এত সূক্ষ্ম কাপড় কোনো মানুষের পক্ষে বানানো সম্ভব নয়, এ নিশ্চয় পরিদের কাজ, মসলিন কাপড় দেখে ইংল্যান্ডের লোকেরা একসময় এমনই মন্তব্য করেছিল ১৮৩৫ সালে—এই কথা লিখেছেন এডওয়ার্ড বাইনেস তাঁর হিস্ট্রি অব দ্য কটন ম্যানুফ্যাকচার ইন গ্রেট ব্রিটেন নামের বইয়ে। হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য, পৃথিবীর বিস্ময় এই মসলিন কাপড় তৈরির মূল এলাকা ছিল এই বাংলাদেশ, আমাদের এই মেঘনা আর ব্রহ্মপুত্র নদের তীর ঘিরেই। এই ঢাকা থেকেই সেই কাপড় চলে যেত চীন, ফ্রান্স, অটোমান সুলতানের প্রাসাদ থেকে রোম সাম্রাজ্যের দরবারে। কথিত আছে, রোমানরা মসলিনকে বলত ‘বাতাসে গেরো দিয়ে তৈরি করা কাপড়।’ নানা দেশের সম্রাট-সম্রাজ্ঞীদের আভিজাত্যের প্রতীক একসময় ছিল মসলিন।
মসলিন নিয়ে নানা মিথ শুনে বড় হয়েছি আমরা। ছোটবেলায় শুনতাম, মসলিনের তৈরি একটা শাড়ি অনায়াসে একটা ম্যাচ বাক্সে ঢুকিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু মসলিন নামের রহস্যময় সেই কাপড়ের জয়যাত্রা থেমে যায় একসময়। থেমে যায় মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের হাতে। আঠারো শতকে ইংল্যান্ডে যে কাপড়ের শিল্প গড়ে উঠেছিল, তার বাজার প্রসারে একটা বড় বাধা ছিল মসলিন। মসলিনের প্রতিপত্তিকে ধ্বংস করতে ব্রিটিশরা নেয় নানা কৌশল। ভারতবর্ষের শাসক হিসেবে মসলিন কাপড় তৈরি, রপ্তানির ওপর তারা বসায় অবিশ্বাস্য কর। মসলিনশিল্পকে ধ্বংস করতে এ কাপড়ের তাঁতিদের আঙুল কেটে ফেলার মতো নির্মম ঘটনার নজিরও আছে। ব্রিটিশদের এই সব নানা নির্দয় কৌশলে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো সেই আশ্চর্য কাপড় মসলিন ধীরে ধীরে ঝরে পড়ে বিশ্ববাণিজ্যের মঞ্চ থেকে। ফুটি কার্পাস নামে যে বিশেষ তুলা থেকে মসলিন হতো, তা-ও হারিয়ে যায় একসময়। মসলিন ধারারই বিশেষ কাপড়, জামদানি মসলিনের শেষ বংশধর হিসেবে শুধু টিকে আছে এখনো।
পড়ছিলাম সাইফুল ইসলামের লেখা কফি-টেবিল বই মসলিন: আওয়ার স্টোরি, যিনি মসলিনকে বলেছেন পৃথিবীর প্রথম ‘গ্লোবাল ব্র্যান্ড’। পড়তে পড়তে লেখকের সঙ্গে এক আশ্চর্য অভিযানের সঙ্গী হয়েছিলাম যেন। বর্তমান থেকে দূর অতীতে যখন ভোরের শীতল হাওয়ায় জঙ্গলবাড়ি বা কাপাসিয়ার কোনো নদীর কূলে বসে কাটুনি মেয়েরা সুতা কাটছে। ভুলনকাঠি, বোয়াল মাছের দাঁত, চিতল মাছের চামড়া, কাছিমের খোল ইত্যাদির সাহায্য নিয়ে তৈরি হচ্ছে মসলিন সুতা। সেই সুতার কাপড় তারপর গিয়ে উঠছে নেপোলিয়নের স্ত্রী জোসেফাইন, লেখিকা জেন অস্টেন, আওরঙ্গজেবের মেয়ে জেবুন্নেসা, ফ্রান্সের রানি মেরি অ্যান্টোনিয়েটের গায়ে। এমন একটা কাপড়, যাতে ঠিক শীত নিবারণ হয় না, শরীর ঢাকে না, যা তৈরি করতে লাগে প্রচুর সময় আর পরিশ্রম, সেই কাপড়ের জন্য বিশ্বজুড়ে কেন এত উন্মাদনা, সেই রহস্যের খোঁজে নেমেছিলেন লেখক।
মসলিনের একটা কারিগরি মাত্রা আছে, আছে রাজনৈতিক মাত্রা, আছে সাংস্কৃতিক মাত্রাও। দক্ষতার সঙ্গে সে মাত্রাগুলো উন্মোচন করেছেন সাইফুল ইসলাম। জানতে পারছি, সুতার কাউন্টের ভিত্তিতে কী করে কাপড়ের সূক্ষ্মতায় তারতম্য তৈরি হয়। যেখানে একটা সাধারণ সুতি কাপড়ের কাউন্ট হয়তো ২০-৩০, সেখানে সবচেয়ে উন্নত মানের মসলিনের কাউন্ট ১ হাজারের ওপরে। মসলিনের সূক্ষ্মতাই একে করে তুলেছিল কাপড়ের জগতে অনন্য। বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যার পারের বিশেষ আবহাওয়া, এখানকার মাটির বিশেষ গুণে জন্ম নেওয়া ব্যতিক্রমী তুলা, বাঙালি মেয়েদের হাতের সূক্ষ্ম কাটুনির দক্ষতা, এখানকার তাঁতিদের অপরিসীম ধৈর্য ইত্যাদি মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এই বিরল কাপড়।
মসলিনের সুলুকসন্ধানে সাইফুল ইসলাম ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম, ঘুরেছেন কলকাতা, মুর্শিদাবাদ, প্যারিস, জেনেভা, আম্মান, নিউইয়র্কের নানা মিউজিয়ামে। খুঁড়ে এনেছেন নানা ঐতিহাসিক তথ্য। জানা গেল, ব্রিটিশরা নকল মসলিন বানিয়ে কী করে তাতে লাগিয়ে দিত মসলার গন্ধ, যাতে ক্রেতাদের ধোঁকা দেওয়া যায়, ব্রিটিশদের ছাড়া ভিন্ন দেশের এক ক্রেতার কাছে মসলিন বিক্রি করার কারণে বাংলার এক তাঁতিকে মাথার চুল কামিয়ে ঘোরানো হয়েছিল গ্রামের হাটে। ব্রিটিশ করের চাপে নিঃস্ব হতে বসা তাঁতি পরিবারের একজন কাটুনি নারী আঠারো শতকে সমাচার দর্পণ পত্রিকায় যে মর্মস্পর্শী চিঠি লিখেছিলেন, সেটাও পড়া গেল এই বইয়ের সুবাদে। খোঁজ পাওয়া গেল মসলিন নিয়ে তাঁতিদের ভেতর প্রচলিত গান, পুঁথিরও।
বইটির কাঠামো দুই ভাগে ভাগ করেছেন লেখক, এক অধ্যায়ে রয়েছে মসলিন বিষয়ে নানা তথ্য এবং তার সমান্তরালে চলেছে গবেষক হিসেবে তাঁর নিজের নানা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা। ফলে সুখপাঠ্য হয়েছে বইটি। সাইফুল ইসলাম পেশাদার গবেষক না হলেও একজন স্বশিক্ষিত গবেষক হিসেবে রেখেছেন গবেষণার পদ্ধতিগত পেশাদারি। প্রমাণ রয়েছে তাঁর সংবেদনশীল মনেরও। চমৎকার বর্ণনা করেছেন পাশ্চাত্যের মিউজিয়ামে প্রথম আদি মসলিন স্পর্শ করার অনুভূতি, মুর্শিদাবাদের বিরল, মসলিন তাঁতি জয়তোষের সঙ্গে সাক্ষাতের উত্তেজনা, একসময় তাঁতের শব্দে মুখর কাপাসিয়ার তাঁতিপাড়ার নিস্তব্ধতা। এই বই রচনার কথা যখন ব্রিটেনের এক মসলিন বিশেষজ্ঞকে বলেছিলেন সাইফুল, তখন সে গবেষক তাঁকে বলেছিলেন, মসলিন নিয়ে নতুন আর কী বলার আছে? সাইফুল নিষ্ঠার সঙ্গে মসলিন নিয়ে পৃথিবীর কাছে শুনিয়েছেন নতুন গল্প, যে গল্প পশ্চিমাদের বলা নয়, এটি আমাদের গল্প।
তবে এ বই শুধু একটা কাপড়ের গল্পই নয়, এ আমাদের ইতিহাস, রাজনীতির মুখোমুখি দাঁড়ানোরও একটা উপলক্ষ। আমাদের জাতিসত্তার ভেতর দীর্ঘমেয়াদি একটা হীনম্মন্যতার বীজ কাজ করে চলেছে। পাশ্চাত্যের আধিপত্যের ব্যাপারটাকে একেবারে নিয়তিনির্ধারিত ভেবে নেওয়ার প্রবণতাও আছে। অথচ ইতিহাস বলে, পাশ্চাত্য এই আধিপত্য রচনা করেছে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সুসংগঠিত নির্মমতার মাধ্যমে। ইতিহাসের দিকে তাই বরাবর আমাদের তির্যক চোখেই তাকানো প্রয়োজন। নিজের দেশের একটা গৌরবের উপলক্ষ কী করে ইতিহাসের খাদের অন্ধকারে পড়ে যায়, সেখানে বহিঃশক্তির পাশাপাশি আমাদেরও কি দায় নেই সেগুলোর খোঁজ নেওয়া? ইতিহাসকে মোকাবিলা করতে হলে আমাদের গল্পটা আমাদেরই বলা দরকার। অন্যরা যখন আমাদের গল্প বলবে, তখন সে গল্পের নায়ক থাকবে তারাই। এই বই আমাদের নিজস্ব গল্পটা নিজের মতো করে বলার চেষ্টারই একটা চমৎকার উদাহরণ। একটা জাতি পরিচয়ের মানসগঠনে এ ধরনের কাজ জরুরি।
এ গবেষণা পরিচালিত হয়েছে আলোকচিত্র প্রতিষ্ঠান ‘দৃক’, বাংলাদেশে জাতীয় জাদুঘর, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, আড়ং ও স্টেফানি ট্রাস্টের সহযোগিতায়। তারই ফসল চমৎকার মুদ্রণে একটি নিখুঁত আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনা। এ ছাড়াও দৃক আয়োজন করেছে মসলিন নিয়ে প্রদর্শনী, ডকুমেন্টারি, সেমিনার। মসলিনকে পুনরুজ্জীবিত করতে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, সেই সঙ্গে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত অতীত এবং বর্তমানের বয়নশিল্পীদের স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। মসলিন নিয়ে আমাদের নস্টালজিয়া আক্রান্ত বিস্মৃত গল্পকে দূর অতীত থেকে তুলে আনার এই নান্দনিক প্রকল্প হাতে নেওয়ার জন্য সাইফুল ইসলাম, দৃক ও সংশ্লিষ্টদের জানাই অভিনন্দন।
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman 567 @yahoo. com