দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। এই জেলায় ছোট–বড় মিলে নদ-নদীর সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। এর মধ্যে অন্তত ৩০টি নদী আমি সরেজমিনে দেখেছি। একটি নদীর কথাও বলা যাবে না, যে নদীটি ভালো আছে। কোথাও দখল, কোথাও দূষণ, কোথাও সরকারি পরিচর্যার অভাব, কোথাও বালু উত্তোলন আর কোনো নদীর পানি উজানে ভারত নিয়ন্ত্রণ করে।
সম্প্রতি পঞ্চগড় জেলার নদ-নদীর অবস্থা নিয়ে ‘পঞ্চগড় জেলা নদী সংলাপ’-এর আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) এবং রিভারাইন পিপল এ সংলাপের আয়োজক ছিল। বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ আমরা অনেকেই উপস্থিত ছিলাম। সংলাপের আগের রাতে মহানন্দা নদীর তীরে বেসরকারি সংস্থা ইএসডিওর (ইকো সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন) রেস্টহাউসে ছিলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড় দেখার আগ্রহ থেকেই সেখানে রাতযাপন।
মহানন্দা নদী বাংলাদেশ-ভারত সীমানা চিহ্নিত করেছে। সকালে উঠে আমরা সেই মহানন্দার পাড় থেকে কুয়াশায় ঢাকা পাহাড় দেখতে পাইনি। নদীটিতে দেখলাম অনেকেই পাথর তুলতে আসছে। যাঁরা পাথর তুলে জীবিকা নির্বাহ করেন, তাঁদের কাছেই শুনলাম, ভারত যখন ইচ্ছা পানি ছাড়ে, যখন ইচ্ছা পানি আটকে রাখে। কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে না পাওয়ার চেয়ে বেশি মন খারাপ হয়েছিল মহানন্দার ওপর অবিচার দেখে।
মহানন্দার পাড় থেকে পঞ্চগড় শহরের দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। এই ৫০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে আসার সময়ে চোখে পড়ল গোবরা, বেরং, ভেরসা, ডাহুক, চাওয়াই এবং করতোয়া নদী। খননের নামে ভেরসা নদীটিকে সরু খালে পরিণত করা হয়েছে। গোবরা, বেরং নদীর অবস্থাও খারাপ। ১৯৭১ সালে চাওয়াই নদী পার হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রবেশ করতে পারেনি। তাই চাওয়াই নদীর পাশে দীর্ঘ এলাকা ছিল মুক্তাঞ্চল। বর্তমানে চাওয়াই নদীটিকে দেখলাম সংকুচিত করা হয়েছে।
পঞ্চগড় শহর গড়ে উঠেছে করতোয়া নদীর তীরে। এই নদীর প্রতি সরকারের উদাসীনতা চোখে পড়ার মতো। শহরের কোথাও কোথাও এ নদীতে বর্জ্য ফেলা হয়। এ নদীর সর্বনাশ মূলত বালু উত্তোলনে। অবৈধভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক বালু উত্তোলন করা হয়। সরকারের দায়িত্বশীল সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর চোখের সামনে হাজার হাজার ট্রাক বালু দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়।
সকালে আমরা করতোয়া নদীতে নেমেছিলাম। নদীর পাড় ঘেঁষে একটি পুলিশ ফাঁড়ি। তার পাশেই একটি গরুর খামার থেকে ময়লা এসে নদীতে মিশে পানির রং বদলে দিয়েছে। করতোয়া হিন্দুপুরাণমতে গুরুত্বপূর্ণ নদী। শিবের হাত ধোয়া পানি থেকে এ নদীর উৎপত্তি বলে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করেন। মহাভারতে এ নদীর নাম পুণ্যতোয়া। কয়েক শ বছর আগে করতোয়াই ছিল উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় নদী। বগুড়ায় প্রাচীন পুণ্ড্রনগরী গড়ে উঠেছিল এই নদীর পাড়েই। বর্তমানে করতোয়া কয়েক ভাগে ভাগ হয়ে গেছে।
করতোয়া নদীর তীরেই পঞ্চগড় জেলা পরিষদের মিলনায়তন। সেখানেই পঞ্চগড় জেলা নদী সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এই সংলাপে প্রধানত অংশ নেন করতোয়া, ছেতনাই, পাথরাজ এবং পাম নদ সুরক্ষা কমিটির সদস্যরা। এ ছাড়া আরও প্রায় ছয়-সাতটি নদীর পাড়ের মানুষ উপস্থিত ছিলেন। শুরুতেই নদী সংগঠক রেজাউল করিম রেজা পঞ্চগড়ের নদীগুলোর বেহাল সম্পর্কে ধারণা দেন।
নদী সংলাপে এ রহমান মুকুল নামের একজন গণমাধ্যমকর্মী ভারতের একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের সূত্র ধরে বলেন, ‘মহানন্দা নদীর পানি ভারতে দূষিত হচ্ছে। এই পানি ভীষণ বিষাক্ত। বাংলাদেশে যে হাজার হাজার পাথরশ্রমিক নদীতে নামেন, তাঁদের আক্রান্ত হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা আছে। তালমা নদী প্রকাশ্যে দখল করে ভরাট করা হয়েছে। এ নদীতে তৈরি করা রাবার ড্যাম কৃষকের কোনো কাজে আসেই না, বরং উজানে এই রাবার ড্যামের কারণে ক্ষতি হচ্ছে।’
পঞ্চগড় শহর গড়ে উঠেছে করতোয়া নদীর তীরে। এই নদীর প্রতি সরকারের উদাসীনতা চোখে পড়ার মতো। শহরের কোথাও কোথাও এ নদীতে বর্জ্য ফেলা হয়। এ নদীর সর্বনাশ মূলত বালু উত্তোলনে। অবৈধভাবে প্রতিদিন হাজার হাজার ট্রাক বালু উত্তোলন করা হয়। সরকারের দায়িত্বশীল সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর চোখের সামনে হাজার হাজার ট্রাক বালু দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়।
নদী সংলাপে আক্ষেপ করে শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘৪০ বছর ধরে পরিবেশ নিয়ে কাজ করছি। মনে হয় যেন কারও দায় নেই নদী রক্ষায়।’ পঞ্চগড় মকবুলার রহমান সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এহতেশামুল হক বলেন, নদী দখলকারীদের সামাজিকভাবে বর্জন করা জরুরি।
ভূমিজ নামের একটি নাট্য সংগঠনের সংগঠক মোশতাক আহমেদ জানান, ডাহুক নদের চার-পাঁচ কিলোমিটার এমনভাবে দখল হয়েছে যে সেখানে জেলেসহ সাধারণ মানুষ কেউ প্রবেশ করতে পারেন না। পাথরাজ নদ সুরক্ষা কমিটির সদস্যসচিব আবদুল্লাহিল কাফি বলছিলেন, পাথরাজ নদটি দখল হয়ে যাচ্ছে। বোদা পৌরসভার সব ময়লা-আবর্জনা এ নদে ফেলে নদটিকে মেরে ফেলা হচ্ছে। ছেতনাই নদ সুরক্ষা কমিটির এক সংগঠক মালেউল ইসলাম মিঠু বলছিলেন, ‘আমরা ছোটবেলায় কত সুন্দর দেখেছি এ নদীটি। এখন এই নদীতে পানি থাকে না। দেখে খুব কষ্ট হয়।’
নদী সংলাপে পঞ্চগড় জেলার নদীগুলোর প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে। এ জেলার ভেতর দিয়ে প্রায় ১০টি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এর সব কটি বাংলাদেশ-ভারত স্বীকৃত আন্তসীমান্তীয় নদীর তালিকায় নেই।
সংলাপ শেষে আমরা ডাহুক এবং পাথরাজ নদ সরেজমিন দেখতে গিয়েছিলাম। দেখলাম ডাহুক নদটি একটি চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নিজেদের রিসোর্টের ভেতরে এমনভাবে নিয়েছে যে সত্যি সাধারণ মানুষের প্রবেশের উপায় নেই। পাশেই দেখলাম, অবৈধ বালু উত্তোলন করার কারণে নদটির করুণ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। নদের মূল প্রবাহ চেনাই যাচ্ছিল না। পাথরাজ নদ বোদা পৌরসভায় প্রকাশ্যে নির্যাতনের শিকার। এ নদ রক্ষায় সরকারিভাবে যাঁরা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁদের বিরুদ্ধেই আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলছিলেন, ‘নদী-প্রকৃতির ক্ষতি করে যেকোনো উন্নয়নকে উন্নয়ন বলা যায় না। কোটি কোটি টাকা বানানো যাবে, কিন্তু একটি নদী বানানো যাবে না।’
পঞ্চগড়ের কুরুম, ঘোড়ামারা, চিলকা, টাঙন, ডারা, তীরনই, পাঙ্গা, বুড়িতিস্তা, বোরকা, যমুনা, রণচণ্ডী, সিংগিয়া, সুই, হাতুড়ি, রসেয়া নদীও আমি সরেজিমনে দেখেছি। এ নদীগুলোর স্বাস্থ্যও ভালো নেই। এ জেলার সব নদী এখনো সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত হয়নি। পঞ্চগড়ের নদীগুলোর গুরুত্বমাফিক একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা জরুরি। কিছুদিন আগে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী পঞ্চগড় থেকে সমুদ্র পর্যন্ত নৌযোগাযোগ স্থাপন করার কথা বলেছেন। এর জন্য পঞ্চগড় থেকে নৌপথ চিহ্নিত করা প্রয়োজন। আমরা মনে করি, সরকার চাইলে জনবান্ধব এ কাজ করা সম্ভব।
পঞ্চগড়ের নদীগুলোকে বাঁচানো না গেলে সেখানকার পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, কৃষি-অর্থনীতি সবটাই ক্ষতির মধ্যে পড়বে।
● তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
wadudtuhin@gmail. com