হার্ডিঞ্জ ব্রিজের সঙ্গে পদ্মা সেতুর কেন তুলনা করে কথা হচ্ছে? এমন তুলনার কি কোনো জায়গা আছে আসলে? হার্ডিঞ্জ সাহেবের নামে তৈরি ঈশ্বরদী-ভেড়ামারার সেতুটি পদ্মার ওপর তৈরি প্রথম সেতু বটে; তবে এই সেতু ব্রিটিশ প্রশাসনের সঙ্গে মধ্যবঙ্গকে যুক্ত করার সেতু। এতে বাংলার ওপর ব্রিটিশ উপনিবেশের হাত আরও লম্বা এবং প্রভাব আরও গভীর হয়েছে। আমাদের পদ্মা সেতু রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের মধ্যখণ্ডকে সরাসরি যুক্ত করেছে। নামে ও কাজে দুই সেতুর চরিত্র ও অভিমুখ আলাদা।
এদিক থেকে পদ্মা সেতু স্বাধীন জাতিরাষ্ট্রের একটা অসম্পূর্ণতা মিটিয়েছে। আকাশ, নদী ও সেতুপথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের দক্ষিণবঙ্গমুখী বর্ণিল শোভাযাত্রা হয়তো সেই ভূমির সঙ্গে ভূমির মিলনেরই রাষ্ট্রীয় উদ্যাপন। দেশের বিরাট একটা অংশ, পদ্মা নদীর এপার-ওপার এই প্রথম জাতীয় রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হলো। যমুনা সেতু ছিল এ ব্যাপারে প্রথম, তারপর মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র। পদ্মা সেতু দিয়ে রাষ্ট্রীয় একীকরণ (ইনটিগ্রিটি) পুরা করা হলো। এই কাজের কাজি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সরকার অবশ্যই অভিনন্দনের দাবিদার।
আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা নিয়ে আধুনিক উন্নয়নবাদী জাতিরাষ্ট্র সবল হয় না। এটা হলো পদ্মা সেতুর দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক তাৎপর্য। এই তাৎপর্য কোনো দলের মুখাপেক্ষীও নয়। বর্তমানের কথা ভিন্ন হলেও আখেরে তা কোনো দলকে বঞ্চিতও করবে না। কিন্তু ঢাকা কতটা সাফল্যের সঙ্গে একে কাজে লাগাতে পারবে, সেটাই হলো এখন বিষয়। ঢাকা কি দক্ষিণবঙ্গকে মোলাকাত করতে প্রস্তুত? দক্ষিণ থেকে যে বিপুল জনস্রোত ঢাকায় আসবে, ঢাকা দিয়ে বাকি দেশ কতটা দক্ষিণের সঙ্গে অর্থনৈতিক কারবার চালানোর জন্য তৈরি, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পদ্মামুখী এক্সপ্রেস হাইওয়ের সঙ্গে গাজীপুর-ময়মনসিংহ এবং চট্টগ্রাম-সিলেটের যোগাযোগ মসৃণ করার কাজ এখনো শেষ হয়নি। পদ্মা সেতুতে রেলও এখনো যোগ হয়নি।
প্রধান অসদ্ব্যবহার হলো, সেতুর রাজনীতিকরণ। লালন বলেছেন চোখের আড়ে পাহাড় লুকানোর কথা। আমরাও সেতুর খিলানের আড়ালে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার এবং দুর্নীতি ও অর্থপাচারের ইস্যু ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা দেখছি। উন্নয়নের ধুলায় মানুষ অন্ধ থাকে না বেশি দিন।
বাংলাদেশ তো আসলে তিন নদীর বদ্বীপ। প্রতিটা খণ্ড যুক্ত হওয়া মানে দেশ ভেতরের দিকে আরও বড় এবং নিবিড় হওয়া। ভূমিতে রাজধানীর সঙ্গে যুক্ত না হলে বিযুক্ত এলাকার মানুষ তো পূর্ণ নাগরিকতাই ভোগ করে না। যাদের জীবনে পদ্মা নদীর ভূমিকা এত মৌলিক, জরুরি প্রয়োজনে যাদের অসহায় অপেক্ষায় পড়তে হতো ফেরিঘাটে, এই সেতু প্রথমত তাদের। রাজনীতি বদলাবে, কিন্তু সেতুটা তাদের থাকবে। নিয়ম ভেঙে হাজার হাজার মানুষের সেতুতে উঠে পড়ায় দেখা গেছে তাদের এই অভূতপূর্ব আনন্দের প্রকাশ। জনগণ সেতুর ওপর এভাবে তাদের মালিকানা বুঝে নিল। সেতু উদ্বোধনের দিন তাই অনেক গল্প তৈরি হয়েছে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণ।
তবে ‘মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, আমি পদ্মা সেতু দেখেছি’ ধরনের আলাপ শিশুসুলভ। যেন শিশুরা ভাবছে তারা জননীর সমান। মুক্তিযুদ্ধ না হলে পদ্মা সেতু হতো কি না সন্দেহ। আর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের সঙ্গে যে বিপুল ত্যাগ ও রক্তদান জড়িত, তার সঙ্গে একটা সেতু কেন, কোনো কিছুরই তুলনা হয় না। তাই পদ্মা সেতু দেখলেই মুক্তিযুদ্ধ দেখা হয় না, তার অন্যতম অবদানই দেখা হয় শুধু।
পদ্মা শেষ পর্যন্ত একটা মহানদীই। ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলে এই নদী বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জীবননালি। গঙ্গা যবে থেকে পদ্মা নাম নিয়ে পূর্ব দিকে সরে এসেছে, তবে থেকে পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের বিকাশের শুরু। শত বিপর্যয় ও ধ্বংসের পরও এই দেশ যে টিকে আছে খাদ্যে ও বসতিতে, তার একটা বড় অবদান পদ্মা নদীর। সে জন্য নদীর চেয়ে তার ওপর বানানো সেতু কখনো বড় হতে পারে না। নদীর কথা চিন্তা না করে তাই সেতু নিয়ে থাকলে হবে না। বাংলাদেশের বেশির ভাগ নদীই এখন দারুণ অসুস্থ এবং মারাত্মকভাবে আক্রান্ত।
স্বাধীনতার যুগে জাতি, জাতীয়তাবাদ ও দেশের প্রতীক ছিল নদী। এখনকার উন্নয়নের যুগের প্রতীক সেতু। কিন্তু নদীই আসল। নদী না থাকলে তো মরু। মরুতে সেতু মূল্যহীন। পদ্মা সেতু নিয়ে কথাবার্তা তাই পদ্মা নদীরই আলাপ। নদীর সঙ্গে মিলিয়েই একে দেখতে হবে। এখন প্রচারণার সঙ্গে সঙ্গে সেতু নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে। প্রচারণা থেমে যাবে, সেতুচিন্তা কিন্তু চলতে থাকবে। সেতুসাহিত্যও ভালো, তা যদি সুস্থ মস্তিষ্কে করা হয়। না হলে পদ্মা সেতু অর্থনৈতিকভাবে আগুয়ান হওয়ার যে সুযোগ তৈরি করেছে, তার সদ্ব্যবহার হবে না। অসদ্ব্যবহার অবশ্য হতে পারে।
প্রধান অসদ্ব্যবহার হলো, সেতুর রাজনীতিকরণ। লালন বলেছেন চোখের আড়ে পাহাড় লুকানোর কথা। আমরাও সেতুর খিলানের আড়ালে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, মানবাধিকার এবং দুর্নীতি ও অর্থপাচারের ইস্যু ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা দেখছি। উন্নয়নের ধুলায় মানুষ অন্ধ থাকে না বেশি দিন। পদ্মা সেতুর কৃতিত্ব অবশ্যই আওয়ামী লীগ সরকারের কিন্তু তার মানে এই নয় যে যা পাইনি, যা থেকে দেশ বঞ্চিত, তার বেদনা মানুষ ভুলে যাবে। তা ছাড়া বাঙালি বড়ই বিস্মৃতিপ্রবণ; কারও কারও ভাষায় ‘অকৃতজ্ঞ’। নদীর মুশকিল আসানের পর তারা অনেক সময়ই মাঝিকে আর মনে রাখে না।
যে দেশে চালচুলাহীন লোকও নিজের বিয়েতে ব্যান্ড পার্টি ভাড়া করে, সে দেশে পদ্মা সেতু নিয়ে উচ্ছ্বাস একটু বেশিই হবে। এটাই এই দেশের রীতি। কিন্তু বাইপোলার ডিসঅর্ডারে ভোগা বাংলাদেশিদের এক দল পদ্মা সেতুকে স্বর্গের সিঁড়ি ভাবছে, আরেক দলের মন খারাপ। গণহিস্টিরিয়াগ্রস্ত এই দুই দলের মধ্যখানেই বাস্তবতা পদ্মার বিপুল চরের মতো জেগে আছে। সেই চরটা হলো আমাদের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতার আত্মবিশ্বাস। রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা একটা বড় ব্যাপার, এটা নাগরিকদের রাজনৈতিক আত্মবিশ্বাসও দেয়। অপরাপর দেশের হীনচোখে দেখার দৃষ্টির জবাব দেয়।
তবু সেতুর চেয়ে পদ্মা নদীই বড়। নদীটা শুকাতে বসেছে। ভরা বর্ষায়ও চর জেগে আছে। রাজশাহীর দিকের পদ্মার অবস্থা তো আরও খারাপ। কারণ, উজানের পানি বঞ্চনা। সেতুর কারণে হয়তো আরও বদল ঘটবে। কিন্তু পদ্মা কি আমাদের শত্রু যে তাকে জয় করতে হবে? বা মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের সঙ্গে তুলনা করতে হবে? প্রকৃতিকে দখল, শাসন, জয় করার এই চিন্তাই কিন্তু উন্নয়ন চিন্তার মধ্যে থেকে যাওয়া সমস্যা। এমন চিন্তাই উন্নয়নকে প্রকৃতি ও মানুষের বিপক্ষে দাঁড় করায়।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক এবং প্রতিচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক।
[email protected]