পরিবেশ রক্ষা: বিপরীত ভূমিতে বাংলাদেশ

রিচার্ডের সঙ্গে আমার দেখা হয় ফিলিপাইনে। সে কম বয়সী শুকনো শরীরের একজন আমেরিকান। মেরিল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছে, পরিবেশ আইনের উঠতি বিশেষজ্ঞও বলা যেতে পারে তাকে। বক্তৃতা শেষ করে চা খাওয়ার সময় পরিচয় হয়েছে তার সঙ্গে। তখন তেমন কথা হয়নি। দুপুরের খাবারের সময় আমার পাশের চেয়ারে বসে সে। এই খাবারের টেবিলেই হয় বিদেশের কনফারেন্সের আসল মনখোলা আলাপ।

ফিলিপাইনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর সেবুতে এই কনফারেন্সের আয়োজন হয় জুনের প্রথম সপ্তাহে। আইইউসিএন একাডেমির সদস্যরা এখানে জড়ো হয়েছিল পরিবেশ বিষয়ে তাদের নতুন চিন্তাভাবনা ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরার জন্য। জানা গেল এল সালভাদর থেকে ভারত পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের চমকপ্রদ সব অগ্রগতির খবর। আলোচনা হলো ‘ট্রাম্প’-যুগের হতাশা নিয়েও।

খাবার টেবিলে রিচার্ডের সঙ্গে আলাপ ছিল মূলত ট্রাম্প নিয়েই। অন্য অনেকের মতো রিচার্ডও বিরক্ত জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক প্যারিস চুক্তি থেকে আমেরিকার বের হয়ে আসার ঘোষণা নিয়ে। আমি তাকে বললাম: জলবায়ু চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার নজির এর আগে প্রেসিডেন্ট বুশের সময়ও হয়েছে। ১৯৯৭ সালের কিয়োটো প্রটোকল থেকেও প্রেসিডেন্ট বুশ বের হয়ে এসেছিলেন চুক্তি আন-সাইন করার ঘোষণা দিয়ে। কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করে তা না-স্বাক্ষরের ঘোষণাটি ছিল নজিরবিহীন একটি ঘটনা। তবে রিচার্ডের মতে, প্যারিস চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার প্রভাব হতে পারে আরও ভয়ংকর কিছু।

এটি তাই এখন রিচার্ডের মতো পৃথিবীর যেকোনো পরিবেশ-সচেতন মানুষের দুর্ভাবনার বিষয়। কিয়োটো প্রটোকল ছিল একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি, প্যারিস চুক্তি মাত্র দেড় বছর আগে সম্পাদিত একটি স্থায়ী চুক্তি। প্যারিস চুক্তি যখন হয়েছে তখন বৈশ্বিক উষ্ণতার লক্ষণ আরও বহু গুণে স্পষ্ট হয়েছে। উদ্বিগ্ন হয়ে পৃথিবীর সব রাষ্ট্র এটি রোধে একমত হয়েছে প্যারিস চুক্তিতে। এই চুক্তি সম্পাদনে পৃথিবীর এই সময়ের সবচেয়ে বৃহৎ কার্বন নিঃসরণকারী রাষ্ট্র চীন পর্যন্ত রাজি হয়েছে। চীনকে রাজি করাতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে খোদ আমেরিকাই, তার ওবামা আমলে।

প্যারিস চুক্তির ধরনও অন্যান্য পরিবেশ চুক্তি থেকে আলাদা। এতে নিকারাগুয়া ও সিরিয়া বাদে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ নিজ থেকে কার্বনসহ বিভিন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার অঙ্গীকার করেছে। ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন (এনডিসি) নামক প্রতিটি দেশের দলিলের এই লক্ষ্যমাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ানোর ব্যবস্থাও রয়েছে প্যারিস চুক্তিতে। চুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা শিল্প-যুগের আগের চেয়ে কোনোভাবেই ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়ে বেশি বাড়তে না দেওয়া। অথচ জমাকৃত এনডিসিগুলোর পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে রাষ্ট্রসমূহের প্রতিশ্রুত ব্যবস্থা কার্যকর করলেও তাপমাত্রা সাড়ে ৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়ে বেশি বেড়ে যাবে।

এমন তাপমাত্রায় পৃথিবীর টিকে থাকারই কথা না ঠিকমতো। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, আবাদযোগ্য ভূমির বিলুপ্তি, জীববৈচিত্র্যের বিলুপ্তি ও নতুন নতুন রোগের প্রাদুর্ভাবে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে আমাদের এই বিশ্ব। এমন এক সময়ে এযাবৎকালের সর্ববৃহৎ (বর্তমানের দ্বিতীয় বৃহৎ) গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী রাষ্ট্র আমেরিকা চুক্তি থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। এটি তাই ভয়াবহ একটি সংবাদই।

তবে যতটা বিপর্যয়কর ভাবা হচ্ছে ততটা বিপর্যয় আসলে না–ও ঘটতে পারে ট্রাম্পের ঘোষণায়। আমেরিকা চুক্তি থেকে সরে এলেও আমেরিকার বৃহৎ কোম্পানিগুলো (যেমন এক্সন মবিল, গুগল, ফেসবুক) এবং বড় রাজ্যগুলো (যেমন ক্যালিফোর্নিয়া) প্যারিস চুক্তি মেনে চলবে। আমেরিকার অনেক শহরও তা করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল শাসনব্যবস্থায় স্বাধীনভাবে তা করার মতো এখতিয়ারও রয়েছে রাজ্য ও শহরগুলোর। রিচার্ডকে আরও আশাবাদী করার জন্য আমি বলি, তা ছাড়া ট্রাম্প তো অভিশংসিতও হয়ে যেতে পারেন দ্রুত। রিচার্ড হাসে। বলে, আমরা তা চাই না। সে ইমপিচ হলে বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট হবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। সে আরও অনেক ধূর্ত। বরং ট্রাম্প চার বছর থাকলে দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁর জেতার সম্ভাবনা খুব কম। পরিবেশবান্ধব হিসেবে পরিচিত ডেমোক্র্যাটরা সহজেই জিতে আসবে তখন।

.

আমেরিকায় যাই ঘটুক, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে ঘটছে আশাবাদী হওয়ার মতো বহু কিছু। বড় দেশ চীন আর ইউরোপ দৃঢ়ভাবে প্যারিস চুক্তির পক্ষে থাকার ঘোষণা দিয়েছে, এটা সবারই জানা। চীন তার নতুন আইনি ব্যবস্থায় একটি ‘ইকোলজিক্যাল সিভিলাইজেশন’ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। তার পরিবেশ ও দেওয়ানি আইনে পরিবেশ রক্ষাকে সরকারি কর্মচারীদের অন্যতম কর্তব্য হিসেবে বর্ণনা করেছে এবং উন্নয়নকাজে জনগণের মতামত প্রদানের ব্যাপক স্বীকৃতি প্রদান করেছে।

সেবুর কনফারেন্সে উঠে এল পরিবেশ রক্ষা ও বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে অন্যান্য দেশের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথাও। এর মধ্যে বিশেষভাবে বলতে হয় এল সালভাদরের কথা। দেশটি সম্প্রতি সোনা ও অন্য সব ধাতব খনিজ পদার্থ আহরণ নিষিদ্ধ করে আইন প্রণয়ন করেছে। এই আইন প্রণীত হয়েছে প্যাসিফিক রিম নামের একটি জায়ান্ট করপোরেশনের আনীত মামলায় এল সালভাদর সরকারের একটি ঐতিহাসিক বিজয়ের পর। প্যাসিফিক রিম এল সালভাদরে এক্সপ্লোরেশনের বা খুঁজে দেখার চুক্তি করেছিল। সোনার খনির সন্ধান লাভের পর তা আহরণের চুক্তি করতে গেলে এল সালভাদরের জনগণ ও পরিবেশবাদীরা আপত্তি জানায়। পার্শ্ববর্তী হন্ডুরাসে সোনা উত্তোলনের কারণে মৎস্য, কৃষি ও বনভূমির ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটেছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই এল সালভাদরের এই আপত্তি। বিষয়টি আরবিট্রেশন আদালতে গেলে প্যাসিফিক রিম-এর পরিবেশ সমীক্ষার দুর্বলতার কথা তুলে ধরে এল সালভাদর সরকার মামলাটি জিতে যায়। এই মামলায় জেতার পরপরই এল সালভাদর সরকার সোনা ও কঠিন খনিজ দ্রব্যাদি আহরণ নিষিদ্ধ করে একটি নজিরবিহীন আইন প্রণয়ন করে গত বছর।

প্যাসিফিক রিম-এর সোনা উত্তোলনের পরিকল্পনার চাবিকাঠি ছিল মুক্ত বাণিজ্য নীতিমালার আওতায় করা একটি দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি। দেশে দেশে এ ধরনের চুক্তি করে বড় দেশ ও তার ছত্রচ্ছায়ায় থাকা কোম্পানিগুলো গরিব দেশে মুনাফাভিত্তিক প্রকল্প করে পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে আসে। প্যাসিফিক রিমের এই পরাজয় তাই আমেরিকা মহাদেশের ছোট ছোট দেশে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে নতুন আশাবাদ তৈরি করেছে।

আশাবাদী হওয়ার মতো ভূমিকা পালন করেছেন ইন্দোনেশিয়ার সুপ্রিম কোর্টও। ইন্দোনেশিয়ায় পাম অয়েলের জন্য আগুন দিয়ে বন উজাড় করা বহুজাতিক প্লান্টেশন কোম্পানিগুলো কার্বন নিঃসরণের জন্য বিশ্বব্যাপী কুখ্যাত। এ রকম একটি কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো একটি বড় মামলায় জয় পেয়েছে ইন্দোনেশিয়া সরকার ২০১৫ সালের নভেম্বরে। এই মামলায় ২ কোটি ৬০ লাখ ডলারের ক্ষতিপূরণসহ কিছু কড়াকড়ি নির্দেশের পর ২০১৬ সাল থেকে ফরেস্ট ফায়ার কিছুটা হলেও কমতে শুরু করেছে।

পরিবেশ রক্ষায় ফিলিপাইন ও ভারতের আদালতও বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে সম্প্রতি। ২০১৫ সালে ফিলিপাইনের সুপ্রিম কোর্ট একটি ঐতিহাসিক মামলায় সেবু ও নেগ্রোসের মধ্যবর্তী ফিলিপাইন সাগরে একটি জাপানি পেট্রোলিয়াম কোম্পানির চুক্তি বাতিল করে দিয়েছেন। ২০০৭ সালে এই মামলাটি আনা হয়েছিল চুক্তির কারণে জীবন বিপন্ন হওয়া ডলফিন ও অন্যান্য সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর পক্ষে, এই রায়ের মাধ্যমে তাদের পক্ষে মামলা করার অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। এই রায় সারা পৃথিবীর বিচারব্যবস্থার জন্য নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

ভারতের ঘটনাটি মাত্র কয়েক মাস আগের। এ বছর মার্চ মাসে উত্তরাখন্ড হাইকোর্ট গঙ্গা, যমুনাসহ অন্যান্য নদীকে লিগ্যাল পারসন ও জীবিত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেলকে এর সংরক্ষণের জন্য অভিভাবকের দায়িত্ব প্রদান করেছেন। ‘গঙ্গা ও যমুনার জীবন রয়েছে এবং এরা পর্বত থেকে সমুদ্র পর্যন্ত জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে’—আদালতের এই পর্যবেক্ষণ নদীদূষণে বিপর্যস্ত ভারতে নতুন আশাবাদের সৃষ্টি করেছে।

.

সেবু কনফারেন্সের বিষয়ই ছিল আশাবাদী প্রবণতাগুলো তুলে ধরা। ইকুয়েডর নতুন সংবিধানে পরিবেশবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে, সংবিধান পরিবেশের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সে অনুযায়ী বিভিন্ন নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। বলিভিয়ার সংবিধানে পরিবেশগত ভারসাম্যের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ১৯তম সংশোধনীতে তথ্য অধিকারকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর গত বছর প্রণীত তথ্য অধিকার আইনকে পরিবেশ রক্ষার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে।

ফিলিপাইন মেরিন আইল্যান্ড রক্ষার জন্য একটি চমৎকার আইন প্রণয়ন করেছে, মালয়েশিয়া ২০১৫ সালে পরিবেশ সমীক্ষা করার জন্য কঠোর বিধিমালা করেছে। থাইল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট গ্রিন বিচ গড়ে তোলার জন্য ২০১৫ সালে নতুন নির্দেশনামা দিয়েছে। মিয়ানমারে নতুন পরিবেশবান্ধব বন ও খনিজ সম্পদ আহরণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ইউরোপে বিভিন্ন আদালতে পরিবেশ রক্ষায় নন-রিগ্রেশন ও ইন্টার-জেনারেশনাল রাইটস নীতিগুলো দৃঢ়ভাবে স্বীকৃত হয়েছে।

আমার পালা আসে বাংলাদেশের কথা বলার জন্য। আমি বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধে বাংলাদেশের এনডিসি দলিলের কথা বলি, এই দলিল বাস্তবায়নে একটি খসড়া রোডম্যাপ হয়েছে, সবিস্তারে এটিও বলি। অনেকে প্রশংসাও করে এর।

কিন্তু বিপত্তি ঘটে অন্যখানে। কনফারেন্সে প্রতি পর্বেই ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। সেখানে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজসংক্রান্ত একটি সেশনে বাংলাদেশের রামপাল প্রকল্পের প্রসঙ্গ ওঠে। এই প্রকল্পের মারাত্মক পরিবেশগত প্রভাবের আশঙ্কার কথা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির কল্যাণে পৃথিবীর পরিবেশবাদীরা জেনে গেছে। তারা বিস্মিত কীভাবে এমন একটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প হতে পারে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের পাশেই!

আমার এর উত্তর জানা ছিল না, নেইও। শুধু স্বপ্ন দেখি ফিলিপাইনের আদালত, ভারতের পরিবেশবাদী, এল সালভাদরের সরকারের মতো আমার দেশেরও কেউ একদিন ঠেকিয়ে দেবে রামপালের মতো সর্বনাশা সব প্রকল্প! পরিবেশ রক্ষায় বড় দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে বাংলাদেশেও।

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়