতে যাচ্ছে। একটি শেষ হওয়ার আগেই আরেকটি প্রকল্পের দুর্ভোগ, বিক্ষিপ্ত উন্নয়নের কারণে একটি বসবাসযোগ্য রাজধানী শহর পেতে কয় প্রজন্ম পার হতে হয়, সেটিই আমাদের ভাবাচ্ছে।
শুধু উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের জেরেই নয়, রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণেও ভুক্তভোগী হচ্ছে পরীক্ষার্থীরা। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে জলবায়ু সম্মেলনে যাওয়া এক ছাত্রলীগ নেতাকে বহিষ্কারই করা হয়েছে, তাঁকে স্বাগত জানাতে গিয়ে তাঁর কর্মীরা বিমানবন্দর সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি করেছিলেন বলে। সেদিন অনেক এসএসসি পরীক্ষার্থী যথাসময়ে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারেনি।
পরীক্ষাকেন্দ্রে দেরিতে প্রবেশ করা কোনো পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার অনুমতি দিলে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কেন্দ্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এ নিয়ে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইবেন না স্বাভাবিক। এখন ঢাকার ভবিষ্যৎ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের যে খতিয়ান আমরা দেখতে পাচ্ছি, এর জন্য প্রস্তুতি হিসেবে শিক্ষা বোর্ডের একটি গাইডলাইন তৈরা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। যেখানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে, দেরি করা শিক্ষার্থীদের কীভাবে পরীক্ষা নেওয়া হবে, আবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশঙ্কাও থাকবে না; কেউ যাতে এই সুযোগের অসৎ ব্যবহার করতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। এর ফলে যানজটে আটকে পড়া পরীক্ষার্থীদের ফলাফলও খারাপ হওয়া ঠেকানো যাবে, এমনকি কাউকে গোটা একটা শিক্ষাবর্ষ হারাতে হবে না।
● রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক