বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অন্যদের মতো আমাকেও গর্বিত করে। আমাদের জাতীয় পতাকার একটা ইতিহাস আছে। স্বাধীনতাসংগ্রামের একপর্যায়ে সবুজের ওপরে লাল এবং তার ওপরে মানচিত্র দিয়ে জাতীয় পতাকা ডিজাইন করা হয়েছিল। তখন সংগ্রামটাই প্রধান ছিল। তাই পতাকার মাপ, রঙের ব্যাপারে তেমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ পতাকাটাই আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। শত্রুসেনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মনোবল পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর সেই পতাকাটাকে ইম্প্রোভাইজ করা হয়—সবুজের ওপরে শুধু লাল। পতাকার মাপ ও রং–ও সে সময় ঠিক করা হয়।
রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান কিংবা খেলার সময় লাল-সবুজের পতাকাটা উত্তোলন করা হয়। এটার একটা বিরাট মহত্ত্ব আছে। পতাকা দেশেরই একটা প্রতীক। পতাকা দেখেই আমরা আমাদের দেশকে চিনতে পারি। আলাদা করে দেশের নাম দেখতে হয় না।
ভুল রং ও ভুল মাপের পতাকার ব্যাপারে আমাদের সবারই সচেতন থাকা উচিত। এর সঙ্গে দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি আমরা কতটা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছি, সে প্রশ্ন জড়িত। এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা ও বর্তমান প্রযুক্তির সঙ্গে মিলিয়ে পতাকাসংক্রান্ত বিধিমালা হালনাগাদ করা গেলে পতাকা তৈরির ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার ঝুঁকি একেবারেই কমে যাবে
একজন মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পী হিসেবে আমার কাছে জাতীয় পতাকা অনেক বেশি আবেগের বিষয়। জাতীয় পতাকার ভুল ব্যবহার, বিশেষ করে ভুল মাপ ও ভুল রঙের ব্যবহার আমাকে ব্যথিত করে। রাস্তায় যখন পতাকা বিক্রি করতে দেখি, সেগুলোর একেকটা একেক ধরনের। ঢাকা শহরে যে পতাকাগুলো করে, সেগুলোতে মূল রংটা কিছুটা হয়তো থাকে। একেবারে যথাযথ না হলেও রংটা থাকে। কিন্তু মাপটাতে সমস্যা হয়। মাপ বলতে পতাকার বৃত্তটা কতখানি হবে, রেখাগুলো কোন দিকে হবে, সে বিষয়গুলো ভুলভাল থাকে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছরই জাতীয় পতাকা বিধিমালা-১৯৭২ জারি করা হয়। ২০১০ সাল সেটি সংশোধিত হয়। বিধিমালার ৩ নম্বর বিধিতে ‘পতাকা’র ‘আয়তন ও বর্ণনা’ অংশে বলা হয়েছে, “‘জাতীয় পতাকা” গাঢ় সবুজ রঙের হইবে এবং ১০: ৬ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তক্ষেত্রাকার সবুজ রঙের মাঝখানে একটি লাল বৃত্ত থাকিবে। লাল বৃত্তটি পতাকার দৈর্ঘ্যের এক-পঞ্চমাংশ ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট হইবে। পতাকার দৈর্ঘ্যের নয়-বিংশতিতম অংশ হইতে অঙ্কিত উল্লম্বরেখা এবং পতাকার প্রস্থের মধ্যবর্তী বিন্দু হইতে অঙ্কিত অনুভূমিক রেখার পরস্পর ছেদ বিন্দুতে বৃত্তের কেন্দ্র বিন্দু হইবে। (১) রং: (ক) পতাকার সবুজ পটভূমি হইবে প্রতি হাজারে প্রোসিয়ন ব্রিলিয়ান্ট গ্রিন এইচ-২ আর এস ৫০ পার্টস। (খ) লাল বৃত্তাকার অংশ হইবে প্রতি হাজারে প্রোসিয়ন ব্রিলিয়ান্ট অরেঞ্জ এইচ-২ আর এস ৬০ পার্টস।’
পতাকার কোনটি আসল রং, সেটা আগে চিনতে হবে। রং নির্ধারণের এখন অনেক আধুনিক পদ্ধতি রয়েছে। সিএমওয়াইকে কিংবা আরজিবি পদ্ধতিতে যদি রঙের পারসেন্টেজ ঠিক করে দেওয়া হয়, তবে রঙের ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার বিপদ একেবারেই কাটানো সম্ভব। আবার মাপের ক্ষেত্রে মাঝে কতখানি লাল থাকছে। ওপরে কতটা সবুজ, নিচে কতটা সবুজ, ডানে বা বাঁয়ে কতটা সবুজ থাকছে সেটাও জানাটা খুব জরুরি। আমার মনে হয়, খুব কম মানুষই সেটা জানে।
সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় আছে। সরকারি টেলিভিশন ও রেডিও আছে। দেশে অনেকগুলো পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন ও রেডিও আছে। প্রতিবছর বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস ও অন্যান্য জাতীয় দিবসের আগে যদি জাতীয় পতাকার সঠিক মাপ ও রং সম্পর্কে জানানো হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ আরও সচেতন হতে পারবে। সাধারণ মানুষের পক্ষে পতাকার যথাযথ সঠিকভাবে নির্ধারণ করা কঠিন। আমরা যদি ‘ব্রিলিয়ান্ট গ্রিন’ বলি তাহলে সেটা মানুষ বুঝতে পারে না। ‘বটল গ্রিন’ বললে হয়তো কিছুটা বুঝতে পারব। আবার ‘বটল গ্রিন’ও তো অনেক ধরনের আছে। তাই একে সুনির্দিষ্ট করলে ভালো হয়। এ প্রযুক্তির যুগে সব ডিজাইনের কাজ কম্পিউটারে করা হয়। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক অনেক প্রকাশনায় বাংলাদেশের পতাকা ছাপাতে হয়। আমাদের পতাকার রঙের ক্ষেত্রে যদি সিএমওয়াইকে কিংবা আরজিবি নির্ধারিত করে দেওয়া হয়, তবে তা একেবারেই সুনির্দিষ্ট থাকবে। কোনো ধরনের ভুল হওয়ার সুযোগ থাকবে না।
জাতীয় পতাকা ঠিকভাবে তৈরি করার বিষয়টি স্কুল পর্যায়েই শেখানো উচিত। শৈশবে কিছু শেখানো হলে সেটা সারা জীবন আমাদের মনে থাকে। যারা পতাকা তৈরি করে, তাদের সচেতন থাকা উচিত। পতাকার রং ও মাপ ঠিকঠাক হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে তাদের জানতে হবে। স্কুলে জাতীয় পতাকা অঙ্কন ও হাতে–কলমে পতাকা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
ভুল রং ও ভুল মাপের পতাকার ব্যাপারে আমাদের সবারই সচেতন থাকা উচিত। এর সঙ্গে দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি আমরা কতটা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছি, সে প্রশ্ন জড়িত। এ নিয়ে প্রচার-প্রচারণা ও বর্তমান প্রযুক্তির সঙ্গে মিলিয়ে পতাকাসংক্রান্ত বিধিমালা হালনাগাদ করা গেলে পতাকা তৈরির ক্ষেত্রে ভুল হওয়ার ঝুঁকি একেবারেই কমে যাবে।
● আবুল বারক আলভী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও চিত্রশিল্পী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা অনুষদের অনারারি অধ্যাপক