পরমাণু অস্ত্রের হুমকি থেকে বিশ্ব কতটা নিরাপদ? এ প্রশ্ন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসী অভিযানের পর বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এখন এটি অন্তত পরিষ্কার, দীর্ঘ যুদ্ধের পরিণতি যা-ই হোক না কেন, চলতি যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত সমস্যাগুলো সহজে দূর হবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নের একসময়কার অংশ হিসেবে ‘উত্তরাধিকারসূত্রে’ ইউক্রেন যে পারমাণবিক অস্ত্র পেয়েছিল, তা তারা ১৯৯৪ সালে নিষ্ক্রিয় করেছিল। এ অস্ত্র সমর্পণের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া ইউক্রেনকে সার্বভৌমত্ব ও প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তা দিয়েছিল।
কিন্তু সেই নিশ্চয়তাগুলো আজ অকেজো হয়ে গেছে। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য না হওয়ার কারণে তারা মার্কিন পারমাণবিক ছাতার বর্ধিত প্রতিরোধ ছায়ায়ও ঠাঁই পায়নি। এখন প্রশ্ন উঠছে, সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোর মধ্যে যারা ন্যাটোতে যোগ দিয়েছিল, এখন তাদের কী দশা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ধিত প্রতিরোধব্যবস্থা কি আসলেই এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া বা এশিয়ার মিত্রদের সুরক্ষা দিতে পারবে?
বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের আশঙ্কাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে বের হতে না পারলে গোটা বিশ্বকেই তার খেসারত দিতে হবে।
পারমাণবিক প্রতিরোধব্যবস্থাকে বিশ্বাসযোগ্য হতে হলে পারমাণবিক অস্ত্রকে ব্যবহারযোগ্য হতে হবে। কিন্তু যদি তা খুব বেশি ব্যবহারযোগ্য হয়, তাহলে তা সহজেই একটি দুর্ঘটনা কিংবা ভুল বিবেচনাজনিত বিপর্যয়কর পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে একটি কার্যকর ভারসাম্য ধরে রাখতে আমাদের অবশ্যই পারমাণবিক এবং প্রচলিত অন্যান্য সরঞ্জামের যথাযথ মিশ্রণ নিশ্চিত করার কথা বিবেচনা করতে হবে। তারপর যখনই সম্ভব, তখনই পারমাণবিক উপাদান হ্রাস করতে হবে।
উদাহরণস্বরূপ, উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক অস্ত্র মজুতের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যে পদক্ষেপই নেওয়া হোক না কেন, তা কোনোভাবেই ১৯৯১ সালে কোরীয় উপদ্বীপ থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের সরিয়ে আনা কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্রের পুনঃস্থাপন হতে পারে না। অর্থাৎ যে কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র একবার সরিয়ে আনা হয়েছে, তা কোনোভাবেই সেখানে পুনরায় বসানো যাবে না।
জাপানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সেখানে মার্কিন বর্ধিত প্রতিরোধব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষায় আমেরিকান সেনাদের অবস্থানকে অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই সেখানে পারমাণবিক অস্ত্রের উপস্থিতি সমর্থনযোগ্য নয়। জাপানি সেনারা যে নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে, সেই একই ধরনের ভীতি জাপানে অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের মধ্যেও আছে। একই দুর্বলতার মুখোমুখি হওয়ার অনুভূতি উভয় পক্ষ ভাগ করে নেওয়ায় মিত্রদের মধ্যে পরস্পরকে ছেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কমিয়ে দেয়।
একসময় সংশয়বাদীরা মনে করত, বার্লিনে অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের ক্ষুদ্র দল শহরটিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন থেকে হয়তো রক্ষা করতে পারবে না। কিন্তু আমেরিকান বাহিনীর শারীরিক উপস্থিতি আগ্রাসন প্রতিরোধ এবং শীতল যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ পরিণতির জন্য অপরিহার্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। (এমনও এক সময় ছিল যখন ইউরোপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক কামান ছিল; কিন্তু কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বিবেচনায় সেগুলো পরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।)
আজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ তাদের নিজ নিজ বাহিনীকে আধুনিক করার কাজ অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে এসব বাহিনীর ব্যবহারযোগ্যতা নিয়ে বিতর্কও অব্যাহত রয়েছে। শক্তিধর দেশগুলো ক্রমাগত পরমাণু অস্ত্র মজুত করছে। কিন্তু এসব অস্ত্র ভবিষ্যতে কীভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, সে বিষয়ে বৈশ্বিক কোনো নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নেই। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, আমরা এখনো পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ এক বিপজ্জনক বিশ্বে বাস করছি। এ অস্ত্র কার কাছে কতটুকু নিরাপদ, তা নিয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না। এ কারণে দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের এখনই এ মজুত হ্রাস করার (যদিও একেবারে বিলুপ্ত করা নয়) করার চেষ্টা করা উচিত।
পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ধর্মতাত্ত্বিক পল রামসে একবার গাড়ির ধীরগতি ও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হ্রাস করার উপায় হিসেবে গাড়ির বাম্পারে বাচ্চাদের বেঁধে গাড়ির চালানোর সঙ্গে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিরোধের বিষয়টির তুলনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পরমাণু অস্ত্র যারা মজুত করছে, তাদের এমন একটি শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে হবে, যা তাকে নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই সংযত হতে বাধ্য করবে।
নতুন নতুন তথ্যপ্রযুক্তি ক্রমান্বয়ে পরমাণু অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে উত্তরোত্তর নাজুক অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেমে সাইবার আক্রমণ, স্যাটেলাইটগুলোতে লেজার আক্রমণ এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবস্থার উত্থানের সঙ্গে সমস্যাগুলো নতুন নতুন মাত্রা নিয়ে হাজির হচ্ছে। পরমাণু অস্ত্র সংবরণে রাজনীতিতেও পরিবর্তন আসতে হবে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় মতাদর্শিক পক্ষ-প্রতিপক্ষ সুস্পষ্ট নিয়মের একটি শাসন তৈরি করেছিল। সে সময় প্রত্যেকেই স্বীকার করেছিল, পারমাণবিক যুদ্ধ এড়াতে তাদের আগ্রহ রয়েছে।
বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের আশঙ্কাকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে বের হতে না পারলে গোটা বিশ্বকেই তার খেসারত দিতে হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● জোসেফ এস নাই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ডু মোরালস ম্যাটার বইয়ের লেখক