নজরুলের এই গানটি কে না শুনেছে? মাঝেমধ্যে আমিও গাই। নজরুল তাঁর গানে অনেক দেব-দেবীকে উপস্থাপন করেছেন, যার পরিপূর্ণ ইতিহাস এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। এই নদীতীরে ঘুরে বেড়িয়েছি কবির মতো, পদ্মার দেখা পাইনি। তাঁর পদচিহ্ন কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে গানের সুরে সুরে। সুরের মাঝেই অন্বেষণ। এর উজানেই নৌকা ভাসিয়েছেন আরেক কবি, লিখেছেন ‘সোনার তরী’: ‘কোন পারে ভিড়িবে তোমার স্বপন তরী’? নদী ও সংগীতসংশ্লিষ্ট পদ্মা নিয়ে গবেষণার নেই বিরাম। কে এই পদ্মা?
পুরীতে জগন্নাথ দর্শনে বিহ্বল মানুষ প্রভুকে খুঁজে চলেছেন। এ খোঁজার বিরাম নেই। ভারতে হাজার হাজার মন্দির। মন্দিরের মূর্তির পেছনে বিধাতাকে ওরা দেখেনি, আমরা তো নয়–ই। খুঁজতে খুঁজতে পদ্মার দেখা পেলাম। কীভাবে তার কথাই বলব।
কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দের গান সবাই শুনেছেন, আমরাও। পুরীর কাছে একটি গ্রামে থাকত পদ্মা নামের একটি মেয়ে, মালিনীর কন্যা, অথচ গানের গলাটি মধুর চেয়ে মধুর। অনেকের জানা আছে, জয়দেবের লেখা ‘সদুক্তিকর্নামৃত’র ২৬টি শ্লোক বাংলায় রচিত নয়। যদিও আমরা জানি বীরভূম জেলার অজয় নদের তীরে কেন্দুবিল্ব গ্রামের জন্মগ্রহণকারী জয়দেব বাঙালি। তাঁর গান ছিল নৃত্য ও গীতের সমারোহ। লক্ষ্মণ সেনের সভায় জয়দেব নিজেই গাইতেন গীতগোবিন্দের গান। এখানেই পদ্মাদেবীর আগমন। দক্ষিণী নৃত্যে পটীয়সী অসামান্য রূপসী কন্যা পদ্মা, যার মধ্যে রূপায়ণ হতো গীতগোবিন্দের আধ্যাত্মিক রূপ। কথিত আছে, দৈব আদেশে তার সঙ্গে বিবাহ হয় জয়দেবের।
পদ্মা গেয়ে শোনাত জয়দেবের গান আর বেগুনগাছ থেকে তুলত বেগুন। দূর থেকে শ্রীজগন্নাথ নিজেই কোথা থেকে শুনতে পেলেন সে মধুর সংগীত। তার ঘুরে বেড়ানোতে নেই কোনো বাধা। গিয়ে পেলেন সুন্দর একটি মেয়েকে, যে আপন মনে গাইছে গীতগোবিন্দের গান, আপনাতে আপনি বিভোল। পদ্মা জগন্নাথকে দেখেনি, নাম শুনেছে, জানতে পেরেছে, উনিই বিধাতা। উনি সবাইকে ভালোবাসেন, তার মতো একটি গ্রাম্য বালিকাকেও। পদ্মা নিজ আত্মাকেই শোনায় এ গান। ভাবে যদি কোনো দিন বিধাতা তার কাছে এসেই পড়েন, কী করবে সে। অন্তর্যামী সর্ব জীবের কল্যাণে নিয়োজিত, কাউকে উপেক্ষা করেন না, সবাইকে ভালোবাসেন। বালিকা পদ্মা তাঁর মন জয় করল। হলেন বিগলিত, আত্মবিস্মৃত; তিনি যে ভগবান, তা-ও তিনি ভুলে গেলেন। বেগুনগাছের কাঁটায় তাঁর উত্তরীয় মাটিতে পড়ে গেল। পদ্মা গানেই বিভোর। সে এত কিছু লক্ষ করেনি।
কিছু সময় পর পদ্মার ঝুড়ি বেগুনে ভর্তি হয়ে গেল, সে চলে গেল বাগান থেকে। পদ্মার গান শ্রবণ করার পর পরিতৃপ্ত শ্রীজগন্নাথ ফিরে গেলেন তাঁর মন্দিরে। পরদিন সকালে পূজারিরা এলেন প্রাতঃকালীন সেবাকর্মের দায়িত্বে। অবাক হয়ে দেখলেন জগন্নাথের ছেঁড়া বস্ত্র আর তাঁর সেই উত্তরীয়টিও উধাও। পূজারিরা হলেন চিন্তিত। এমন একটি ঘটনা ঘটতে পারে, তা কেউ কল্পনাও করতে পারে না, নিশ্চয়ই তাঁদের ত্রুটি হয়েছে শ্রীজগন্নাথকে বস্ত্র পরানোর সময়। তাঁরা শুরু করলেন উপবাস। শ্রীজগন্নাথ স্বপ্নে জানালেন, তোমাদের দোষ নেই, আমি গান শুনতে গিয়েছিলাম ওই মেয়েটির কাছে।
অবিলম্বে চারদিকে খোঁজ পড়ে। পদ্মাকে খুঁজে পাওয়া যায়। গীতগোবিন্দের গায়িকা গ্রামের মেয়ে পদ্মা কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবেনি এভাবে সে হবে সম্মানিত। সংগীতের ঢেউ মিশে গেল তার জীবননদীর স্বরগ্রামের সঙ্গে। পুরীর শ্রীজগন্নাথের মন্দিরে তার আসন হলো স্থায়ী। যেখানে প্রতিদিন শ্রীজগন্নাথের বিশ্রাম গ্রহণের আগে সুললিত কণ্ঠে গান গাইবে নৃত্যপটীয়সী পদ্মা।
এবার শোনা যাক নজরুলের গানটি: ‘পদ্মার ঢেউ রে, মোর শূন্য হৃদয়–পদ্ম নিয়ে যা, যা রে’। এখানে পদ্মা নদীর নামকরণের ইতিহাস নেই, আছে সেই পদ্মের খোঁজ, যার নামে পদ্মা। এত দূর থেকে আমরা শুধু শুনতে পাই ঢেউয়ের শব্দ আর প্রেমিক হৃদয়ের শূন্য হাহাকার, বিসর্জিত যা নদীর ঢেউয়ে।
পদ্মার ঢেউয়ে ঝিলমিল করে যে বঁধুয়ার কৃষ্ণকালো রূপ, তা ফুটে ওঠে সঞ্চারিতে। কৃষ্ণকালো রূপ শ্রীজগন্নাথের, আর কারও নয়। দূর থেকে অবশ্যই চেনা যায় পদ্মাকে। প্রেমের ঘাটে ঘাটে বাঁশি বাজায় যে প্রেমিক, খুঁজে পাওয়া দায় তাকে। চিরদিন সে আশার–দেয়ালী জ্বালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। তার পায়ে সমর্পিত হতে চায় পদ্ম। যেমনটি পদ্মা খুঁজে পায় মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবতাকে।
পদ্মা রূপ নেয় পদ্মে, যার কাছে নেই মধু, নেই সুগন্ধ, তার রূপের সরসীতে তাই নেই আনন্দ মৌমাছির ঝংকার। পদ্মা রূপ নেয় ঢেউয়ে, যখন তার মাঝে চিকমিক করে ওঠে চাঁদের আলো। চাঁদের আলোয় কৃষ্ণকালো বঁধুয়া।
গানটি গাওয়ার সময় কখনো গায়িকা পদ্মার কথা আগে মনে হয়নি। মনে হতো পদ্মফুলের মধ্যেই পদ্মার অবস্থান। পদ্ম ও পদ্মা যেন সমার্থবোধক। পদ্ম নারীর রূপ, পদ্মাও তা-ই। পদ্ম চায় বাঁশরির তালে যে প্রেমিক নেচে বেড়ায় তার আহ্বানে সাড়া দিতে।
গানটিতে বাঁশরি সঞ্চালনের প্রচুর সুযোগ অর্থাৎ এখানেই অনেকক্ষণ বাঁশরির প্রয়োগ হতে পারে যেমন ওস্তাদেরা ভাটিয়ালি গানের ধুন বাজাতে গিয়ে আশ্রয় নেন প্রলম্বিত তালের কাজে, যেন ওগুলো ঢেউয়ের কারসাজি। একটি ভাটিয়ালি গান তিন মিনিটের, অথচ ভাইটাল গাঙের মাঝিরা ওই গানটি গান প্রলম্বিত সুরে এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। পদ্মার ঢেউরেও তা-ই। এটি তিন মিনিটের গান নয়, এটি প্রাণ মাঝির শাশ্বত সংগীত, যে সর্বমুহূর্তে প্রেমিককে খুঁজে ফিরছে। পদ্মাকে খুঁজতে গিয়ে পাই স্রষ্টাকে, সর্বজীবের মঙ্গলের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
[email protected]